কোটা ও অ-মুক্তিযোদ্ধাদের বাণিজ্য!

সারওয়ার-উল-ইসলাম

কোটা নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়। ঢাকা শহর অচল। রাস্তায় যানজট। জনগণের ভোগান্তি চরমে। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না অনেকেরই।
শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা -কোটাই থাকবে না।
এখন আবার মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের দাবি- কোটা রাখতে হবে তাদের জন্য।
কী যন্ত্রণায় পড়লেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা!
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের জন্য কোটা রাখা দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা এই যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এত দরদ দেখাচ্ছেন, তারা কি জানেন, প্রান্তিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধারা আদৌ সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন কি না? বা তাদের জন্য সরকার যে সুবিধা দিচ্ছেন, তা সম্পর্কে আবগত আছেন কি না সেই মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানেরা?
বিভিন্ন সময়ে পত্রিকা মারফত জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংস্থা রয়েছে, তার ভেতরকার দুর্নীতির খবর। সেসব খবর নিয়ে খুব একটা সোচ্চার হতে কাউকে দেখা যায়নি। এর কারণ কী?
তা হলে কি মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিছুসংখ্যক সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা জানবে? তারাই ভোগ করবে? কিংবা তাদের জন্য সরকার কত কিছু করছে, কত সুযোগ দিচ্ছে, তা কি শুধু শহুরে মুক্তিযোদ্ধারাই পাবেন?
যে মুক্তিযোদ্ধা অজপাড়াগাঁয়ে বাস করেন, তার খবর কি শহুরে সুবিধাভোগকারী মুক্তিযোদ্ধারা কখনো নিয়েছেন? শহরের দালানকোঠার ভেতরে থাকা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নতুন করে যাচাই-বাছাইকারীরা সেই দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার অসচ্ছলতার কথা কখনো জানার প্রয়োজন অনুভব করেন না। কারণ তারা ব্যস্ত নিজের আখের গোছানোতে। কেউ কেউ আবার ব্যস্ত থাকেন নতুন করে কিছু লোককে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকিয়ে টু-পাইস কামাতে।
প্রত্যেক সরকারের আমলেই নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার প্রয়োজন পড়ে কেন? স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও কি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম হচ্ছে? অনেককেই ইদানীং বলতে শুনি, দেশে এখন চাকরি-বাকরির পরে রাজনীতি হচ্ছে প্রধান পেশা। রাজনীতি করলে প্রচুর টাকা-পয়সা কামানো যায়। আর নতুন করে যোগ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। কোনোমতে এদিক-সেদিক করে যদি একটা সনদ পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধার, তা হলে আর তাকে কে পায়? (বিনয়ের সঙ্গে বলি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম, তারা কখনো ওই কাগুজে সনদের কাঙাল নন। যাদের ভেতর দুই নম্বরি আছে, তারাই ওটা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করে থাকেন।)
মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে জায়গা দখল থেকে শুরু করে সরকারি অফিস-আদালতে নানা রকম সুবিধার জন্য দৌড়াতে থাকেন তারা। ভাবখানা এ রকম যে, এ ধরনের বাড়তি সুবিধা তাদের প্রাপ্য। তাদের আচরণের কারণে কখনো কখনো এটা যে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়, এটা বোঝার মতো জ্ঞান তাদের নেই। তাদের আচরণ দেখে অনেকেই তখন করুণা করেই অনেক কাজ করে দেন। এটা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কতটা নিচু মানসিকতার পরিচয়, এটা তারা বোঝেন না।
কিছু প্রভাবশালী লোক আছেন, সরকারের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দোহাই দিয়ে নানা রকমের ফান্ড গঠন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হ্যান করবে, ত্যান করবে—এ রকম নানা ফিরিস্তি দিয়ে একসময় পুরো তহবিল তছরুপ করতেও ভুল করেন না।
সবচেয়ে অবাক লাগে, শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় খালি জায়গা পেলেই কিংবা ডোবা-পুকুর পেলে মাটি ভরাট করে বা সিটি করপোরেশেনের ময়লা গাড়ি থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলে ভরাট করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়- মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্প। পাড়ার মাতবর শ্রেণির মানুষ সেখানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু একটা করছে এমন ভাব নিয়ে কাজ শুরু করে। জায়গাটি পাওয়ার জন্য স্থানীয় সাংসদ থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের নিয়ে গৃহায়ণ থেকে শুরু করে নানা ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বোঝানো হয়, সামনে নির্বাচনে ভোট লাগবে। পাঁচ হাজার ভোট আছে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের। সুতরাং কাগজপত্র দ্রুত করে দিতে হবে।
অবশেষে জায়গাটি হালাল হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি। লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি থাকে। যার জোর যত বেশি, সে টিকে থাকে নাটকের শেষ পর্যন্ত। এই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অ-মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবসা। সারা দেশেই চলছে এই রমরমা ব্যবসা।
এই ব্যবসা চলবে কত দিন?

লেখক : সাংবাদিক