ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা

দেশে কি দেশের বাইরে, ক্ষমতা দেখানো মনে হচ্ছে এক কঠিন ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার গরম পুড়িয়ে মারছে সাধারণ মানুষকে, যাদের ক্ষমতা নেই। আমেরিকায় জনগণের ভোটে গো-হারা হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যা করছেন, সেটাও ক্ষমতার প্রদর্শন। এই সম্পাদকীয়তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতা দেখানো নিয়ে কথা বলা উদ্দেশ্য নয়। আজ বাংলার ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা নিয়ে কিছু বলাই এখানে উদ্দেশ্য। আমেরিকায় ক্ষমতা দেখিয়ে পার পেয়ে যাওয়া খুব কঠিন, ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত বলে।
কিন্তু বাংলাদেশে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং ক্ষমতাবান অপরাধী, খুনি-সন্ত্রাসী-ধর্ষকদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখানোর কঠিন সংকল্প সত্ত্বেও বিভিন্ন স্তরে দুর্বলতা থাকার কারণে প্রধানমন্ত্রীর সেই সংকল্প অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হতে পারছে না বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বাংলাদেশে কেবল সাধারণ খুনি-ধর্ষক-সন্ত্রাসীরা কিংবা কিছু দলীয় ক্যাডার-মাস্তান, ব্যবসায়ীরাই অপরাধকর্মে লিপ্ত দেখা যাচ্ছে না। হতাশাজনক হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর হাতে গোনা কিছু সদস্যকেও এসব অপরাধকর্মে জড়িত থাকতে দেখা যাচ্ছে। সরাসরি নিজেরাই কেবল অপরাধ করছে না, পেশাদার অপরাধীদের অপরাধকর্ম না দেখার ভান করে তাদের অপরাধ চালিয়ে যেতে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে সম্প্রতি ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে বেশ হইচই হয়ে গেল। বিশেষ করে তিনটি ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় ওঠে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে কঠিন ও কঠোর অবস্থান নিতে দেখা যায়। কাকতালীয় কি না, তবে তিনটি ঘটনাতেই দেখা যায় ভিকটিম সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর লোক। অন্য আর যেসব ক্ষেত্রে তৎপরতা দেখা যায়, তার পেছনে এলাকার মানুষের লাগাতার প্রবল বিক্ষোভ, সাংবাদিকদের লেখালেখি কিংবা ক্ষমতাসীন অন্য কোনো ক্ষমতাবানের প্রভাব। সেই প্রবচন ‘তেলে মাথায় তেল দেওয়া’র মতো। তেলহীন মাথা কেউ খোঁজে না তেল দেওয়ার জন্য। যে কারণে বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কেঁদে বেড়ায়।
বাংলাদেশে সম্প্রতি তোলপাড় তোলা আলোচিত অপরাধ ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে পুলিশের ফায়ারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যু, ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের হাতে নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা সপরিবারে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা, সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে যুবক রায়হানের মৃত্যু, সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তার ঢাকার এক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে কর্মচারীদের নির্যাতনে মৃত্যু। এর মধ্যে দুটি অপরাধই দেখা যাচ্ছে কতিপয় ক্ষমতাধর পুলিশের হাতে সংঘটিত হয়েছে। আরেকটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে এক ক্ষমতাধরের পুত্র আর এক ক্ষমতাধর। কথায় বলে লাইক ফাদার, লাইক সন!
পুলিশের হাতে সংঘটিত দুটি মৃত্যুর ঘটনাই ঘটেছে অভিযুক্ত আসামিরা যা-ই করুক, কিছু হবে নাÑএই বিশ্বাস থেকে। কেননা পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা আগেও ঘটেছে কিন্তু কিছুই হয়নি। এ ছাড়া পুলিশের নামে ক্ষমতা দেখিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা তাদের শুধু ওই দুটিই ছিল না। জানা যায়, মেজর সিনহার হত্যাকারী ওসি প্রদীপ নাকি তার আগেও ২০৪ জনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে। এত মানুষ মেরেও যার কিছু হয়নি, তার পক্ষে তো মানুষ মারা কিছুই নয়! মৃত সিনহা সেনাবাহিনীর সাবেক সেনা কর্মকর্তা না হলে হয়তো এটাতেও প্রদীপ পার পেয়ে যেত। রায়হানের ঘটনায় এসআই আকবর ফেঁসে গেছে কপাল খারাপ তাই। তা ছাড়া ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মিডিয়াসহ স্থানীয় নারী-পুরুষ সবাই বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন এবং লাগাতার বিক্ষোভ-প্রতিবাদে রাস্তায় অবস্থান নেন। তা সত্ত্বেও আকবর পালিয়ে যায় ঊর্ধ্বতন কারো পরামর্শে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। ধরা পড়ে যায়।
হ্যাঁ, ধরা পড়ে সবাই। দলের বাইরের লোক ধরা পড়ে। দলের লোকও ধরা পড়ে। কিন্তু পরে কী হয়, পাবলিক আর তা জানতে পারে না। ঘটনার ঘনঘটায় ঢাকা পড়ে যায়। পরের ঘটনা ঢেকে দেয় আগের ঘটনা। ধরার কৃতিত্ব নেওয়া শেষ, সব ঘটনার উত্তেজনাও শেষ! বাংলাদেশ কত বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পাওয়া। এক নেতার সাহস, দূরদৃষ্টি। স্বাধীনতার ঘোষণা। আর জনতার জীবনদানের উৎসব। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে দিলেন স্বাধীনতার বেদিমূলে। সম্ভ্রম গেল দুই লক্ষাধিক মা-বোনের। কী বজ্রকঠিন ঐক্য। হার্ড রক। কী সাধনার স্বাধীনতা। স্বপ্নের স্বাধীনতা!
