ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :
মানবজীবনে কৈশর এক অম্লমধুর সন্ধিক্ষণ। এ সময়ের স্বপ্ন কিংবা নেশা অনেকের জীবনেই পরবর্তীতে পেশায় পরিণত হয়। পরিবেশ-প্রতিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ ও জীবনবোধের সূচনাই হলো কিশোর জীবনের কড়চা। আমার কৈশর কেটেছে বিল-বাওর, নৌকা-পোলো, জাল-জেলে আর বড়শির সাহচর্যে। বাড়ির দক্ষিণেই নলডাঙ্গার বিল। বর্ষার সমাগমে খালে-বিলে তখন অথৈ পানি। পানির সাথে সাথে চলে আসে কৈ, শিং, মাগুর, বাঈম, চ্যালা-পুঁটি, ট্যাংরা, পাবদা, খৈলসা, টাঁকি, শোল-বোয়াল প্রভৃতি অসংখ্য স্বাদু পানির মাছ। বাড়ির আনাচে-কানাচে কিংবা ধান-পাট ক্ষেতে তখন এসব মাছে টইটম্বুর। নদীর ঘোলা পানির স্রোতে চিংড়ি, বেলে, আইড়, রিঠা প্রভৃতির আনাগোনা।
আমাদের বাড়ির উত্তর-পশ্চিম দিয়ে একটা খাল ছিলো বহুদিন যাবৎ। মধুমতির যৌবনকালে এ খাল দিয়ে মাঝে মধ্যে ছোট-খাটো নৌকা এবং মানুষের লাশ কিংবা মরা জীবজন্তু-জানোয়ারকে ভেসে দক্ষিণের বিলের দিকে যেতে দেখেছি। তবে সম্ভবত ১৯৫৫ সালের দিকে যখন উত্তরে বয়ে যাওযা মধুমতি নদীর পাড় বরাবর বেড়ি বাঁধ দেয়া হয়, তখন থেকে এ খালটাও মরে যায়। তাছাড়া এই খালের মুখেই ছিলো আমাদের একখণ্ড জমি। খাল মরে যাবার পর বাবা এ জমিতেই আমাদের পুকুরটা কাটালেন। তবে আমাদের খালটা শুকিয়ে গেলেও প্রমত্তা মধুমতির পানি আশপাশের গ্রামের খাল দিয়ে বিলে এসে ঢুকতো প্রবল বেগে। তাই বর্ষাকালে আমাদের বাড়ির আশেপাশে পানি আর মাছের কোনো অভাব দেখা দিতো না।
অগ্রজ ভাইদের অনুকরণেই হোক, কিংবা নিজস্ব স্বভাবের কারণে মাছ ধরার এক পাগল করা নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। বলতে গেলে এটা ছিলো অনেকটা আশৈশব প্রেরণা। বন্যার পানিতে রাতের বেলায় ছোট ছোট ছিপ গেড়ে মাথায় সূতার সাথে বড়শি ঝুলিয়ে তাতে কেঁচো গেঁথে টাকি, শিং-মাগুর ধরা; দিনের বেলায় লম্বা কঞ্চির ছিপে বড়শি ও ফাত্না লাগিয়ে নানা জাতের মাছ শিকার করা ছিলো আমার জন্য নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। অথবা খুব ভোরে উঠে হোঁচা দিয়ে হালট কিংবা ধানী জমির আইলে টেনে কুঁচো চিংড়ি আহরণ ছিলো স্কুল ও পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে নলডাঙ্গার বিলে কৈ-জাল পেতে কৈ, শিং-মাগুর ও ভেদা (মেনি) মাছ মারার আকর্ষণই ছিলো আলাদা। তাছাড়া শরৎ-হেমন্ত ও শীতকালে বিলের কেন্দ্রে গিয়ে জিয়ালা বড়শি পেতে বড় বড় শোল-বোয়াল মারা কিংবা বিলের পানিতে নেমে পোলো দিয়ে বারোজাতের মাছ মারার আনন্দ ও নেশা আমাকে বুঁদ করে রাখতো। আর এ নেশা আমাকে যৌবন অবধি তাড়া করে ফিরেছে! ক্লাসের ফার্স্ট বয় হওয়া সত্ত্বেও আমার সখ্যতা ছিলো গ্রামের এক অশিক্ষিত