ম. গ. আদ্দীন
সেদিন ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল খেলা দেখতে সবাই একজোট হয়ে বসেছিলো বটু গোয়েন্দার ঘরে। পাড়ার জনাকয়েক যুবক-যুবতী চা-সমুছা-চানাচুরের সাথে হৈ চৈ করে খেলা দেখতে মেতে উঠলো। বটু গোয়েন্দা সবাইকে নিয়ে বেশ আয়েশ-আমোদের সাথে খেলা দেখছিলেন। আর হাতে রাখা একটি বই, দি আর্ট অব ওয়ার উল্টেপাল্টে দেখছিলেন। হঠাৎ এক টিম ফ্রি কিকের সুযোগ পেয়ে গেলে! প্রতিপক্ষের সমর্থকরা যেন বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠলো। দীর্ঘ সময় ধরে দু’পক্ষই পরস্পরকে এক-একটি গোলে খেলাটি ড্র রেখে চলছিল। এবার ফ্রি কিকে যদি গোল হয়ে যায়, তাহলে একপক্ষের নির্ঘাত হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা! কারণ খেলা প্রায় শেষের দিকে। অল্প সময়ে গোল ফেরানো সম্ভব হবে কি-না, সবাইকে তা ভাবিয়ে তুললো। কেন যে কনুইয়ের গুতো ও ল্যাং মারতে গেলো ব্যাটা! শুরু থেকেই সে খুব অ্যাগ্রেসিভ ছিলো। এবার হেরে যাওয়ার পথ সে নিজেই করে দিলো। খেলার শেষদিকে বাড়াবাড়ি থেকে নিবৃত্ত থাকতে হয়। তা না হলে হেরে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। অতঃপর যা হবার তাই হলো! কিকার অত্যন্ত চাতুর্য ও ক্ষিপ্রতার সাথে বলটি কিক মেরে, কোণ বরাবর গোল পোস্টে ঢুকিয়ে দিল আর সেদিনের খেলায় বিজয়ী হয়ে দর্শকের হর্ষধ্বনি পেলো। বটু গোয়েন্দা তার হাত থেকে বইটি রেখে বললেন, – ‘জানো? দু’হাজার বছর পূর্বে চীনদেশের এক জেনারেল সান জুঁ, তাঁর বই আর্ট অব ওয়ারে বলে গেছেন, শত্রুকে পরাস্ত করতে হলে বিভিন্ন উপায়ের একটি উপায় হলো, শত্রুকে আচমকা ভুল করানো! ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে বিজয়ী হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা আর নাও পেতে পারে! আজকের এই খেলায় নিশ্চয় দেখতে পেলে, প্রতিপক্ষ কীভাবে সুযোগ পেয়ে বিজয় লাভ করে ফেললো। যারা হারলো তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাদের প্রতিপক্ষ অন্তিম মুহূর্তে ভুলের সদ্ব্যবহারের চেষ্টায় আছে। মার খেয়ে শত্রুর খারাপ রেকর্ড তৈরি করে ও পরে তা শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, শত্রুকে হারিয়ে দেয়ার কৌশলও একটি আর্ট। অন্যায়, অবিচার, অপকর্মে কখনো প্রতিবাদ না করে শত্রুকে বাড়তে দিলে, তাদের রেকর্ডই একসময় তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। সময় বুঝে মার খাওয়া ও মার দেয়া, যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের একটি রীতি বিশেষ।’
– বটুদা, আপনারা তো অনেক খুন, খারাবি, হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অপরাধীদের জেলহাজতে পুরেন। কিন্তু দুনিয়ার কতো দেশে ও জনপদে যুদ্ধের কারণে কতো নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিচারে প্রাণ হারায়। সে সকল অন্যায় অপকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও বিচার হতে কখনো দেখি না। কতো যুদ্ধাপরাধী ও হত্যাকারী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সম্মানিত ও গৌরবান্বিত হয়! অথচ ভিকটিমরা জীবনেও সুবিচার পায় না। আমাদের চোখের সামনে কতো অমানবিক অন্যায় কা- ঘটে গেলো ও ঘটে চলেছে, আপনারা কী করতে পারলেন?
