নিজস্ব প্রতিনিধি : আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইনজীবী হিসেবে তার মরহুম পিতা সিরাজুল হক ও অপরাপর খ্যাতিমান আইনজীবী, আইনবিদদের মতো খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। তবে তিনি আইন জানেন না বা অনেক কম জানেন, এমন অভিযোগ করা নিশ্চয় ঔদ্ধত্যমূলক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে এ ধরনের প্রশ্নও উঠেছে। তিনি হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছেন। সে ক্ষেত্রেও তার রাজনৈতিক দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই রকম কথা উঠেছে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাককে ঘিরে।
দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না, তবে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নিতে আইনগত কোনো বাধা নেই। খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হতেও সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী। একই কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। রাজনীতিতে এরা কেউই দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নন। রাজনৈতিক দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে সংশয় উত্তীর্ণ নন তারা। রাজনৈতিক বিষয়ে আনিসুল হক মন্তব্য করে বিভিন্ন সময়ে অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনও মাঝেমধ্যেই সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক মন্তব্য করে। বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আইনমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য নতুন করে আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, চারিত্রিক স্খলন বা অন্য কোনো কারণে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক দণ্ডিত হলে দণ্ড ভোগের পাঁচ বছর উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য হবেন। আরপিওতেও বিষয়টির সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকার পরও আইনমন্ত্রী কী করে বললেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা দিতে পারবেন! একই কথা বলেছেন কৃষিমন্ত্রীও। মন্ত্রীরা আইন জানেন না- এ অভিযোগ করা যায় না। জেনেশুনেই তারা এসব কথা বলেছেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও স্বার্থে এ কথাও কি শোভনীয়!
দেশের প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও ক্ষমতাসীন দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রথমে খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিতর্কের সূচনা করেন। রাজনীতি করবেন না মর্মে খালেদা জিয়া লিখিত অঙ্গীকারনামা দিয়েছেন বলে জাতীয় সংসদে তিনি জানান। বিএনপি থেকে শেখ সেলিমের বক্তব্য অস্বীকার করা হয়। শেখ সেলিম তার বক্তব্যের সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। হয়তো তিনি অপেক্ষায় রয়েছেন। সামনে যথাসময়ে তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ করবেন।
দুই শর্তে খালেদা জিয়া মুক্ত জীবনের সুযোগ পেয়েছেন। রাজনীতি করবেন না এবং দেশেই চিকিৎসা করবেন- লিখিত অঙ্গীকার করেন খালেদা জিয়া, যা সরকারের হাতে রয়েছে। একইভাবে সামরিক বাহিনী সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে রাজনীতিতে অংশ নেবেন না মর্মে লিখিত অঙ্গীকার করে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান। অঙ্গীকার করার পরও তারেক বিদেশে থেকেই রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত তিনি ভার্চুয়ালি মিলিত হচ্ছেন, তাদের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তারেক রহমান সামনে এ সুযোগ আর পাবেন কি না, তা নির্ভর করবে সরকারের সঙ্গে তার ও মা খালেদা জিয়ার সমঝোতার ওপর। মূলত বিএনপির সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রকাশ্য সুস্পষ্ট ঘোষণা হবে এই সমঝোতার ভিত্তি। উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি লাভ এবং রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রিত সুযোগ পাওয়ার বিষয় রয়েছে এর সঙ্গে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে বিদেশি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কোনো রকম চাপ আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকেরা এ ব্যাপারে সরকারের কোনো পর্যায়েই আনুষ্ঠানিক কথা বলেননি। কারণ এর সঙ্গে সাংবিধানিক ও আইনগত প্রশ্ন রয়েছে। আদালতের এখতিয়ারাধীন বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেন না। করতে পারেন না। বিএনপির নেতাদের অনুরোধের পরও আদালত কর্তৃক দণ্ডিত বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। তবে কূটনীতিকেরা গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিসহ যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর তাগিদ দিচ্ছেন। কোনো দল, বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচনে না এলে সেই নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না- এমন কথাও কোনো দেশ ও সংস্থা আকারে-ইঙ্গিতেও বলেনি। তবে সব দলের ও ব্যাপক সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে নির্বাচনের ওপর তারা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার ও সরকারি দলের নীতিনির্ধারকেরাও বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিদেশিদের অবহিত করেছেন। অনেক কূটনীতিক এতে সন্তোষ প্রকাশ করেন বলেও জানা যায়।
প্রশ্ন উঠেছে, সরকার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে থাকার পরও সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির প্রতি অধিকমাত্রায় নমনীয়তা বা দুর্বলতা দেখালেন কেন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিএনপির নেতাদের ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করাই দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ বিএনপির চলমান আন্দোলন ও আগামীর ব্যাপকতর কর্মসূচি নিয়ে সরকার চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তাদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, গণসমাবেশ, মিছিল প্রভৃতি কর্মসূচি সাধারণের সহানুভূতি কেড়েছে। বিদেশিরাও তাদের অহিংস কর্মকাণ্ডে আশ্বস্ত। খালেদা জিয়া সভা-সমাবেশ করতে পারলে বিএনপির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন প্রতিফলিত হবে, যা সামাল দেওয়া নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে সরকারের জন্য সহজ হবে না। খালেদা জিয়াকে শর্তহীনভাবে মুক্ত না করে বাসায় থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর বিশেষ সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এখন কেবল দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে মাসে একবার সর্বোচ্চ দুবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগামীতে শুধু মহাসচিব নন, স্থায়ী কমিটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্যকে চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করা, জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ, ভার্চুয়ালি কথা বলা, নির্র্দেশনা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক যে অবস্থা, তাতে তার পক্ষে মহানগর ও জেলায় জেলায় সশরীরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করা সম্ভব হবে না।