ক্ষমতার সিন্দুকে বিদেশি হাত

আইএমএফের বাড়াবাড়ি : মার্কিনি খবরদারী : বিরক্ত সরকার

বিশেষ প্রতিনিধি : সাংবাদিকেরা কোনো প্রশ্ন না করলেও প্রধানমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীরা প্রতিদিনই কিছু না কিছু জানান। অথবা এক প্রশ্নের জবাবে জানান আরেকটা। কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে জানাতে থাকেন অন্য কোনো বিষয়ে। এরই মাঝে এ ধরনের এক অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে বসেছেন, ‘রিজার্ভের টাকা কেউ চিবিয়ে খায়নি।’ আরেক জায়গায় তার দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, জেলে যাবেন, নয় মরবেন। তবু দেশ ছেড়ে পালাবেন না।
কেন এমন ‘জানানো’র কাজে নামতে হয়েছে সরকারকে? -এ প্রশ্নের জবাব তালাশে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মনের সুখে নয়, বাধ্য হয়ে সরকারকে এ জানানোর কাজটি করতে হচ্ছে। সরকারও ভাবেনি এ ধরনের জবাবদিহির আওতায় পড়তে হবে বলে। স্পর্শকাতর কিছু জায়গা থেকে রিজার্ভসহ কিছু বরাদ্দ ও কাজের তাগিদে পড়েছে সরকার। নানান অহম দেখানো ও আঁকাবাঁকা কথামালা শেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ধারকর্জ নিতে হচ্ছে সরকারকে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানে কুলাচ্ছে না। নানান তাচ্ছিল্য করে এখন বিশ্বব্যাংকসহ আরো অনেককে লাগছে।
এ সুযোগে তারাও পেয়ে বসেছে। এরা চায় না সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করুক। সেই সঙ্গে সরকারকে কেবল শর্তের পর শর্তই দিচ্ছে না, রীতিমতো জবাবদিহি করে। তথ্য দিলে পরখ করে। তথ্য দিতে দেরি হলে ধমকায়। কয়েকটি মন্ত্রণালয় দায় চাপিয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রী বা তার কার্যালয়- পিএমওর দিকে। সরকারের বিভিন্ন গ্রুপে ঝগড়াও বাধছে। এতে আইএমএফ দল কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে প্রতিদিন সাপের দেখা পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির তথ্য দিতে দেরি হয় কেন প্রশ্ন করে বসেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি গণনার হিসাব-পদ্ধতি ঠিক হচ্ছে না জানিয়ে তা সংস্কারের পরামর্শও দিয়েছে। সরকার মোটেই এমনটির জন্য প্রস্তুত ছিল না। বিরক্তও হতে পারছে না। এর জেরেই প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, রিজার্ভের টাকা কেউ চিবিয়ে খায়নি; দেশের উন্নয়নেই খরচ হয়েছে। এ কথা বলে এখন আরেক ফাঁপরে সরকার। কোন উন্নয়নে কীভাবে কত খরচ হয়েছে, তা জানানোর তাগিদ ভর করেছে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ না নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে সরকার বোঝাতে চেয়েছিল যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে‌ই সবকিছু করা সম্ভব। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরপরই ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং দুর্ভিক্ষের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যা কল্পনার বাইরে ছিল ক্ষমতাসীন মহলের। চীন, হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ কীভাবে রিজার্ভ খরচ করে, সরকারকে শাসনের মতো করে তা শোনায় উন্নয়ন সহযোগীরা। প্রধানমন্ত্রী যে দুর্ভিক্ষ আসছে বলে সতর্ক করেছেন, এরও ব্যাখ্যা চায়। দুর্ভিক্ষ আসছে না, নীরবে চলছে, তাও জানতে চায়। জানাজানির এ কঠিন সময়ে একেবারে দম ধরার কোঠায় চলে গেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। যার মন্ত্রণালয় নিয়ে এত কথা, তার এমন আউট অব ফোকাস থাকা নিয়েও উড়ছে নানা কথা।
সরকারের জন্য কেবল বিরক্তিকর নয়, মারাত্মক অ্যালার্মিংও বিষয়টি। সরাসরি একে বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে শনাক্ত হয়েছে সরকারের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ছাড়া কাউকে নিয়ে টেনশন ছিল না সরকারে। এখন নানা কথা বললেও একটা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ম্যানেজে নিয়ে এসে ২০১৪ বা ২০১৮ এর মতো লাস্ট রাউন্ডে ফিনিশিং দেওয়ার মসলাও রয়েছে সরকারের হাতে। সেটাও এখন বরবাদের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবারের স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা ইসলাম ধর্ম বা ধর্মীয় জঙ্গি ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এবার আর ইসলামি শক্তি শত্রু নয়। তাদের এবারের শত্রু কমিউনিস্ট চীন এবং সাবেক সমাজতন্ত্রী রাশিয়া ও এদের সমর্থক গোষ্ঠী। সরাসরি সেটা না বলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কেবল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা টানে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইতে চাইতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে বিশ্বমানের গ্রহণযোগ্য ভোট দাবি করেই দমছেন না। সশরীরে চলে যাচ্ছেন এখানে-ওখানে। ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ডিমান্ড আরো বেশি। তিনি বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় পুরোনো অনেক হিসাব পাল্টে যাচ্ছে। পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধে অভিজ্ঞ সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এবার কৌশলের মারে ব্যাপক পরিবর্তন। পুতিন তার মতো করে বিশ্ব-ব্যবস্থা তৈরি করছেন। বাইডেনকে সামনে রেখে পশ্চিমারাও করছে তাদের মতো করে। এতে দুনিয়ার কোনো দেশই বাদ যাচ্ছে না। বাংলাদেশ কেন, উগান্ডাও বাদ থাকছে না এ স্নায়ু থেকে। এমন সময়ে রাশিয়া, চীন, ভারত বলয়ে ঢুকে আরো বেশি শনাক্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ। ঢাকায় দুদিন সফর করে যাওয়া মার্কিন উপসহকারী মন্ত্রী আফরিন আক্তারও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে গেছেন। বড় রকমের অ্যাজেন্ডা নিয়ে আসা আফরিন এ সময়টায় বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসা সুশীল সমাজের কয়েকজনের সঙ্গেও কথা বলে গেছেন। আফরিনের আগে সফরে আসেন এডওয়ার্ড এম কেনেডি জুনিয়র। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। আবার বাংলাদেশ সরকার যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে, তাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন। কথা বলেছেন সরকারের চরম বিরাগভাজন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে পাশে নিয়ে ছবিও তুলেছেন ড. ইউনূসের সঙ্গে। এ ছবি আবার যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ফেসবুকে পোস্ট করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন তৎপরতার মধ্যে ‘চীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী নয়, তবে চায়’ মন্তব্যের মাধ্যমে ছোট্ট করে ঢেকুরের মতো আওয়াজ দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। এর কূটনৈতিক মাজেজাও বিস্তর।