ঠিকানা রিপোর্ট : বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংক্ষেপে এসকে সিনহা এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষভাবে আলোচিত এক চরিত্র। বাংলাদেশ সরকারের আকাক্সক্ষা মেটাতে অস্বীকার করার পর থেকে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। এরপর সরকারি চাপে দেশ থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হওয়া, প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর থেকেই তিনি বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করতে থাকেন। প্রবাসে প্রথম তিনি বিস্ফোরণ ঘটান ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ বই লিখে। সেই বইতে তিনি সরকারের অনেক কিছুই ফাঁস করে দেন যা সরকারকে অনেকটাই ঘায়েল করতে সক্ষম হয়। এরপর সেই বই নিয়ে আরেকবার বিস্ফোরণ ঘটে সম্প্রতি ওয়াশিংটনে জাতীয় প্রেসক্লাবে সেই বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে।
সর্বশেষ তিনি বিস্ফোরণ ঘটালেন গত ২১ অক্টোবর রোববার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলিল ব্যারেন হলে। সেখানে দুপুর ১২টায় ‘এ ব্রোকেন ড্রিম’ নিয়েই একটি আলোচনার আয়োজন করে বস্টন চেম্বার অব কমার্স অব বাংলাদেশ এবং বিইএনএ যৌথভাবে। মূলধারার রাজনীতিক কম্যুনিটি অ্যাকটিভিস্ট আনিস আহমেদের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে কথা বলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সিটি কাউন্সিলর ও মেয়রপ্রার্থী টিটু জ্যাকসন। মঞ্চে আসন নেন এটর্নি ডিয়াজ এবং ড. আবিদ বাহার। অতিথিদের ফুল দিয়ে সম্মানিত করেন অন্যদের সঙ্গে চেম্বারের সভাপতি সোহরাব এইচ খান। সেখানে বিচারপতি সিনহা বললেন, বঙ্গবন্ধু জনগণের নামে দেশ স্বাধীন করেন অথচ ক্ষমতায় গিয়ে একনায়ক হয়ে গেলেন।
ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, অনেক জীবন, অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার মূল চেতনা এবং নাগরিক প্রত্যাশা ছিল রুল অব ল’, গণতন্ত্র, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। ‘উই আর দ্য পিপল’ এটাই ছিল স্বাধীনতার মর্মার্থ।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের কথা বলেই বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় গিয়ে তিনি মানুষের কথা ভুলে যান। সব কিছু ধ্বংস করে দেন। জনগণ তার কথা শুনেছেন, মেনেছেন। জনগণ গণতন্ত্রকে মানে। কিন্তু নেতারা গণতন্ত্র ভুলে পয়সা নিয়ে মনোনয়ন দেন।
বিচারপতি সিনহা আলগোরÑ বুশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, তারা কোর্টের রায় মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে আইন-আদালত সহ সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করে থাকে সরকার। সরকার বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, তার রায় সরকারের মনোপুত হয়নি বলে তাকে জোর করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, তিনি কারও দয়া বা সহযোগিতা পেয়ে প্রধান বিচারপতি হননি। নিজ গুনেই তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র হিন্দু যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রধান বিচারপতি।
বিচারপতি সিনহা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ এখনও ব্রিটিশ আইনে চলে। কিন্তু স্বাধীন দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ব্যতীত এবং স্বাধীন দেশের উপযোগী আইন ছাড়া কিছু অর্জন করা যাবে না।
তিনি বলেন, ক্ষমতা পেয়ে বঙ্গবন্ধু একনায়ক হয়ে যান। বর্তমান সরকারও জনগণের স্বার্থে কোনো কাজ করে না। ক্ষমতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মোশাহেব, চাটুকার বেষ্টিত। চোর ডাকাতদের সুবিধা দেয়। নিজ দলে থাকলে সব ঠিক, বিপক্ষে দাঁড়ালেই শত্রু। বাংলাদেশে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
তিনি বলেন, জনকল্যাণের লক্ষ্যে তার অনেক সুপারিশ ছিল। কিন্তু অনেক সুপারিশই সরকার গ্রহণ করেনি। সরকারের ওপর মহল থেকে আমাকে চাপ দেয়া হতো ক্রিমিনালদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিচারের নামে এখন মকারি চলছে।
বিচারপতি সিনহা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে আইনের শাসন কাকে বলে।
তিনি বঙ্গভবনকে ‘ব্যাংক ভবন’ উল্লেখ করে বলেন, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মহিউদ্দিন খান আলমগীরকেও ছেড়ে দেয়ার জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি গৃহবন্দী ছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন মোটেও সুষ্ঠুভাবে হয়নি। তিনি আগামী নির্বাচনে বিদেশি কোনো শক্তিকে বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা না করার আহ্বান জানান।
এরপর তিনি অনেকের প্রশ্নের জবাব দেন এবং শেষে তার বইয়ে পাঠকদের জন্য স্বাক্ষর দেন।
তার আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে টিটু জ্যাকসন বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইমিগ্র্যান্ট বিরোধী যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন তা ভুল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কঠোর পরিশ্রমী এবং শিক্ষিত লোক যদি আমেরিকায় আসে তা এদেশের জন্যই ভালো। আমেরিকাকে সমৃদ্ধ করবে। তিনি বলেন, আমেরিকায় এখন সিনেট, সংগ্রেস, কোর্ট সব আন্ডার অ্যাটাক। সিনেট, কংগ্রেস বিলং করে না হোয়াইট হাউজ।
টিটু জ্যাকসন বলেন, আমাদের সফল হতে হলে সাহসী হতে হবে। তিনি বলেন, জাস্টিস সিনহার সাহস আছে কাজ করার। উই নিড এ হিরো। আমাদের রক্ষা করার জন্য হিরো দরকার। মি. সিনহা নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চুপ করে থাকতে পারতেন। কিন্তু জাতির স্বার্থে, বিচার বিভাগের স্বার্থে তিনি কোন অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
ক্ষমতায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু একনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন
হার্ভার্ডে বিচারপতি সিনহা