খামহীন সেই চিঠি

সোনিয়া কাদির :

সেই চিঠিতে ছিল না কোনো ডাকটিকিট। কোনো ডাকঘরের সিলমোহর, কোনো পিয়নের হাত ছুঁয়ে সে চিঠি আসেনি। আসেনি কোনো কাক্সিক্ষতজনের কাছ থেকেও। সেই চিঠি কিছু ছেলেমানুষি হিংসাপূর্ণ। তার পরও সেই চিঠি আমার কাছে আসা প্রথম চিঠি, যা আমাকে আজও হাসায় এবং ভাবায়।

নীল খামে ফুলের পাপড়ি জড়ানোও ছিল না তাতে। বেনামী! নাহ্, তা-ও না। প্রেরকের নাম-ঠিকানা না থাকলেও প্রাপকের জায়গায় আমার নাম ছিল। চিঠিতে লেখা ছিল :

লিখেছি চিঠি
লন্ঠনও জ্বালাইয়া
বন্ধুর কাছে আমার কথা
দিবে রে পৌঁছাইয়া।

নাহ্, চুপিসারে লন্ঠনের আলোতে সে চিঠির কোনো উত্তর আমাকে লিখতে হয়নি বা সেই চিঠির প্রেরকও কখনো দেখা দেয়নি। প্রেমে পড়লে হৃদয়বীণায় অকারণে সুর বাজে কিন্তু সেই চিঠি আমার মনে জলতরঙ্গ হয়ে বাজেনি, আতঙ্ক হয়ে বেজেছিল। রঙিন না করে সেই চিঠি রংহীন করে দিয়েছিল আমার কৈশোর।

বুলিং নামে ইংরেজি একটি শব্দ এখন খুব পরিচিত, তখন তা অন্য নামে খ্যাত হলেও আমি ছিলাম তা সম্পর্কে অজ্ঞাত।
তখন আমি ক্লাস এইটে, বালিকা স্কুল। বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সঠিক, নাকি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় সঠিক, তা নিয়ে ভালোই আলোচনা ছিল, তবে আমজনতা সংক্ষিপ্ত নাম দিয়েছিল ‘বালিকা স্কুল’।

পাঠশালা পাসের পর পড়ার আকাক্সক্ষায় ওখানে নাম লেখানো যেত। মাহিনা বা বেতন দিয়ে পড়তে হতো বলে গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের কাছে ‘মাহিনা’ স্কুল।

ক্লাস শুরুর আগে আমরা যখন অর্থ না বুঝে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ/ কিশোয়ারে হাশিম সাদ বাদ’ বলে উর্দুতে জাতীয় সংগীতে সুর তুলতাম, তখন অত্র এলাকার কাক-কোকিলও স্তব্ধ হয়ে যেত।
টিনের দোচালা লম্বা স্কুলঘর। প্লাস্টারহীন ইটের গাঁথুনি যেন রুগ্্ণ, ময়লা দাঁত বের করা কঙ্কাল। ভেতরে বাঁশের তরজার পার্টিশন দিয়ে শ্রেণি ভাগ করা। সুরেশ ও মাদাই নামের দুই ভাই স্কুলের কর্মচারী, ঝাড়ুদার, পাহারাদার সবই।
সুরেশদার ঘণ্টাধ্বনিতে স্কুলের পাঠদান নিয়মমাফিক চলত।

পূর্ব পাকিস্তানে তখন শিক্ষার হার মাত্র ২৫ শতাংশ। আমার বেশির ভাগ সহপাঠী হিন্দু ছিল। ধর্মশিক্ষা ক্লাসের নির্দিষ্ট সময় হিন্দু শিক্ষার্থী বেশি এবং মুসলমান শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দু-একজন হওয়ায় ক্লাস চলাকালে আমাকে অফিস রুমে মৌলভি স্যারের কাছে গিয়ে পড়তে হতো। আমার একা একা মৌলভি স্যারের কাছে পড়তে ভালো লাগত না। তাই আমি হিন্দু সহপাঠীদের ক্লাসেই বসে থাকতাম।
ধর্ম ক্লাস চলাকালে একদিন হুট করে স্কুল পরিদর্শক এলেন। আমাদের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কাছে তার প্রশ্ন ছিল :
শ্রীরাম যখন বাবার নির্দেশে সীতাকে নিয়ে বনবাসে গেলেন, লক্ষণ কেন তার সঙ্গে গেলেন? লক্ষণকে তো বাবা বনবাসে যাওয়ার নির্দেশ দেননি?

উত্তর দিতে না পেরে আমার সহপাঠীরা একে একে দাঁড়িয়ে গেল। সঠিক উত্তর আমি দিলাম। পরিদর্শক নাম জিজ্ঞাসা করে বুঝে গেলেন আমি মুসলমান। তার জিজ্ঞাসা ছিল আমি কীভাবে জানলাম?

চিরকাল আমি বইপোকা, ‘বাদাম খাইÑঠোঙা পড়ি।’ যেখানে পাঠযোগ্য যা পেতাম গোগ্রাসে গিলতাম। এভাবে ওদের ধর্মশিক্ষার বইও আমি আত্মস্থ করে ফেলেছিলাম। ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে থাকার ফলে আমি কথায় কথায় ‘ইয়া আল্লাহ’ না বলে ‘এ রাম’ বলতাম। আমার সহপাঠীরা কঠোরভাবে ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলত। সহপাঠীদের মধ্যে বয়সে, শারীরিক গঠনে আমি ছিলাম ছোট পুঁচকে।
মেয়েশরীরের মেয়েলি লক্ষণ নিয়ে ওরা যখন ফিসফিসিয়ে কথা বলত, আমি তার কিছুই বুঝতাম না। আমার বোকা বোকা প্রশ্নে ওরা বিব্রত হতো, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। প্রায় সময় আমাকে এসব আলোচনায় ওরা রাখত না। আমার সহপাঠীদের প্রায় সবাই ভাইবোনকে দেখাশোনা ও মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করত, সে জন্য কজন ছাড়া বাকিরা ঠিকমতো লেখাপড়ায় সিরিয়াস ছিল না। আর আমার মতো একটা মুসলমান পুঁচকে মেয়ের ক্লাসে সেরা হওয়া, শিক্ষকদের আদরের হওয়া, তারা অনেকে মেনে নিতেও পারত না। আবার ক্লাসের সেরা ছাত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারত না।

আমার দিনগুলো যখন নীল আকাশ, মুক্ত ঘুড়ি, আমাকে ঘিরে রোদ্রালোক, ফুরফুরে হাওয়া। স্কুলের বিশাল আঙিনার আম, জাম পেয়ারা, কুলগাছে মহা উৎসাহে উঠছি, ঢিল ছুড়ে পেড়ে আনছি, সুরেশদাকে দিয়ে কিনে আনা মরিচ, লবণ মিশিয়ে জিহ্বায় চটাং চটাং শব্দ করে বন্ধুদের সঙ্গে খাচ্ছি, তখন হঠাৎ কালো মেঘ-
ঝড়ের বেগে এসে একটি চিঠি তছনছ করে দিল আমার প্রজাপতি জীবন।

কদিনের ছুটি শেষে স্কুলে গিয়েছি। সহপাঠী আনোয়ারা বলল, ‘তোকে তো ভালো জানতাম, কিন্তু তুই এমনই বদ যে তোর সঙ্গে মিশেছি জানলে আমাকে আর স্কুলেই আসতে দেবে না। অতএব আমি আড়ি দিলাম।’ (আড়ি মানে কথা বন্ধ)
তার দেখাদেখি নীলিমা, সন্ধ্যা, মনিকা, বন্দনাও কটিতে আঙুল রেখে আমাকে আড়ি দেখাল।
আরে! ব্যাপার কী? কী অপরাধে আমাকে ফাঁসির আসামি করা হচ্ছে? কিচ্ছু জানি না আমি।

