কোরবানি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, ইতিহাসেরও অংশ

এস এম মোজাম্মেল হক

‘বিশ্বাস’ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ trust বা faith, যার মর্মার্থ আস্থা বা সত্য বলে মেনে নেওয়া। তবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনো কিছুকে সত্য বলে ধারণা করা বা মেনে নেওয়ার অর্থ এই নয় যে সবার নিকটই সেটি নির্দ্বিধায় সত্য বলে প্রতিপন্ন হবে বা আদতেই সেটি প্রকৃত সত্য। সত্যের প্রকারভেদ যথাক্রমে চিরন্তন সত্য, পরীক্ষিত সত্য এবং প্রচলিত সত্য। প্রচলিত সত্য হলো অনেকের নিকট সত্য বলে বিবেচিত, যা তাদের নিকট দীর্ঘদিন যাবৎ সত্য হিসেবে প্রতিপালিত হয়ে আসছে অথচ কখনো তার সত্যতা যাচাই করে দেখা হয়নি। কোরবানি পরীক্ষিত সত্যের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। কোরবানি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচ্য নয়, বরং কোরবানির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। আল্লাহর তরফ থেকে হজরত ইবরাহিম (আ.) কে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জনকে কোরবানি করার নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি তা সন্তুষ্টচিত্তে পালন করেন। এর মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির যে গভীর সম্পর্ক এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গ যে স্রষ্টার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ও স্রষ্টার নির্দেশ পালনে দৃঢ়সংকল্প, কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে তা প্রমাণ করে বাকি সবার নিকট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ থেকে এটাও স্পষ্ট যে বিশ্বস্ত ব্যক্তি সব সময় তার বিশ্বস্ততার প্রতিদান পেয়ে থাকেন। কোরবানির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকুলকে সেই কঠিন বার্তাটিই পৌঁছে দিয়েছেন। এতৎসত্ত্বেও হীন স্বার্থের কারণে অনেকে অসত্যকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সদা সচেষ্ট। এ জন্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করে প্রচার-প্রপাগান্ডা অব্যাহত রাখে এবং একসময় তারা নিজেদের সফল বলে মনে করলেও অন্যের নিকট তাদের সফলতা ব্যর্থতারই প্রতিরূপ বলে বিবেচিত।

