ক্যান্সারের সাথে আমি: একদিনের ডায়েরি

মুনিয়া মাহমুদ

ফাবে আইয়ে আলা ই-রাব্বে কুমা তুকাজজিবান (আল্লাহর কোন নিয়ামতকে তোমরা অস্বীকার করবে?)। মিসরা রশীদের তেলাওতে সূরা আর- রাহমান মিনাপার (আমার বড় বোন) ভীষণ প্রিয় এক সূরা। বাসায় তিনি প্রতিদিন এই সূরা এবং সূরা ইয়াসীন শুনতেন। হাসপাতালে আমি কম্পিউটার বা ফোন থেকে সূরা লাগিয়ে দেই। মিনাপা মনোযোগ দিয়ে শুনেন। এই সূরাগুলো শুনে আমিও কেমন জানি মনে একটা শান্তি পাই।
ভোর থেকে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। ফ্লোরিডার বৃষ্টি যারা দেখেছে তারা জানে কি প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি পড়ে! সামনের গাড়ির লাইট পর্যন্ত দেখা যায় না।
স্যান্ডস ক্যান্সার হাসপাতালের আট তলার কেবিনের বিরাট জানালা দিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছি। মিনাপা এখন ঘুমাচ্ছে। একটু আগে ১০ এমজি লিকুইড অক্সিকোডন দেওয়া হয়েছে। ক’দিন হলো মরফিন বন্ধ। তাঁর নিজ থেকে বিছানা থেকে উঠার জন্য ঘুমের ও ব্যথার ওষুধ ডাক্তার কমিয়ে দিয়েছে। সার্জারীর পর মিনাপার মেমোরি লস হয়েছিল। গত তিন দিন থেকে তাঁর মেমোরি ধীরে ধীরে ফিরছে। আজ মনে হলো ৭০ পারসেন্ট ফিরেছে। আমার ক’দিন ধরে কাশি। কাশি শুনে চোখ খুলে মিনাপা বললেন, আদা-চা খাবি? বানিয়ে নিয়ে আসি?
গত ১১ মে শুক্রবার দুপুরে মিনাপার কলোসটমি সার্জারী করা হয়েছে। এই সার্জারীতে কোলনের পথ বাইরে করে একটা ব্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। মল সেখানে জমা হয়। ব্যাগটা দুদিন পর পর বদলাতে হয়। আমার কেন জানি মনে হয় এই কলোসটমি সার্জারী তিন মাস আগে করলে মিনাপার কষ্ট অনেক কম হতো। দিনে ২০-৩০ বার বাথরুমে যেতেন কিন্তু কিছুই হতো না। ব্যথায় ব্যথায় সারাদিন কষ্ট পেতেন। হাই পাওয়ার মরফিনে কোনো কাজ হতো না। তখন ইমারজেন্সিতে যেতে হতো।
তিনি গত আড়াই বছর ধরে ফোর্থ স্টেজ ওভারিয়ান ক্যান্সারে ভুগছেন। অনেক কেমো দেওয়া হয়েছে। এখন মিনাপা যদি শারীরিকভাবে সুস্থ হতে পারেন, তাহলে ডাক্তার বলেছে তারা আবার কেমোর কথা চিন্তা করবে।
গতরাতে মিনাপার মেয়ে বাগ্গী রাত এগারটায় হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছে। এসেই কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে। মিনাপার রুম খা খা করছে। সেখানে কেউ শোয় না। সকাল সাড়ে আটটায় উঠে ছোটবোন বেলীকে জাগালাম। সে অবশ্য আগে উঠে মুখ ধুয়ে শুয়ে ছিল। আমি ওষুধ খেয়ে এবং ইনসুলিন লাগিয়ে নাস্তা খেয়ে রওনা হলাম। বাগ্গী কিছু খায় না। হাসপাতালের কেন্টিন থেকে খেয়ে নিবে। বড় এসইউভি গাড়িটা বাগ্গী চালায়। স্যান্ডস ক্যানসার হাসপাতালে যেতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে। মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য বানানো এই হাসপাতাল পাঁচতারা হোটেলের চেয়ে কম না। ঢুকলেই বাম দিকে বিশাল রিসেপশন, ডানদিকে স্মোক সেন্টার এবং সোজা এলিভেটর। এলিভেটর থেকে বের হলেই মনে হবে কোথায় এলাম! বিশাল বিশাল কাঁচের দেয়াল। কোনো কক্রিটের দেয়াল নাই। লম্বা করিডোরে কয়েকটা পার্টিশান করা ৩ বা ২ টা করে সোফা বসানো আছে। মেহমানদের জন্য আলাদা কফিবার আছে। বসার আলাদা রুম আছে। আমরা আছি সাউথ টাওয়ারে। জেনারেল নর্থ টাওয়ারে সুবিধা এখান থেকে অনেক কম। আফ্রিকান-আমেরিকান মোটা মোটা নার্সের পিসিএ (এসিসটেন্ট) গুলো বড়ই বেতমিজ।
