কোটা আন্দোলন, আবেগ ও পরিণাম

আকস্মিক এক ঝড়ে এলেমেলো অবস্থা হয়েছিলো বাংলাদেশে। কাল বেশাখী ঝড় যেমন, অনেকটা তেমনি। তবে ঝড়টি প্রাকৃতিক নয়, রাজনৈতিক। কেউ বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ঝড়টি সামাল দিয়েছেন, যেভাবে গত ৯ বছর ধরে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আন্দোলন সবচেয়ে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। কারো কারো মন্তব্য- কোটা নিয়ে ছাত্র সমাজের যে আন্দোলন, প্রধানমন্ত্রী সে আন্দোলনকে সামাল দিলেও তা সাময়িক। স্থায়ী সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
যারা প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে সাময়িক বলে মনে করছেন, তাদের যুক্তি : ছাত্ররা চাকরিক্ষেত্রে ৫৬ ভাগ কোটা আর ৪৪ ভাগ মেধার যে ব্যবস্থাকে বৈষম্য বিবেচনা করে তার সংস্কার চেয়েছিলেন, কোটার বিলুপ্তি দাবি করেননি। প্রধানমন্ত্রী মাথা ব্যথার চিকিৎসা না করে মাথাটাই কেটে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার মতো, সংস্কার না করে, একেবারে কোটার বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে ঘোষণার পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুচিন্তা এবং যুক্তি কতোখানি কাজ করেছে, আর রাগ, অভিমান এবং ক্ষোভ কতোটা কাজ করেছে- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে, তৃতীয় আরেকটি পক্ষ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা রকমের একটা প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করছেন। তারা বলতে চাচ্ছেন আন্দোলনটা কি আদৌ ছাত্রদের মস্তিষ্ক-প্রসূত, নাকি অন্য কোন শক্তির নির্দেশনা প্রসূত! তাদের যুক্তি হচ্ছে- ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের বছর। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনেকেই নানাভাবে এ বছর পানি ঘোলা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাইবেন। সেক্ষেত্রে ছাত্র আন্দোলনটি সরকারি কিংবা বিরোধী উভয় পক্ষেরই কাজ হতে পারে।
কাজ যে পক্ষেরই হোক, সাময়িকভাবে হলেও আন্দোলনটি আপাতত প্রশমিত হওয়ায় দেশ একটি সাক্ষাৎ ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। স্থায়ী সমাধান অবশ্যই নির্ভর করবে সরকারের সংযম, প্রজ্ঞা এবং প্রশাসনিক আন্তরিকতার উপর। বিরোধী দলকেও প্রজ্ঞা প্রদর্শন করতে হবে। শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার আকাক্সক্ষায় ছাত্র সমাজকে উস্কানী দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়ার চেষ্টা না করাই হবে উত্তম। বাংলাদেশের রেকর্ড অবশ্য এক্ষেত্রে খুব উজ্জ্বল নয়। ক্ষমতার জন্য ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী- উভয় পক্ষেই জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়ার নজীর অতীতে আছে। তাই মানুষ যদি এ নিয়ে কোন সন্দেহ করে থাকে, তাকে অন্যায় বা অসংগত ভাবা যায় না।
কোটা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন এভাবে হঠাৎই পেকে ওঠা এবং একে কেন্দ্র করে অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনা ঘটে যাওয়া নিয়ে বহুরকমের কথাবার্তাই হচ্ছে। সেসব নিয়ে কথা বলার আগে কোটা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে দুটি কথা বলা দরকার। ‘ছাত্র আন্দোলনে উত্তপ্ত রাজনীতি’ শিরোনামে ঠিকানার ১৩ এপ্রিল সংখ্যায় যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে সেখানে বলা হয় যে, চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলনে নামে ৮ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার শাহবাগে। শাহবাগ এখন গণজাগরণ মঞ্চের কল্যাণে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ছাত্রদের সেই যৌক্তিক অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে কেউ কেউ হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। শাহবাগে ছাত্র জমায়েতে ছাত্রলীগ-পুলিশ যৌথ হামলার পর আন্দোলনের আগুন বাংলাদেশের সব উচ্চতর বিদ্যাপিঠেও ছড়িয়ে পড়ে। সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতায় বসেন। ৭ মে পর্যন্ত সময় দিয়ে সংস্কারের দাবি বিবেচনার আশ্বাস পেয়ে সমঝোতা বৈঠকে যোগদানকারী ছাত্র নেতারা তা মেনে নিলেও আন্দোলনকারী অন্য ছাত্ররা তা মেনে না নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে সরাসরি আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে ছাত্রদের এই আন্দোলনকে ঘিরে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। ছাত্ররা আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক দাবি করলেও এবং তাদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং মুখে জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান শোভা পেলেও তাদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশ যৌথভাবে বর্বর হামলা চালায়। জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করেন এবং এর পেছনে জামায়াত-শিবির ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন। মতিয়া চৌধুরীর বিষোদগার আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। মতিয়া চৌধুরীর এই বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক সুধীজনেরও ধিক্কার কুড়ায়।