কিশোরের সাথে। নাম তার চঞ্চল (সরওয়ার) মোল্লা। কিন্তু অপভ্রাংশ হয়ে গ্রামের সবাইসহ আমিও তাকে ডাকতাম ‘চুনচালে’ বলে। পরে সে অবশ্য সে আমাকে ডাকতো ‘নানা’ বলে, আমিও তাকে সম্বোধন করতাম ‘নানা’ বলেই। দু’জনে মিলে কত যে বিনিদ্র রজনী বিলের মাঝে, কখনও বা নৌকার উপর পাটাতলে শুয়ে কিংবা বিলের মাঝখানটায় অবস্থিত রায়দের পুকুর পাড়ে কুঁড়েঘর (অস্থায়ীভাবে খড় ও বাঁশের কঞ্চির ফ্রেম তৈরি করে) বানিয়ে কাটিয়েছি, তা আজ হিসেব করে বলা মুশকিল।
জীবনে যেমন অজস্র মাছ ধরেছি, তেমনি খেয়েছিও অফুরন্ত, বিলিয়েছি অকাতরে পাড়াপড়শিদেরকে। দু-এক পদের মাছ ভাজা কিংবা তরকারি (ঝোল) পাতে না পড়লে আমার খাওয়াই হতো না। এ নিয়ে অগ্রজ জাহিদ ওরফে নন্টু ভাই অনুযোগ করে মাকে উদ্দেশ্য করে বলতো- ‘দাও, দাও! ঐ রাক্ষসটারেই খাওয়াও! আর কারো খাওয়া লাগবে না।’
জাহিদ ভাই সবসময়ই কম খেয়ে কিংবা অল্প তরকারি (ঝোল) মাছ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত। আর আমি ছিলাম ঠিক তার উল্টো। শুকনো ভাত আর ডাল (ডাউল) আমার চির অপছন্দের! এক কথায় যাকে বলে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র স্বার্থক ধারক-বাহক ছিলাম আমি।
দিনে-রাতে মাছ ধরতে গিয়ে শীত-গ্রীষ্ম বা বর্ষার কথা মনে থাকতো না। গায়ের রং পুড়ে কালো হওয়া কিংবা কনকনে শীতে ঠোঁট ফেটে যাওয়া, অথবা পায়ের নখগুলো ক্ষয়ে যাওয়া, মাঝে মধ্যে প্রচণ্ড খরায় নাক দিয়ে রক্তপড়াÑ এসব উপসর্গ তো ছিলই। তাছাড়া বাবার বকুনি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই আমার এ নেশা এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পাড়া-পড়শিরা অনেকইে আমাকে বলতো ‘জেলে’। কারণ, পৌষ-মাঘের হাড়-কাঁপানো শীত উপেক্ষা করেও আমি রাতের বেলায় দিনের পর দিন মাঠেই (বিলে) রাত কাটাতাম। বিলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মধু ঘোষের বড় পুকুর পাড়ের পশ্চিমে দিকে ছিল আমাদের কুঁড়েঘরটি। পূর্ব পাড়ে থাকতো ‘চন্দ্র’ ও ‘বলাই’ মাঝি (জেলে) এবং তাদের দলবল। প্রতি বছর ওরা সেন ও ঘোষদের পুকুর দুটি ইজারা নিতো। পানি না কমতেই ওরা এসে পুকুরপাড়ে শক্ত ও মজবুত ঘর বানিয়ে পাহারা দিতো। রাতের বেলায় চন্দ্র মাঝিও বিলের-এদিকে ওদিকে কৈ-জাল পেতে মাছ ধরতো। সে তার ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে রাতের বেলায় জাল পেতে নৌকার উপরেই শুয়ে থাকতো। কারণ, কৈ-জাল চুরি হতো প্রায়শঃই। মাঝে-মধ্যে আমাদের সাথে দেখা হলে আমরাই প্রথমে সম্বোধন করে বলতাম
-কী কাকা! খবর কি? মাছ-টাছ পাচ্ছেন তো?
জবাবে চন্দ্র মাঝি হেসে বলতো
-পাই দুই-চারডে! তা তুমাগের খবর কি? আহারে! কী মানুষের ছাওয়াল এই শীতের রাইতে আইছে মাছ মারতি!
মন্তব্যটি যে আমাকে লক্ষ্য করে বলতো, তা বুঝলেও আমি এর কোনো জবাব দিতাম না।
পুকুর পাড়ের উত্তর দিকে একটা ছোট হিজল গাছ ছিলো। মাঝে মধ্যে ঐ গাছের উপরে বাজপাখি কিংবা শঙ্খচিল বসে থাকতো দিনের বেলায়। সারা পুকুরপাড় ভর্তি ছোট-বড় ইঁদুরের গর্ত। আর এসব গর্তের কোনো কোনোটিতে বিষধর কেউটে কিংবা গোখরো সাপের আশ্রয়স্থল। রাতের বেলায় ইঁদুরের চলাফেরা কিংবা সাপের ব্যাঙ বা ইঁদুর ধরার শব্দ শোনা যায়। এসবের মাঝেই পুকুরের পশ্চিম পাড়ে আমাদের ছোট্ট একখানা কুঁড়েঘর। জিয়ালা বড়শি পোঁতা আর কৈ-জাল পাতার জন্য দুপুরের ভাত খেয়েই আমাদের ডিঙ্গি নৌকাখানা নিয়ে রওনা হতামÑ ‘চুনচালে’ নানা আর আমি। রাত ৯-১০টার দিকে একবার এবং গভীর রাতে (২টা বা আড়াইটায়) আর একবার হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দেখতে যেতে হয় কোনে শোল-বোয়ার মাছ বড়শিতে ধরা পড়লো কিনা, কিংবা কৈ-জালে আটকা পড়ে কৈ-শিং বা মেনি মাছগুলো মরে গেলো কি না। বড়শিতে শোল-বোয়াল ধরা পড়লে তা জ্যান্ত থাকা অবস্থাতেই নৌকায় তুলে রেখে আবার নতুন করে জিয়ালা (ছোট ছোট জ্যান্ত পুঁটি ও টাকি মাছ গেঁথে দেয়া হয়) দিতে হতো।
ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ বিলের এদিকে ওদিকে গ্রামবাসীরা মিলে দল (নাড়া গুঁটিয়ে) টেনে বাঁধ দিয়ে কৈ, শিং, মাশুর, টাকি, খৈলসা-পুঁটি প্রভৃতি মাছ ধরা হতো রাতের বেলায় কুন (বাঁধের এক প্রান্তে বিশেষ এক ধরণের গর্ত খুঁড়ে তৈরি করা হয়) টেনে। ডিঙ্গি নৌকা ভরে যেতো হরেক রকম মাছে! খুব ভোর বেলায় এসব মাছ বাঁধের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হতো। এ যেনো এক মহোৎসব!
একদিন আশ্বিনের কোনো এক শুক্লপক্ষের রাতের কথা আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে। বিলের আমন ধান কাটা সবেমাত্র শেষ হয়েছে। আমি আর চুনচালে নলডাঙার বিলে বড়শি জিয়ালা দিয়েছি। প্রথম রাতে ৩/৪টা শোল মাছ ধরা পড়েছে। ওগুলোকে আমরা আমাদের খোলা ডিঙ্গি নৌকায় কিছুটা পানি জমা করে ছেড়ে রেখেছি, যাতে ওগুলো জ্যান্ত থাকে।
বাইরে নিঃশব্দ-নিঝুম অথচ জ্যোৎস্না প্লাবিত রাত। আলোচ্ছটা নিষ্প্রভ। বিলের দক্ষিণেই ধলইতলা গ্রাম। আমাদের গ্রাম ইতনা হতে ধলইতলায় যাওয়া-আসা সরাসরি বিলের মাঝখান দিয়েই। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু রাস্তাটি বিলের মাঝখানটায় এসেই শেষ। নৌকা বা ডোঙ্গা ছাড়া এপার-ওপার করা অসম্ভব। কারণ, বিলের পানি এদিক দিয়েই দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের গ্রাম খাঘা-যোগিয়ার বিল হয়ে আবার মধুমতি নদীতে গিয়েই মিশে। উল্লেখ্য যে, এখানে তখনও কোনো পাকা ব্রিজ বা সাঁকো তৈরি হয়নি।
গভীর রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের গ্রামগুলো থেকে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া ডাক শোনা যাচ্ছিলো। দ্বিতীয় দফায় জিয়ালার বড়শিগুলো দেখবার জন্য চুনচালে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। বললো
-নানা। ও নানা? উঠে যাও, আদার (বড়শিতে জ্যান্ত পুঁটি বা টাকি মাছ গেঁথে পানিতে ছেড়ে দিতে হয়) দিতি যাবা না?