যে শিক্ষা মানুষকে পরমতসহিষ্ণুতায় উদ্বুদ্ধ করে না, যে বিদ্যার ব্যাপ্তি সাগর-মহাসাগর পরিমাণ হলেও বিদ্বান ব্যক্তিকে কেবল অহংকারী বানায়, অঢেল অর্থের মালিকানাও যদি দরিদ্রদের দারিদ্র্য মোচনে ভূমিকা না রাখে এবং বিশ্বাস যদি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণে অন্তরায় সৃষ্টি করে, তবে এসবের প্রাচুর্য নিরর্থক বৈকি! আশা ও হতাশার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য, তা শুধু প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিষয় নয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে অতি চাকচিক্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ অর্থাৎ সবকিছুতে ভরপুর অথচ অন্তরালে হতাশায় পরিপূর্ণ এমন দৃশ্য যেমন আছে, পক্ষান্তরে নিস্ব, রিক্ত অথচ আত্মতৃপ্তিতে পরিপূর্ণ এমন বাস্তবতাও নেহাত কম নয়। সবকিছু নির্ভর করে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত অনুভূতির ওপর, যা বাহ্যিকভাবে অন্যের পক্ষে সব সময় অনুভব করা আদৌ সম্ভব নয়। অথচ নিজস্ব ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকে এমন সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যা গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। এসব কারণেই সমাজে এমন সব অদ্ভুত ও অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা থেকে উত্তরণ অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অলঙ্ঘনীয়। যেসব গুণাগুণ দিয়ে সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে, তার দুটি দিক যথাক্রমে ইতিবাচক ও নেতিবাচক। তবে ইতিবাচক দিকের প্রতিই স্রষ্টার তরফ থেকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হলেও সৃষ্টির ঝোঁক থাকে নেতিবাচক দিকের প্রতি। কারণ আকর্ষণের দিক থেকে নেতিবাচক দিকের চাকচিক্য অনেক বেশি। তাই খারাপ কাজের প্রতি আকৃষ্ট হতে তেমন কোনো চেষ্টার প্রয়োজন হয় না অথচ ভালো কাজের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং প্রতিনিয়ত তার চর্চা অব্যাহত রেখেও যথাযথ পথে অগ্রসর হওয়া অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর তরফ থেকে কখনো নিঃশেষিত হয় না বরং সৃষ্টি যখন স্রষ্টার অবদান ও তাঁর তরফ থেকে প্রাপ্ত সকল অবদান অস্বীকার করে প্রাপ্ত সবকিছুকে নিজের অর্জন হিসেবে বদ্ধমূল ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজ ইচ্ছায় সবকিছু পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে, স্বভাবতই তখন তার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা লঘু করা হলে অবশ্যই নিয়ন্ত্রকের ওপর তার দায়ভার বর্তায় না। তাই সৃষ্টির খারাপ কাজ বা আচরণের জন্য সৃষ্টিকেই দোষারোপ করা হয়। সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি অবাধ্যদের প্রায় সবাই অত্যন্ত ক্ষমতাধর, মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত এবং সমসাময়িক সমাজের অভিজাত শ্রেণিভুক্ত; যদিও এ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পূর্বে তাদের আচার-আচরণ, অহংবোধ ইত্যাদির পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাধারণ অবস্থায় তাদের সবকিছুই সাধারণ পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও যখনই উন্নত পর্যায়ে তাদের পরিবর্তন হয়, তখনই তারা সে পরিবর্তনকে নিজের অর্জিত সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। তাদের আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয় এবং তারা ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করে, যা পতনের সূচনাপর্ব হিসেবে পরিলক্ষিত।
ইতিহাস সত্য ঘটনাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জানার, বোঝার ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক পথে চলার নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ করার জন্য রচিত হলেও এবং এমন হাজারো উদাহরণ ইতিহাসে উদ্ধৃত থাকা সত্ত্বেও তা থেকে যারা শিক্ষা নেয় না বরং পশ্চাতে ঘটে যাওয়া সেসব ঘটনাকে তারা ভুক্তভোগীদের বোকামির খেসারত হিসেবে মনে করে নিজেরা অধিকতর সাবধানতা অবলম্বন করে, যা তাদেরকে অধিকতর ভুলের মধ্যে নিপতিত করে তাদের প্রাপ্য ফলাফল ত্বরান্বিত করে। অবশ্য এ জন্য তারা নিজেদের মোটেই দায়ী ভাবে না এবং এ জন্য তাদের মোটেও অনুশোচনা হয় না। বরং তাদের পরিণতির জন্য অন্যকে দায়ী করে থাকে। ইতিহাসকে মনুষ্যরচিত পূর্বের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিক বর্ণনা হিসেবে মনে করা হলেও ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যরচিত গ্রন্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তার বাইরেও এর ব্যাপ্তি রয়েছে। প্রতিটা ঐশীগ্রন্থ ধর্মীয় পাঠের বাইরে ইতিহাসেরও একটি অনেক বড় পাঠ বৈকি! পূর্বের অনেক ঘটনাপ্রবাহ ঐশীগ্রন্থসমূহে ইতিহাসরূপে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে ওইসব ঘটনা থেকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করে মিথ্যাকে বর্জন এবং সত্যকে গ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলা যায়। এর আরও একটি উদ্দেশ্য হতে পারে এই যে ইতিহাস হবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রকৃত সত্য যাতে স্থান পায়, তা নিশ্চিত করার শিক্ষা প্রদান করা। কিন্তু এত কিছুর পরও প্রশ্ন রয়ে যায়, ইতিহাস থেকে যাদের শিক্ষা নেওয়ার কথা, তারা সে শিক্ষা নেয় কি না? সে কারণেই হয়তো প্রবাদে পরিণত হয়েছেÑইতিহাস এটাই, যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। মানবকল্যাণে ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে লাগানোর জন্য এই ধ্যানধারণার পরিবর্তন অতীব জরুরি।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।

কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক