ঠিকানা রিপোর্ট: সর্বজন শ্রদ্ধেয়, প্রবাস কম্যুনিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক গজনফর আলী চৌধুরী আর নেই। গত গত ২০ এপ্রিল দুপুরে মৌলভীবাজার শহরে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে…… রাজেউন)। মৃত্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭৫ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে, ১ মেয়ে, ২ ভাই, ৬ বোন, আত্মীয়- স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। নামাজে জানাজা শেষে মরদেহ মৌলভীবাজারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।
মরহুমের ভাই ফজলে আলী চৌধুরী ঠিকানাকে জানান, ২০ এপ্রিল ছিলো শুক্রবার। তিনি জুম্মার নামাজে যাওয়ার জন্য গোসল ও ওজু করেন। এরপর বাথরুম থেকে বের হতে হতেই তিনি হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হন। কিন্তু কেউ বুঝতে পারননি। সে সময় তার স্ত্রী সৈয়দা হাসনা চৌধুরীও বাসায় ছিলেন। তারা মনে করেছিলেন ডায়াবেটিসের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারা সবাই মিলে তাকে পানি খাওয়াচ্ছিলেন। কিন্তু গজনফর আলী চৌধুরীর চোখ দুটি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় এবং শরীর নিথর হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তারা এ্যাম্বুলেন্স কল করেন। এ্যাম্বুলেন্স এলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে পরীক্ষা- নিরিক্ষা শেষে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফজলে আলী চৌধুরী আরো জানান, গজনফর আলী চৌধুরী ১৯৭৪ সালে সপরিবারে আমেরিকায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার তিন সন্তানের মধ্যে ২ ছেলে আকবর আলী চৌধুরী, পাভেল আহমেদ চৌধুরী এবং ১ মেয়ে জুলিয়া চৌধুরী। তারা সবাই বিবাহিত এবং আমেরিকায় থাকেন। কিন্তু গজনফর আলী চৌধুরী কয়েক বছর আগেই স্থায়ীভাবে স্ত্রীসহ বাংলাদেশে চলে যান এবং মৌলভীবাজারেই থাকতেন। মাঝে মধ্যে তিনি আমেরিকায় বেড়াতে আসতেন। কিছু দিন আগেও তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন। ৩১ জানুয়ারি তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশে চলে যান। তাকে জালালাবাদ এসোসিয়েশন সংবর্ধনা দিয়েছিলো। সেই অনুষ্ঠানেই তিনি বলেছিলেন, তার ধারণা আর আমেরিকায় আসা সম্ভব হবে না। আল্লাহর কী হুকুম বাস্তকে তাই ঘটেছে। গজনফর আলী চৌধুরী প্রবাসে এসে রাজনীতি করেছেন, অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সংবাদ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। গজনফর আলী চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশে ন্যায় প্রবাসেও শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ঠিকানার সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি ও সাবেক এমপি এম এম শাহীন, জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সভাপতি বদরুল হোসেন খান, সাধারণ সম্পাদক জেড চৌধুরী জুয়েল, মৌলভীবাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলুর রহমান ফজলু, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান, ওসমানী স্মৃতি পরিষদের সভাপতি নাজমুল চৌধুরী প্রমুখ।
গজনফর আলী চৌধুরীরর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ অক্টোবর মৌলবীবাজার শহরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তার নানা সৈয়দ কুদরত উল্লাহর বাড়িতে। তার পিতার নাম মরহম আব্দুল বারী চৌধুরী। তিনি ছিলেন মনুমুখ হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। গজনফর আলী চৌধুরী তার পিতার প্রথম সন্তান। প্রাথমিক শিক্ষা মৌলবীবাজার শহরের গবিন্দশ্রী প্রাথমিক স্কুলে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার পর তাকে ভর্তি করে দেয়া হয় মাদ্রাসায়। কিন্তু মাদ্রাসায় তার মন বসেনি। দু বছর মাদ্রাসায় পড়ার পর পুনরায় মৌলবীবাজার কাশীনাথ হাই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। তারপর নবম ও দশম শ্রেণীর পড়া সম্পন্ন করেন মৌলবীবাজার গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন।
১৯৬১ সালে ভর্তি হন মৌলবীবাজার কলেজে। পরের বছর ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অজুহাতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে তাকেসহ ৪ সহকর্মীকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। মামলা করেন সিলেট জেলা কোর্টে। ৪ বছর মামলা চলার পর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহৃত হলে আবার মৌলবীবাজার কলেজে ভর্তি হন। ৬৬ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ৬৭ সালে ডিগ্রি পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কলেজ শাখার ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৮ সালে বি এ পাশ করেন। ঐ বছরই ভর্তি হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। কিন্তু আন্দোলনের কারণে ফাইন্যাল পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর ৭২ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ’ল পাশ করেন। ১৯৬০ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পোস্টারিং করতে গিয়ে সুবিমল কুমার দেব মীন ও তিনি দুজন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। অবশ্য তিন দিন পর ছাড়া পান। ১৯৬১ সালে মৌলবীবাজারে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন শাখা কমিটির আহ্বায়ক হন বশির আহমেদ এবং গজনফর আলী চৌধুরী হন অন্যতম উদ্যোক্তা সদস্য। ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে মৌলবীবাজারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ৬৫ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিপক্ষে এবং ফাতেমা জিন্নার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য, উক্ত নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং চেয়ারম্যানদের ভোট প্রদানের অধিকার ছিল। ৬৮/৬৯-এ মৌলবীবাজারে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে তিনি তার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে তাকে ন্যাপের প্রার্থী করা হয়। কিন্তু তিনি নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে সহকর্মী বন্ধু শফকুতল ওয়াহেদের পক্ষে এবং মহকুমা ন্যাপের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন। ৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী মৌলবীবাজার শহরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় জননেতা পীর হবিবুর রহমান ও বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ। ঐ সভায় বন্দুকের গুলির তোপধ্বনির মাধ্যমে সৈয়দ বদরুজ্জামান হামিদ ও তিনি স্বাধীনতার উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন। ২৫শে মার্চের পর ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ অন্যান্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে শেরপুরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু পাক বাহিনীর বিমান হামলার মুখে টিকতে না পেরে পালিয়ে গিয়ে হবিগঞ্জের বাহুবলে আশ্রয় নেন। সেখান এক মৌলানার খপ্পরে পড়ে রাতে পালিয়ে সুনামগঞ্জ হয়ে ভারতের মেঘালয়ের বালাটে পৌঁছান। তারপর চেলাপুজ্ঞি হয়ে শিলংয়ে উপস্থিত হন। শিলংয়ে ন্যাপ নেতা পীর হবিবুর রহমান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে দেখা হয়। সেখান থেকে তাদের নির্দেশে চলে যান আগরতলার ধর্মনগর। ধর্মনগর থেকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছিলেন কৈলাশহরে। কৈলাশহরের টিলাবাজার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তার সাথে ছিলেন ন্যাপের সৈয়দ মতিউর রহমান। সেখানে ১৫ জনের একটি ইউনিট গঠন করে তার দায়িত্বে দেয়া হয়। তারপর ৮ ডিসেম্বর মৌলবীবাজার শহরে প্রবেশ করেন সদলবলে। ৬৬ সালে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ন্যাপের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। মৌলবীবাজারে ন্যাপ গঠিত হলে তার প্রথম সভাপতি ছিলেন ইলিয়াস আলী ও সেক্রেটারী ছিলেন গজনফর আলী চৌধুরী।
মূলত মৌলবীবাজারে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কৃষক সমিতি, শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রধান ভূমিকা ছিল। ৬৪/৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি তার ওপর মৌলবীবাজার ও হবিগঞ্জে সাংগঠনিক কর্মকান্ডের দায়িত্ব অর্পণ করে এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে হবিগঞ্জ ও সিলেটে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠিত হলে মৌলবাজার জেলা বাকশালের সভাপতি ছিলেন ইলিয়াস আলী এবং যুগ্ম সেক্রেটারী ছিলেন গজনফর আলী চৌধুরী। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ন্যাপের সেক্রেটারী হিসেবে গ্রেফতার হয়ে ৯ মাস জেলে ছিলেন।
গজনফর আলী চৌধুরী আমৃত্যু ন্যাপের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ন্যাপ বিভক্ত হলে ছিলেন হারুন-পংকজ ন্যাপে। তারপর চলে আসেন আমেরিকায়। পুনরায় আমেরিকায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ ন্যাপ গঠিত হলে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে আবার ন্যাপ ভেঙ্গে গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হলে তারও সভাপতি ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঐক্য ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
গজনফর আলী চৌধুরী রাজনীতির বাইরে পাশাপাশি সাংবাদিকতায়ও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৬০ সালে থেকে প্রগতিশীল মুখপত্র দৈনিক সংবাদের মৌলবীবাজারে নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ৬২ সাল থেকে দৈনিক মর্নিং নিউজের প্রতিনিধি হিসেবে ৭৫ সালে পত্রিকা বন্ধু হওয়া পর্যন্ত তার প্রতিনিধি ছিলেন। বিদেশে এসেও রাজনীতি ও সাংবাদিকতা দু-ই বজায় রাখেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকার সংবাদের সাথে সম্পর্ক রেখে এখানে সাপ্তাহিক সংবাদ প্রকাশ করেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। গজনফর আলী চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকে মৌলবীবাজারের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বিদেশে থেকেও দেশে সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে জড়িত ছিলেন। ৫ বছর থেকে একটি ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে নিয়মিত গরীব ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা দিয়ে আসছিলেন। একই সাথে কয়েকটি গরীব পরিবারকেও সাহায্য দিয়ে থাকতেন। বছর কয়েক আগে তার কনিষ্ঠ পুত্রের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে বর্তমানে জ্যেষ্ঠ পুত্র ও পুত্রবধূদ্বয়কে নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন। কন্যা ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি কোম্পানীর সিইও হিসেবে চাকরিরত আছেন। স্ত্রী সৈয়দা হাসনা চৌধুরী ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ছিলেন। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় শাখায় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বৈবাহিক সূত্রে ১৯৮৫ সালে মৌলবীবাজার মহিলা কৌটার আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
গজনফর আলী বিগত কয়েক বছর থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডাক্তাররা আরোগ্য লাভের আর সম্ভাবনা নেই জানিয়ে দিলে দেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।