মোস্তফা কামাল : মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে অমর একুশের বই মেলা ঘনিয়ে এলে গত বছর কয়েক ধরে, বাংলা একাডেমি নিয়ে অনাকাঙ্খিত কথার ধুম জমে। প্রকাশ হয় নানা কাণ্ডকীর্তির খবরও। এবার এসবের তীব্রতা আরো বেশি। তা কি মৌসুম বলেই? নাকি আশপাশে বা নেপথ্যে লুকিয়ে আছে আরো কিছু? এবারের শুরুটা হয়েছে একটি বই বাতিল করা নিয়ে। বই বাতিল করতে গিয়ে ‘আদর্শ’ নামের প্রকাশনা সংস্থাকে স্টল বরাদ্দই আটকে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এ নিয়ে এখন বিতিকিসসিরি অবস্থা। নানা কথার ঢোলে বাড়ি। বইমেলাকে বাংলা একাডেমি থেকে আলাদা করার ভাবনা-প্রস্তাবনার কথা পর্যন্ত এসেছে। এ ভাবনাধারীরা বলতে চান, বাংলা একাডেমি বরং সাহিত্যের গবেষণা নিয়ে থাকুক। মেলার সাথে উদযাপন, বিপণন-বাণিজ্যের বিষয়গুলো অন্য কোনো সংস্থা করুক। পারলে প্রকাশকদের সমিতি করুক বা নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। ভাবা যায় আবদার তথা দাবি কোথায় এসে ঠেকেছে?
বাংলা-বাঙালির গর্ব-অহঙ্কারের অমর একুশে বইমেলাকে এমন ভাবনার জায়গায় নামালেন কারা? কোন সাহস বা বেদনার তোড়ে এসেছে এমন দাবি? বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা, ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নমূলক মৌলিক কাজ বাদ দিয়ে বাংলা একাডেমি মুদি দোকানের পর্যায়ে নেমেছে মর্মে কানাঘুষাটি আমল না দিতে পারলেই ভালো লাগতো। কিন্তু, এবার তা আমল পাচ্ছে লেখক-প্রকাশকসহ কয়েকটি মহলে। বাংলা একাডেমি কি পারতো না ঘটনার এতোদূর না গড়ানোর ব্যবস্থা করতে?
না, সেই অবশিষ্ট জায়গাটুকুও বরবাদ করে ফেলেছে নানা নখরামিতে। লেখক কী লিখবে? ইতিবাচক, না নেতিবাচক? তা দেখার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির? কোনো লেখক সরকারের সমালোচনা করবেন, না তোষামোদী করবেন, তা দিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক নির্ণয় হবে? বাংলা একাডেমিকে অবশ্য এই ‘নিষিদ্ধকরণ’ ক্ষমতা দেয়ার পেছনে লেখককূলের অবদান আছে। এবার যারা বই নিষিদ্ধকরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ, তাদের সবাই কি তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায় বা আলী দাস্তির বই নিষিদ্ধের প্রতিবাদ করেছিলেন? এর পরিণামে ভবিষ্যতে বাংলা একাডেমি যদি পাঠকদেরও বলে দেয় কোন বই কেনা যাবে? কোন বই কেনা যাবে না? তখন কি নৈতিকভাবে পারবেন প্রতিবাদ করতে?
প্রসঙ্গক্রমে সামনে চলে আসে ‘আদর্শবিরোধী’ বই লেখার ‘অপরাধে’ এই বাংলা একাডেমি এলাকাতেই অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের নৃশংস হামলার শিকার হওয়ার কথা। এর অদূরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় নৃশংস হামলায় নিহত হন লেখক অভিজিৎ রায়। তার বিরুদ্ধেও ছিল কথিত আদর্শবিরোধী লেখার অভিযোগ। এখন আদর্শবিরোধী লেখার কারণে বই বা স্টল বাতিল। এতে হুমায়ুন আজাদ এবং অভিজিৎ রায়ের ওপর উগ্রবাদী হামলার সঙ্গে বাংলা একাডেমির তফাৎ কদ্দূর থাকে?
বাংলা একাডেমিরই বা এ ছাড়া কোনো কাজ থাকতে নেই? আছে। বছর বছর ‘বাংলা একাডেমি’ নামের পুরস্কার-পদক দেওয়াও তাদের একটি কাজ। সম্মানজনক এ পদকটিও বছর কয়েক ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। কোন বিবেচনায়, কে কোন পদক বাগিয়ে নিচ্ছেন- এ নিয়ে অনেক কথা। বাংলা একাডেমিতে কর্মকর্তারাও পুরস্কার পান। এতে হয় তো নীতিমালায় কোনো সমস্যা নেই বলেই পান। সেখানে চাকরি-নিয়োগের বিষয়-আশয়ও আছে। বেশ ক’জন কবি-সাহিত্যিক সেখানে চাকরি করেন। তাদের নিয়োগ নীতি-কাঠামো ঠিক আছে তো?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন, ঢাকা।