
ঠিকানা ডেস্ক : ‘সাবাস, বাংলাদেশ/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ (সুকান্ত ভট্টচার্য)। আগামী প্রজন্ম তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার হয়েও বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বাধা-বিপত্তির মুখেও তারা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। চরম উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে এ যেন ইংরেজি রেডিও ড্রামা ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ এবং কলকাতার জনপ্রিয় রেডিও রোমাঞ্চ গল্প ‘সানডে সাসপেন্স’-এর মতোই ডাকসুর ফলাফল ‘টুয়েসডে সাসপেন্স’ রোমাঞ্চকর ঘোষণা দেয়া হলো। ক্যালেন্ডারের পাতায় মঙ্গলবার শুরু; রাতের প্রথম প্রহর পৌনে চারটা, সবাই যখন ঘুমিয়ে; তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রোমান্স, ড্রামা, সাসপেন্স, অ্যাকশনে ভরা মিষ্টি মধুর কণ্ঠে ঘোষণা করেন ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন নুরুল হক নূর। ঘোষণা শুনেই একদিকে সূর্যের নতুন আলো; অন্যদিকে অন্ধকার। ১১ মার্চ সকালটা ছিল ডাকসু নির্বাচনে ২৫ আসনের মধ্যে ২৩টিতে বিজয়ী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে ‘জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়’-এর গান ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’ হয়ে ধরা দেয়।
আগের দিনের ডাকসু নির্বাচনে জাল ভোট প্রদান, সিলযুক্ত ব্যাটল বাক্স উদ্ধার, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভোট দানে বাধা, প্রার্থীদের মারধরসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া সব প্যানেলের প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করে অবস্থান কর্মসূচি নেয়। ডাক দেয়া হয় ধর্মঘটের। বিক্ষোভ, অবস্থান, পাল্টা বিক্ষোভে উত্তল হয়ে ওঠে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
শিক্ষার্থী ভোটার ও সাধারণ মানুষের ভাষায় কর্তৃপক্ষের একচোখা নীতির কারণে ব্যাপক নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে। কারচুপি করে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ-সংগঠন ছাত্রলীগের বিজয় নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ভোট গণনার পর দেখা যায় এতো কিছুর পরও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনের এ ফলাফল ঘোষণার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বাম সংগঠনগুলোর জোট, প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য, ছাত্রদল, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাধীকার স্বতন্ত্র পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশন ও স্বতন্ত্র জোটের আন্দোলনের মধ্যেই ছাত্রলীগও উল্টো আন্দোলনে নামে। ভিসির বাসা ঘেরাও করে ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচিত নুরুল হক নুরকে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে নবনির্বাচিত ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দীসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও প্রভোস্টকে লাঞ্ছনার অভিযোগে থানায় মামলা করে।
দিনভর বিক্ষোভ, টান টান উত্তেজনা। ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অবস্থা ‘কেউ কারো নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ অবস্থা। নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর ক্যাম্পাসে (টিএসসি) এলে তাকে ধাওয়া করে ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা। তাদের হুংকার কোনোভাবেই নুরকে ভিপি মেনে নেয়া হবে না। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর সবকিছুই শীতল হয়ে যায়। পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসু নির্বাচনে পরাজিত ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন নতুন ভিপি নুরুল হক নুরকে অভিনন্দন জানান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থানরত ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশে নুরকে ভিপি পদে মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। এরপর ছাত্রলীগ সভাপতি অনুসারীদের নিয়ে টিএসসিতে যান। সেখানে নির্বাচিত ভিপি নুরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। মুহূর্তেই শত শত ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক অন্যরকম দৃশ্যের অবতারণা হয়।
শোভন বলেন, ২৮ বছরে পর আমাদের ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। আমরা চাই না এ নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে কোনোও সমস্যা সৃষ্টি হোক। আমরা চাই প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকুক। আমরা শিক্ষাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভোটে নুর নির্বাচিত হয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে এই ফল মেনে নিতে হবে। আমি এই নির্বাচনের ফল সবাইকে মেনে নেয়ার আহ্বান জানাই। আমি এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।
এর জবাবে ভিপি নুর বলেন, আমার কাছে ভালো লেগেছে শোভন ভাই আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন। আমরা একই পদে নির্বাচন করেছি। আমি বিজয়ী হয়েছি। তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এটি খুবই ভালো লেগেছে। ঢাবি দেশের বাতিঘর। সবাই এখানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো। শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস হিসেবে ঢাবিকে গড়ে তুলবো।
এর আগে অবশ্য নুরুল হক নুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিন, আমরা সবগুলো আসনে বিজয়ী হবো। ছাত্রলীগ একটি পদও পাবে না।