নানার ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। পুকুর পাড়ে বাঁধা ডিঙ্গি নৌকায় উঠলাম দু’জনে। নৌকার এক প্রান্তে বসে আমি লগি/বৈঠা নিয়ে চালকের আসনে। অপর প্রান্তে চুনচালে নানা আধারের হাড়ি/মাঠি নিয়ে জিয়ালা বড়শিতে ধরা পড়া শোল-বোয়াল মাছগুলোকে নৌকাতে উঠাতে প্রস্তুত। সম্ভবত ঐ রাতটি ছিলো পূর্ণিমার জ্যোৎস্না প্লাবিত তিথির। কিন্তু আলোটা কিছুটা ম্রিয়মান। দু-চারটে বড়শি দেখা শেষ হতেই চুনচালে আমাকে নিচু স্বরে ফিস ফিস করে বললো
-নানা! দাঁড়াও, নৌকা বাইয়ো না! তুমি কি শুনতি পাচ্ছো?
আমি নৌকা থামিয়ে কান পাতলাম। দূরে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে (যেখানে ইতনা ও ধলাইতলা গ্রামের মধ্যে কোনো সংযোগ ব্রিজ বা সাঁকো নেই) দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঝুঁপ-ঝাঁপ শব্দ করে কী যেনো একটা পাড় হয়ে যাচ্ছে! এত রাতে কোনো মানুষ নিশ্চয়ই নয়Ñ শেয়াল-কুকুর হলেও এরূপ ঝুঁপ-ঝাঁপ শব্দ হবার কথা নয়! আমরা দু’জনই নির্জন আলো ঝলমল করা রাতে নিশ্চুপ হয়ে আছি। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আল্লাহ্র নাম নিচ্ছি আর সুরা পড়ছি। পনেরো-বিশ মিনিট ধরে শব্দটি শোনা গেলো। পরে হঠাৎ করেই যেনো একটা দমকা হাওয়া উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে বয়ে যেতে লাগলো। হিজল গাছ থেকে বাজ পাখিটা উড়ে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে উত্তর দিকে গেলো। চুনচজালে নানার গলার স্বর আরো নিচু, ভীত ও কম্পিত বলে মনে হলো। যখন সে বললো
-চলো নানা! আদার দিয়ে কাম নাই! আমরা কুঁড়েতে ফিরে যাই।
তার কথায় আস্তে আস্তে লগি ঠেলে নৌকাখানা এনে পুকুর পাড়ে ঠেকালাম। চুনচালেকে জিজ্ঞেস করলাম-
-কয়ডা শোইল পাইছো, নানা?
মুখে কোনো জবাব না দিয়ে চুনচালে শুধু বললো
-বিহাল বেলায় দেখা যাবে নে! চলো, শুয়ে পাড়ি।
ঐ রাতে যথাযথভাবে ঘুম ভাঙলো সূর্যোদয়ের অনেক আগে। সকাল নানা হতেই জিয়ালা দেয়া বড়শিগুলো পরীক্ষা করে ৪-৫টা শোল মাছ পাওয়া গেলো। ভাগাভাগির সময়ে চুনচালে বললো
-নানা! কাইল রাইতের বেলা দমকা বাতাসডা উঠার সময় নৌকাডা একবার দুলি উঠিছিল মনে আছে?
উত্তরে আমি বললাম
-হ্যাঁ, মনে থাকবে না ক্যান? তহন দপ্ কইরে আমাগের হ্যারিকেনটাও নিভে গেছিলো!
-হ নানা! তহন আমাগের এটা একটা শোইল মাছও নিয়ে গেছে!
শুনে আমি বিঘ্নিত সুরে বললাম
-বলো কি নানা? নৌকার থেহে (থেকে) তাজা মাছ কিভাবে নিয়ে যাবে?
উত্তরে চুনচারে বললো
-না, নানা! পেত্থম রাত্তিরি এট্টা (একটা) মরা শোইল আর তিনডা জ্যান্ত শোইল আমি নিজির হাতে তুলিছিলাম।
এ কথা শুনে আমার বুকের ভিতরে কেমন যেনো একটা হিমশীতল ভাব অনুভব করতে লাগলাম। কিন্তু এ ঘটনার সঠিক কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা কারণ আজও আমার কাছে মেলেনি। পাঠকরা কেউ বলবেন কি?