১৫-২০ মিনিটের মধ্যে মিনাপার ৮২৩৮ নং কেবিনে পৌঁছে রানাভাইকে (মিনাপার স্বামী) ডিউটি থেকে বিদায় দিলাম। তিনি গত রাতে একা ছিলেন তবে তিনি ঘুমাতে পেরেছেন কারণ মিনাপা ঘুমিয়েছে। আমরা এসে দেখি মিনাপা ভালো মুডে আছে। আমাদের সবার সাথে অনেক কথা বললেন। ফোনে নুরুদ্দিন (আমার স্বামী) ও নান্টুর (সাথে কথা বললেন। বেলীর সাথেও কথা বললেন। ব্রেকফাস্টে আজ ৪টা পেনকেক, স্ক্রাম্বল ডিম ও জুস দিয়েছে। এগুলোর কিছুই মিনাপা খাননি। শুধু আমাকে বললেন কফি খাবেন। দু চামচ কফি খেয়ে বলেন আর খাবে না। মিনাপা রানাভাইকে নাকি বলেছে ডাল, ভাত খাবে। রানাভাই রান্না করে নিয়ে আসবে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন মিনাপা যা খেতে চায় দিও।
১১টার সময় মিনাপা বললেন পেসাব করবেন। নিজে নিজে চেষ্টা করে উঠে বসলেন। নার্সকে ডাকলাম কারণ যদি পড়ে যায়। বেশ কষ্ট করে চেয়ার কমোডে বসলেন। অভ্যাস মতো মিনাপা বাথরুমে যেতে চেয়েছিলেন।
একটু পরে আমি চিকেন ও বীফ স্যুপ প্যান্ট্রি থেকে বানিয়ে এনে ১০ চামচের মতো জোর করে খাওয়ালাম। ঘুম থেকে উঠলে আবারো খাওয়াবো। এখন একটা বাজে। দেড়টার দিকে উঠবে পেসাব করার জন্য। আজকে নার্সকে বলে দুটো মাথার টুপি নিয়েছি। টুপির কথা আগে কেন মনে হলো না, বুঝলাম না। কারণ মাঝে মাঝে এসি বেশি ঠান্ডা হলে মিনাপার মাথায় ঠান্ডা লাগে।
আজকে অনেক কথার মধ্যে শাওনের কথা বলল। আমি অবাক হয়ে শুনলাম। বলছিল, হুমায়ূন আহমেদ বলেছিল কলোসটমি করবে না। গু বাইরে নিয়ে ঘুরবে না। বলে সুন্দর হাসি দিলেন। মিনাপাকে মনে হচ্ছে আগের মতোন। অনেক কথা বলছেন। চেহারা বানাচ্ছেন। দুষ্টামি করছেন।
একটু পরে মিনাপা ঘুমিয়ে গেলেন। তবে কিছুক্ষণ পর পর চোখ খুলে আমাকে দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ২৩ তারিখে আমার নিউ ইয়র্ক যাওয়ার কথা। বাগ্গী ভয় পাচ্ছে। আমি ওকে বলেছি আমি ভালো নার্সিং হোমে ট্রান্সফার করে তারপর নিউ ইয়র্ক যাবো। নিউ ইয়র্ক যাওয়া আমার খুব দরকার। সেখানে অনেক কাজ জমে আছে। এদিকে আয়ানের অ্যাজমা। অ্যাজমার জন্য এই সময়টা খারাপ। আমি জানি আমি বেশিদিন নিউ ইয়র্কে থাকতে পারবো না।
১২টার দিকে বাগ্গী ও বেলী গেল ওয়ালমার্টে। বাগ্গীর কিছু জিনিস কেনা দরকার। এখানে রানাভাই ও বাগ্গী ছাড়া কেউ নাই হাসপাতাল ডিওটি করার। গত দশদিন ধরে আমি আছি। বড় ভাই সেন্টু লস এঞ্জেলস্ থেকে এসে তিন দিন ছিল। ও সারাক্ষণই বলতে গেলে হাসপাতালে ছিল। পিসিএ’র সাথে আমার একবার রাগারাগি হওয়াতে ওর বকা খেয়েছি। কাল্লু পিসিএ গুলো কথা শুনে না। তখন আমরা নর্থ টাওয়ারে ছিলাম ২ দিন। আমি ঠিক থাকবো কি করে! ক্যান্সার প্যাশেন্টের সাথে থাকতে থাকতে আমারও মনের ক্যান্সার হয়ে গেছে। সহজ জিনিস আর সহজ মনে হয় না। সবকিছু মনে হয় জটিল। যাই হোক, সেন্টু থাকার সময় মেন্টালি আমি বেশ রিলাক্সড্ ছিলাম।