অবশেষে টিফিন পিরিয়ডে রেবা তার বইয়ের ভেতর থেকে বের করল সেই চিঠিবোমা। আমি আর ওটা হাতে নিই না। তখন সবার উদ্দেশে কিছু কিছু বাদ দিয়ে পাঠ করল মনিকা। আমি চোখে সরষে ফুল দেখা শুধু নয়, সরষের ঝাঁজও পেলাম। অচেতন আমার মাথায় পানি ঢালছেন সুরেশদা।

হেড স্যার, বিভু স্যার, বানু মাসি, পণ্ডিত স্যার, মৌলভি স‍্যার আমার পাশে দাঁড়ানো। হেড স্যারের হাতে সেই ভুতুড়ে চিঠি।
উৎসুক শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছিল, আমাকে ভূতে আসর করেছে। আমি সুস্থ হওয়ার পর আমাদের ক্লাসের সবাইকে অফিস রুমে নিয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রেখে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, আর সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, এ রকম কিছু পাওয়া গেলে গার্ডিয়ানদের স্কুলে ঢেকে আনা হবে। কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে আর স্বাভাবিক হতে পারিনি।

চিঠিটি নাকি ক্লাসের ফ্লোরে পাওয়া গিয়েছিল। আর চিঠিতে আমাকে ভালোবাসার কথার সঙ্গে কিছু আজেবাজে শব্দ লেখা ছিল, যা কেউ তার ভালোবাসার জনকে লিখতেই পারে না। এ রকম বাজে কথায় ভালোবাসার জনকে নয়, শত্রুকেই শুধু কর্দমাক্ত করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হঠাৎ একদিন অনু এসেছিল আমাদের বাড়ি। এ কথা সে কথার পর সে বলল, ‘তুই ছিলি আস্ত একটা গাধি, তুই পড়াশোনায় আমাদের চাইতে ভালো হলেও তোর বুদ্ধি কম ছিল। বেহুঁশ হয়ে পড়লি, নয়তো ঠান্ডা মাথায় একটু চিন্তা করলেই ধরতে পারতে লেখাটা আমার হাতের। একটু সময় নিয়ে ভাবলেই আমার বারোটা বাজিয়ে দিতি। তখন ছেলেদের লেখা প্রেমপত্রে কী লেখা থাকে বা কীভাবে লিখতে হয়, আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ছেলেদের ভাব প্রকাশে পুরুষালি ভাব থাকে। আমার আজেবাজে লেখায় ছিল অনভিজ্ঞ এক হিংসাত্মক বালিকার প্রলাপ। কী বোকা ছিলে রে তুইÑআমাদের শয়তানির এক কণা ধারণাও তোর ছিল না।’

রেবতীর পরিকল্পনায় সায় ছিল জ্যোতি ও আলেয়ার। লিখেছিল অনু। কী ছেলেমানুষ ছিলাম। ভাবতাম, প্রেম মানেই নিষিদ্ধ কিছু, ওসব শোনাও পাপ, আর যারা প্রেমে পড়ে, তারা মহাপাপী। এমনই ধারণা ছিল, জুজুর ভয়ে জ্বরে মরেছি কিন্তু জুজু পুরুষ না নারী, চিন্তা মাথায় আসেনি। চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলকে দোষ দিয়ে গেছি।

আজ আমার সেই সহপাঠীরা কোথায় আছে, জানি না। আধুনিক প্রযুক্তি অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেও আমার সেই সহপাঠীদের আজও পাইনি। কিন্তু প্রথম চিঠিটির কদর্যতা আমার মনের এক কোণে আজও দলামচা হয়ে চুপচাপ পড়ে আছে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।