খালেদার অনুপস্থিতি: ঝিমিয়ে পড়েছে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড

রাজনৈতিক ডেস্ক : ঈদের পর নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনাও। কিন্তু এসব বাস্তবায়নে নেই তেমন কোনো সাংগঠনিক প্রস্তুতি বা কার্যকর পদক্ষেপ।
উল্টো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের রুটিন সাংগঠনিক কর্মকা-সহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেমে এসেছে একরকম স্থবিরতা। ঝুলে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে কিছু দায়সারা কর্মসূচি, বিভিন্ন ইস্যুতে ব্রিফিং, বিবৃতি ও আলোচনা সভা-সেমিনার এবং জাতীয় অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে দলটির সার্বিক কার্যক্রম।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে দলটির সাংগঠনিক তৎপরতার এমন চিত্র। তারা আরও জানান, রমজানকে সাংগঠনিক মাস হিসেবে ঘোষণা দিলেও দল পুনর্গঠনে কোনো তৎপরতা নেই।
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের পক্ষে জনমত তৈরি, জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং তৃণমূল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে জেলা কমিটিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালীকরণের দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
অঙ্গ সংগঠনগুলো পুনর্গঠনও থমকে আছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রের সঙ্গেও নেই কোনো যোগাযোগ। কেন্দ্রের কোনো সুনির্দিষ্ট বার্তাও নেই তাদের কাছে। এমন পরিস্থিতিতে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক রকম হতাশা।
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান। তিনিই বর্তমানে দলের সাংগঠনিক কর্মকা-সহ সার্বিক বিষয় তদারকি করছেন।
সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বারবার তাগাদা দিচ্ছেন তিনি। যেসব কমিটি পুনর্গঠনের কাজ বাকি আছে তা দ্রুততম সময়ে শেষ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন।
জানতে চাইলে তৃণমূল পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, দলীয় প্রধানের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিলাম। আমরা ইতোমধ্যে অর্ধশত জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন কাজ শেষ করেছি।
ঢাকা মহানগরসহ আরও বেশ কয়েকটি কমিটিও ঘোষণা করেছি। কিন্তু চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর এসব কাজে কিছুটা গতি কমে আসে এটা সত্য।
তিনি বলেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। তার নির্দেশে আমরা নতুন করে কাজ শুরু করেছি। মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটিসহ বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে কাজ চলছে। ঈদের পর বাকি জেলা ও অঙ্গ সংগঠন পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়া হবে। দ্রুততম সময়ে তা শেষ করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন ও বিভিন্ন মামলা হামলায় পর্যুদস্ত দলটির সাংগঠনিক শক্তি। সাংগঠনিকভাবে দলকে গুছিয়ে আনতে বারবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা নানা কারণে থমকে যায়। কিন্তু দলটির হাতে সময় খুব কম। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন।
ওই নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক দলটি। তবে নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনো সমঝোতা হয়নি। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ঈদের পর রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। কিন্তু সেই আন্দোলনে সফল হওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি দলটির আছে কি না, এমন প্রশ্নই সবার মধ্যে।
তারা আরও জানান, বিগত সময়ে আন্দোলনে সফলতা না আসার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল সাংগঠনিক দুর্বলতা। জনগণের সমর্থন থাকার পরও সাংগঠনিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে দলটি। এর সর্বশেষ উদাহরণ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
সাংগঠনিকভাবে দুর্বল থাকার কারণেই নির্বাচনের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে দলীয় পোলিং এজেন্ট দিতে ব্যর্থ হয় দলটি। পাশাপাশি জাল ভোট ঠেকানো ও কেন্দ্র পাহারা দিতে পারেনি।
জানা গেছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করার কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেলা, মহানগর, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের কাজ দ্রুত শেষ করার বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এ ছাড়াও একাধিক পদ আঁকড়ে থাকা নেতাদের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ফাঁকা পদগুলো পূরণ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। হাইকমান্ডের এমন নির্দেশনা পেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজও শুরু করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর সবকিছু থমকে যায়।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ৫০১ সদস্যের নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদ ফাঁকা। কমিটি ঘোষণার পর কয়েক নেতা মারা গেছেন। এসব পদ পূরণে বারবার উদ্যোগ নিলেও তা এখন শেষ করতে পারেনি। দলটির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির তিনটি পদ ফাঁকা ছিল।
এই কমিটির দুই নেতা আ স ম হান্নান শাহ ও এম কে আনোয়ার মারা যান। বর্তমানে পাঁচটি পদ ফাঁকা রয়েছে। গত বছর খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফিরে এসব পদ পূরণের কথা থাকলেও তা আজও হয়নি।
খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর-দক্ষিণের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন ছাড়াও বিবদমান কয়েকটি জেলা কমিটি গঠনের কাজে হাতও দেয়া হয়। উদ্যোগ নেয়া হয় যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে চেয়ারপারসনের কাছে জমা দেয়া হয়। কিন্তু তা ঘোষণার আগেই কারাগারে যান তিনি। এরপর আর সে কাজে হাত দেয়া হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার বলেন, কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব না হলেও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কমিটি করার কাজ প্রায় শেষ। থানা ও ওয়ার্ডের কাজও অনেকদূর শেষ করেছি। ঈদের পর পুরো কাজ শেষ করা হবে বলে আশা করি।
ঢাকা মহানগর বিএনপির মতো অবস্থা দলটির অন্যতম অঙ্গ সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের। গত বছর ১৬ জানুয়ারি রাতে সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে যুবদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে। নির্ধারিত সময়ে না পারলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ শেষ করেছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
এ বিষয়ে যুবদল সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন, ২৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ায় তা ঘোষণা করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি এবং আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এত দিনেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি।
এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল জানান, কমিটি গঠনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তা ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। তবে দ্রুত সময়ে তা ঘোষণা করা হবে।
একই পরিস্থিতি মহিলা দলের ক্ষেত্রেও। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে মহিলা দলের আংশিক নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে চেয়ারপারসনের কাছে জমা দেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থমকে যায় ঘোষণা।