অনেকেই বলতে চান, সেই স্বাধীন দেশে আজ এ কী অবস্থা! না, স্বাধীন দেশেরও কোনো দশা হয়নি। স্বাধীনতারও কিছু হয়নি। হয়েছে কিছু মানুষের। মানুষও কি তাদের বলা যাবে? মানুষের প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা নেই যাদের, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই যাদের, মানুষের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই যাদের, তাদের মানুষ বলে কতটা গণ্য করা যায়?
বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই একটা শ্রেণিকে দেখা গেল স্বাধীনতার চেতনা ও আদর্শের প্রতি কোনো নিষ্ঠা নেই। সংঘবদ্ধ স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে তারা স্বার্থপর কর্মে মেতে ওঠে। সেই কর্ম সাধনে তাদের মধ্যে অসৎ চক্রও গড়ে ওঠে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেই চক্র বলশালী হতে থাকে, অপরাধের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। অন্যদিকে নীতি-নৈতিকতাও তাদের মন থেকে বিদায় নিতে থাকে। বিবেকহীনতা, দায়বদ্ধতা ঝেড়ে ফেলে স্বার্থপরতার পর্দায় চোখ ঢেকে দিয়ে অপরাধজগতের গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। অপরাধের সেই চারাগাছটি এখন অনেকটাই বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে ক্ষমতার জল পেয়ে। দুর্নীতি আর দুষ্কর্ম হাত ধরাধরি করে এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে বাংলাদেশে। যার যত ক্ষমতা, অপকর্মের ওজন তার তত বেশি। দুর্নীতির নানা শাখা-প্রশাখা। মহামারি, মহামারি, মহামারি! দুর্নীতির মহামারি। ধর্ষণের মহামারি। খুনের মহামারি! করোনাকালে বিপর্যস্ত মানুষের সাহায্যে রিলিফের চাল চুরি। বৃদ্ধা থেকে শিশু ধর্ষণের শিকার। শয়নকক্ষ থেকে সড়ক- সর্বত্র খুনের মহোৎসব। দপ্তরে দপ্তরে পিয়ন থেকে শীর্ষ কর্মকর্তা অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ।
ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রদর্শনের বাহাদুরি। আমি এমপি, আমি চেয়ারম্যান, আমি কাউন্সিলর, আমি ওসিÑআমার কেশাগ্র স্পর্শ করে সাধ্য কার? একজনমাত্র মানুষ, যিনি জিরো টলারেন্সের কথা বলছেনÑপরোয়া কী? সহযোগিতা তো মিলছে সাতজনের কাছ থেকে! তাইতো রাজধানী শহরে নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে স্ত্রীসহ লাঞ্ছিত করার সাহস পায় এক ক্ষমতাধর পিতার এক ক্ষমতাবান সন্তান? এলাকায় সিসিটিভি লাগিয়ে সবকিছু মনিটরিংয়ের আয়োজন, শক্তিশালী ওয়াকিটকি নিয়ে চলাফেরা, ঘরে টর্চার সেল, এলাকায় ব্যাংকের জমি দখল, স্কুলের খেলার মাঠ দখল কারো চোখে পড়ে না। যখন বেকায়দায় পড়ে যায়, কপাল দোষে তখন হইচই ওঠে। কিছুদিন একটু নড়াচড়া হয়। তারপর আবার সব নীরব, নিস্তব্ধ।
ক্ষমতাবানরা যখন ক্ষমতা দেখিয়ে উল্টো পথে গাড়ি হাঁকায়, লালবাতিকে বুড়ো আঙুল দেখায়, একে-ওকে চড়-থাপ্পড় মারে, অসম্মান-অমর্যাদা করে, তখন কেউ দেখতে পায় না।
ঋণখেলাপির ঋণ আদায় হয় না, কারণ তারা ক্ষমতাবান। এই ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রদর্শন যত দিন জারি থাকবে, তত দিন সাধারণ মানুষের দুর্দশা দূর হবে না কোনো দিন। ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার প্রদর্শন বন্ধ করতে হলে ওই একজনের জিরো টলারেন্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার কায়েম করতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বাংলার ক্ষমতাহীন মানুষ সবাই সমানভাবে ক্ষমতার অধিকারী হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্য-তা হয়নি। কথা ছিল সাধারণ মানুষের ক্ষমতা ধারণ করেই ক্ষমতার ব্যবহার হবে। ক্ষমতা হবে সেবাদানের হাতিয়ার। ক্ষমতা ক্ষমতাবানদের প্রদর্শনের বিষয় হবে না।