হেরে যাওয়া টিমের সমর্থক পাশের বাড়ির রানু, খেলায় হেরে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো: – মিস রানু, কিছু বিচার রাষ্ট্রীয় আদালতে হয়, আর কিছু বিচার সময়ের আদালতে ছেড়ে দিতে হয়। একটিতে আমাদের এক্তিয়ার আছে। কিন্তু সময়ের আদালতে সবার এক্তিয়ার নেই। কালের চক্রে সময়কে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই জানে কী করতে হয়। শতাব্দী পূর্বে উপনিবেশে যে অবিচার সংঘটিত হয়েছিল, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কিছুটা সুবিচার কী হয়ে যায়নি ? এমন কী ইম্পিরিয়েলিস্ট ও কলোনিয়েলিস্টদের যারা পরামর্শদাতা ছিল, তাদের জন্যে তৈরি ক্যাম্পগুলো কী ফ্রাই প্যানের মত উত্তপ্ত হয়ে উঠেনি? ভেবে দেখ, আমাদের এই কসমিক সভ্যতা এখন প্রায় শেষের দিকে। খেলার যেমন একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে, তেমনি কসমিক সভ্যতারও নির্দিষ্ট সময় আছে। সভ্যতা হলো, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সত্য-মিথ্যা ও জয়-পরাজয়ের একটি খেলা। সবাই তাদের বিশ্বাস, দর্শন, ধর্ম নিয়ে কসমিক সভ্যতায় আজ বিজয়ী হওয়ার খেলায় মেতেছে। প্রত্যেকে ভাবছে তাদের বিশ্বাসই সত্য। তাদেরই বিজয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু খেলা শেষের গান কে গাইবে, কেউ তা জানে না! কেউ বিজয়ী হচ্ছে দেখেও শেষ বেলায় হেরে যায়। কেউ মার খেয়ে হেরে যাচ্ছে দেখেও পরিশেষে বিজয়ের মুকুট ছিনিয়ে নেয়। কথায় বলে- সব ভালো তার, শেষ ভালো যার।
রাতে খাবার শেষে লিভিং রুমের কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে, হাতের আর্ট অব ওয়ার বইটিতে আবার চোখ বুলাচ্ছিলেন। মার্শাল আর্টও যে যুদ্ধের অনেক কলাকৌশল শিক্ষা দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। অন্যায় ভুলের রেকর্ড তৈরি করতে পারলে, তার চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই! হাজার বছর ধরে সেসব কৌশল মানুষের সভ্যতায় অন্যতম এক আর্টে পরিণত হয়েছে। বইটি বন্ধ করে এবার টিভি ছেড়ে দিয়ে, একটি চ্যানেলে দেখতে পেলেন, বলশেভিক, ফ্যাসিস্ট ও নাজি উত্থানের উপর একটি ডকুমেন্টারি চলছে। তার হঠাৎ মনে হলো, মানুষ যদি অনাচার, অবিচার, দম্ভ, শোষণ, বৈষম্য, লোভ, অন্যকে অবমূল্যায়নের ক্ষতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকারের স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারতো, তাহলে ভয়ানক পরিণতি এড়াতে সক্ষম হতো। সময় যখন শাস্তি হয়ে আবির্ভূত হয়, তখন মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে নব নব মতবাদ সৃষ্টি করে বদলার উল্লাসে মেতে উঠে। মতবাদ তখন ফ্যান্টাসি হয়ে সবার জীবনে সমান দুর্গতি ডেকে আনে। আর ওভেন যখন গরম হয়, তখন মানুষই হয় ফুয়েল অব ফায়ার! একদিন ফ্যান্টাসি উবে যায়, মানব সৃষ্ট সব মতবাদ ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। তখন হাতে থাকে অন্তহীন ভুলের হিসেব নিকেশ ও আক্ষেপ!
কখন যে ঘুমে চোখ জোড়া জড়িয়ে এসেছিল জানেন না। ঘুমের ঘোরেই যেন তার মনে হলো, টিভিতে এক সংবাদ পাঠিকা আন্তর্জাতিক খবরে বলছেনÑ ‘আজ দুপুরে প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, টুডে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইজ ইন বিগ ম্যাস! সিন্স সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, উই হ্যাভ নট বিন ইন কেয়স্ লাইক টুডে! আমেরিকা নীড্স টু বি ব্যাক এগেইন। ফর দা সেইক অব আমেরিকান পিপল, ইফ নেসেসারি আই উইল ডিক্লেয়ার মার্শাল ল্য!’
মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার কী মনে হয় না? মার্শাল ল্য ওয়ার্ল্ডওয়াইড আরো বেশি ট্রাবল সৃষ্টি করতে পারে?-এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন।
আই হ্যাভ সাম গ্রেট জেনারেলস। দে উইল টেক কেয়ার অব দা সিচুয়েশন- প্রেসিডেন্ট জবাব দিলেন। কিন্তু ওসব জেনারেলস গ্লোরিফাইড হয়েছেন, ওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন দেশে ইনোসেন্ট মানুষ হত্যা করে! এক সাংবাদিক সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
আই ডোন্ট থিঙ্ক, দে আর ডাম জেনারেলস। দিস টাইম আই উইল সি, হাও দে ফেস অল দোজ ওয়ার্ল্ড সুপার পাওয়ারস? প্রেসিডেন্ট আশা ব্যক্ত করলেন।
ক্যান ইউ বিলিভ? একটি বড় ধরনের যুদ্ধে ওয়ার্ল্ডের তিন- চতুর্থাংশ মানুষ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে! এক সাংবাদিক উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।
ইফ ইট ইজ ইনেভিটেবল, দেন লেট ইট বি! আমার কিছু করার নেই! ম্যানকাইল্ড ইজ অলওয়েজ ভিকটিম অব দেয়ার ঔন ডীডস এন্ড ফেইটস! দ্যাট ইজ হিউম্যান হিস্ট্রি! প্রেসিডেন্ট দৃঢ়তা প্রকাশ করলেন।
বটু গোযেন্দার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। টিভির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, চ্যানেলটি কখন অফ হয়ে স্ক্রীনটি ঝিরঝির করছে। তাহলে কী এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলেন? নাকি ট্র্যাভেল টু ফিউচার জাতীয় কোন মুভি দেখলেন? বুঝতে পারলেন না। হাতের স্পর্শে বুঝলেন কপালটি ঘামে ভিজে উঠেছে।
পরদিন কাজে পৌঁছেই একটি কল পেলেন। এক ব্যক্তি তার পরিচয় দেয়ার পর বলতে শোনা গেলো, মি. বটু লস্কর, ভয়ানক এক বিপদে পড়ে আপনাকে কল দিচ্ছি। আমি জানি না, এই বিপদ থেকে উত্তরণের কোন উপায় আছে কিনা! শুধু আপনি তদন্ত করে সমস্যাটির সমাধান দিতে পারেন। তা না হলে আমার মরা-বাঁচা সমান হয়ে দাঁড়াবে। অন্তত আমার জীবন থেকে সব শান্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। এমন হৃদয়বিদারক নৃশংসতম কর্ম, জগতে আর ঘটুক আমি আশা করি না। আমাকে এই দুর্ভোগ থেকে উদ্ধার করতে না পারলে, কোন জন্মেই শান্তি পাবো না।
তা সমস্যাটি কী, তাই বলবেন তো? বটু গোয়েন্দা জানতে চাইলেন।
আমার এক জোড়া গরু হারিয়ে গেছে! একটি বলদ ও একটি গাভী; কিছুদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মনে করি তারা জবাই নয়, খুন হয়ে গেছে! আমি তার প্রতিকার চাই। আমার কাছে আমার জীবনের চেয়েও তাদের মূল্য বেশি। মানুষের সমাজে হত্যা, ধর্ষণ, অবিচার, ব্যভিচার, বৈষম্য, ঘৃণা, উচ্ছেদ, বিতাড়ন, অপমান, যাই ঘটুক না কেনো, আমি মোটেই কেয়ার করি না! আমার কাছে কিছুই বড় নয়। শুধুমাত্র ঐ গরু দুটো আমার চাই। তারা মানুষের চেয়েও আমার কাছে প্রাণাধিক প্রিয় ও পূজ্যতুল্য!
কিছু মনে করবেন না। আমি গরু খোঁজা বা গরু খুনের কেস হাতে নেই না। তবে কথা দিচ্ছি, আপনাকে সাহায্য করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। বটু গোয়েন্দা রিসিভারটি রেখে দিলেন।
ঘণ্টাখানেক পর আরেকটি কল পেলেন। এক লোক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছে, মি. লস্কর, আমার এক ভাই আজ ভোরে তার দু’টো গরু নিয়ে ক্ষেতে কাজ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তুু পথিমধ্যে কে বা কারা তাকে গরু চোর ভেবে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমরা গৃহস্থ ঘরের পেশাদার কৃষক। গত হাজার বছরে আমাদের কেউ এমন অপবাদ দেয়নি। আমরা পুলিশকে অবহিত করেছি। আপনি যদি এ ব্যাপারে তদন্তে কিছুটা সাহায্য করেন, তবে খুব উপকৃত হবো।
বটু গোয়েন্দা বুঝতে পারলেন না, কার মামলাটি হাতে নেবেন। পশু হত্যাকারীর পক্ষে, না মানুষ হত্যাকারীর পক্ষে। তিনি হতভম্ব হয়ে তার এজেন্সির সকল স্টাফকে ডেকে পাঠালেন। ম্যাজরিটি শুড বি গ্রান্টেড। কে কার উপাসনা করার কথা সেটি বড় নয়। হিউম্যান কনসাসনেস বলে, অধম উত্তমকে পূজো দেবে। কিন্তু কারো কনসাসনেস যদি মানুষকে অধম বানিয়ে পশুকে উত্তম হিসেবে বিবেচনা করে, আর নিজেকে নিজেই অধম বানিয়ে ফেলে, তাহলে কার কী করার আছে? বাদ প্রতিবাদ না করে, উত্তম ও অধমের পার্থক্য না ভেবে, ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে, চোখ বুজে সমর্থন করে যাওয়াটাই হয়তো মোক্ষম এক কৌশল হিসবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পাঁচ হাজার বছরে যদি গরু সংস্কৃতি ভুলতে পারা না যায়, তবে এক হাজার বছরে মরু সংস্কৃতি কী করে ভুলা যায়? বটু গোয়েন্দা ডায়াল করলেন, সেই ব্যক্তিকে, যে তাকে প্রথম কল দিয়েছিল।
আমি বটু লস্কর বলছি। আপনি শুনে হয়তো খুশি হবেন, আমি ও আমার এজেন্সি মনস্থির করেছি, আপনার মামলাটি আমরা হাতে নেব। পশু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে, আমরা যথোচিত ব্যবস্থা নিতে কার্পণ্য বোধ করবো না!
মেরিল্যান্ড।