মিনাকে দেখে দেড়টার সময় মিনাপাকে পেশাব করালাম। নার্সরা মনে হয় ব্যস্ত। জর্ডন নামের ১৯ বছরের সাদা ছেলে এসে সাহায্য করলো। কলেজে পড়ে ও কাজ করে। তাকে বলে আমার কয়েকটা ছবি তুললাম মিনাপার সাথে। বাগ্গী থাকলে আমরা কেউ ছবি তুলতে পারি না কারণ বাগ্গীর সুপারস্টেসন আছে যে ছবি তুললে মিনাপার অবস্থা খারাপ হবে। রানাভাইতো বাগ্গীকে ভীষণ ভয় পায়।
নান্টু (আমার ছোট ভাই) নিউ ইয়র্ক থেকে এখানে আসার পর বুঝতে পারলাম রোজার মাস চলছে। আমাদের তো রাতদিন এক হয়ে গেছে। সে এখানকার মসজিদে ইফতারি করতে যেত আবার খাবার নিয়ে আসতো। সে ছিল তিনদিন। গতকাল নিউ ইয়র্কে ফিরেছে। নান্টু যতদিন ছিল, মিনাপা অনেক খুশি ছিল।
মিনাপা কখন যে কি বলে ঠিক নাই। কখনও উর্দুতে কথা বলে। আজান ছোটবেলায় কি সুন্দর ছিল। তারপর হঠাৎ করে বলে, মেলী কোথায় গেল? আমি বললাম, বাগ্গী? তখন বলে হ্যা, বাগ্গী। তারপর বললেন, বলছিলাম কি, সেন্টু.. বলে কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বললেন, সেন্টু শুকিয়ে একদম ছোট হয়ে গেছে।
নার্স কেলি ও পিসিএ এন্ড্রিয়ানা খুব যত্ন করে মিনাপাকে স্পঞ্জ বাথ করিয়ে দিয়েছে। এন্ড্রিয়ানা মেয়েটার বয়স মাত্র ২০ বছর। কালো কিন্তু ভীষণ সুইট চেহারা মেয়েটার। রানাভাই দুপুর তিনটার দিকে ভাত ডাল তরকারী নিয়ে আসে । মিনাপা এক চামচও খায় না। আমি লাল চা বানিয়ে এনেছিলাম। ওখান থেকে দুই চামচ মিনাপা খায়।
আজ মিনাপা কিছুক্ষণ পরপর বলছে বাসায় যাবো। জিনিসপত্র সব গাড়িতে তোলো। তাঁর গলার স্বর ফ্যাসফ্যাসা হয়ে গেছে। নিজেই বলছে, আমি কথা বলতে পারছি না। আমি যখন বললাম, বেবী আসবে তখন মিনাপা বলেন, মার পাছায় লাত্তি। তবে কখনও কখনও বেবীর কথা শুনলে ভীষণ খুশি হয় কারণ বোনদের মধ্যে এই বোনকে সে ভীষণ ভালোবাসে। আর ভাইদের মধ্যে পাত্তু ও সেন্টুকে। আর আমার উপর তার ভালোবাসার থেকে ভরসা বেশি। নান্টুর ক্ষেত্রেও তাই।
কাল নার্সিং হোম থেকে লোক আসবে। আমি যাবো নার্সিং হোম দেখতে। এখন হাসপাতালে কোনো ক্যান্সারের চিকিৎসা হচ্ছে না। হচ্ছে শুধু পেইন ম্যানেজমেন্ট আর এন্টিবায়োটিক দিচ্ছে। আমাদের দু-একদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দিবে।
গত আড়াই বছর ধরে মিনাপা সহ পরিবারের সকলে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করছি। রাক্ষস ক্যান্সার মিনাপাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ফেলছে। আমরা অসহায়, ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি মিনাপার করুণ অবস্থা কিন্তু কিছু করতে পারছি না। ক্যান্সারের কাছে মানুষ এখনও কত অসহায়!
বিকেল সাড়ে চারটা বাজে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মিনাপা বার বার বলছে, আমি বাসায় যাবো। আমি বাসায় যাবো। আমার মন বিষণœ কারণ একই কথা আব্বা ও আম্মা বলেছিল। তারা বাসায় ফিরতে পারেনি।
পৃথিবীতে মানুষ যে কত অসহায়, যদি সব মানুষ তা বুঝতো তাহলে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হতো।
গেইন্সভীল, ফ্লোরিডা।