অন্যদিকে ৮ এপ্রিল গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে কে বা কারা হামলা করে ভাংচুর চালায়। ১০ এপ্রিল সুফিয়া কামাল ছাত্রী-আবাসে কোটা সংস্কারের পক্ষের ছাত্রীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেত্রীরা। অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, তারা মোর্শেদা নামের এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। এ কারণে ঐ হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইশরাত জাহান এষাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করার কথাও জানা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক নূরুল হক দাবি করেছেন, আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। তবে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনটি সম্পূর্ণই অরাজনৈতিক। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, তাই তার ছবি বহন রাজনৈতিক বলে মনে করা যায় না। অবশ্য এতে একটা বিষয় খুব সহজেই প্রমাণিত হয় যে, আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেও তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নয়। ভিসির বাসভবনে হামলা নিয়েও অনেকের অনেক প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে। গভীর রাতে কতক্ষণ ধরে ভাংচুর চলার পরও হামলাকারীদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি কেনো? ভিসির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা কোথায় ছিলো? এখন অনেকেই সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির প্রতি ইঙ্গিত করছেন। তবে কি কেবল দোষারোপ করে কিংবা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে জেলে ভরে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করাই উদ্দেশ্য? এসব বিষয় অবশ্যই মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি করে। তখন সরকারি মহল থেকে যে মন্তব্য এবং যে ব্যাখ্যাই দেয়া হোক, তাতে মানুষের মনের সন্দেহ দূর হয় না। কথায় আছেÑ ‘বনের বাঘে যত না খায়, মনের বাঘে তার বেশি খায়।’
তবে ছাত্র আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধ হোক, অথবা স্থায়ীভাবে হোক- সেটা যতোটা না উদ্বেগের, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেগের ছাত্রলীগের তা-ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারেরও অভিভাবক, আবার ছাত্রলীগেরও অভিভাবক। তিনি সরকারের অভিভাবক হিসেব যতোটা সমস্যা সমাধান এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হচ্ছেন, ছাত্রলীগের অভিভাবক হিসেবে দেশের মানুষ সেই সাফল্য দেখতে পাচ্ছে না। এ কি তার ব্যর্থতা, নাকি ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান না? শেখ হাসিনা কিংবা সরকার ছাত্রলীগকে ‘আপদ’ ভাবে না ‘সম্পদ’ ভাবে পাবলিক তা বুঝতে পারছে না। তবে জনগণ ছাত্রলীগকে শুধু আপদ ভাবে না, ভয়ঙ্কর আপদ ভাবে। প্রশাসন, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী গোষ্ঠী সকলের জন্যই ছাত্রলীগ এখন মাথাব্যথার কারণ। অথচ এই ছাত্রলীগ এক সময় ছিলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের ভূমিকা এবং অবদান অবিস্মরণীয়। সেই ছাত্রলীগের আজ যে অবস্থান এবং আচরণ, তা কাউকে আশাবাদী বা অনুপ্রাণিত করে না। উল্টো মানুষ ভীত এবং হতাশ ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডে।
আমরা মনে করি না মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাগ, ক্ষোভ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কথা বলবেন। আর এ কথা কোন পক্ষেরই ভেবে নেয়া উচিত হবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের কাছে কোন দাবি জানানোর অর্থই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনা। তবে কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির উত্তর-প্রজন্মের কেউই মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে না, অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না? যদি তাই হয়, তবে সে ব্যর্থতা কার? মতিয়া চৌধুরীর, সরকারের, নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই। আসলে সবারই কথাবার্তায়, চিন্তা-চেতনায় সতর্ক হওয়া জরুরি। অতিরিক্ত আবেগ বা আত্মবিশ্বাস- কোনটারই পরিণাম ভালো হয় না।
শেষ কথা ছোট গল্পের মতই বলতে হবে-‘শেষ হয়েও কি শেষ হবে কোটা বিরোধী আন্দোলনের? রাজনীতির খেলা, প্রশাসনিক জটিলতা, সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতা-কত কিছুর মিমাংসা প্রয়োজন হবে। সেসব সহজেই সমাধানের পথ খুঁজে পাবে, সেটাই আশা করি। না পেলে?