গণতন্ত্রের জয়, দাম্ভিকতার অবসান

স্মরণীয় বিজয় বাইডেন-কমলার, পরাজয় অস্বীকার ট্রাম্প-পেন্সের

নূরুল ইসলাম : তিন দিন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর অবশেষে ম্যাজিক নম্বর ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট অতিক্রম করে ডেমোক্র্যাট পার্টির জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। ৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা হলেও বাইডেনকে
হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়ার জন্য ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই দিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন জো বাইডেন। তিনি হবেন আমেরিকার সেই প্রেসিডেন্ট, যিনি দেশটির ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তার এই অভিষেকের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটবে ট্রাম্পের বহু বিতর্কিত নেতিবাচকতায় ভরপুর চার বছরের দাম্ভিক শাসনের।
৭৭ বছর বয়সী জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। তিনি দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য যেন এত দিনে পেলেন। এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া তার জন্য এত সহজ ছিল না। ১৯৭২ সালে সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তার জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু। ১৯৮৮ ও ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনোনয়নের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বারাক ওবামার অধীনে আট বছর দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণের পথে এ বছর ডেমোক্র্যাট পার্টির পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত হয়ে ৭ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে ডেমোক্র্যাট পার্টির আগের সব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের রেকর্ড ভঙ্গ করেন। পপুলার ভোটের পাশাপাশি ২৯০ ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন বাইডেন, যেখানে জেতার জন্য প্রয়োজন ২৭০ ভোট। এখনো দুটি রাজ্যের ভোট গণনা বাকি। এগুলোতে এগিয়ে আছেন বাইডেনই। তাই চূড়ান্ত ফলাফলে তার পপুলার এবং ইলেকটোরাল দুই ভোটই বাড়তে পারে।
বাইডেনের রানিংমেট কমলা হ্যারিসও আগের সব রেকর্ড ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কমলা হ্যারিস এ নির্বাচনে তার নামের পাশে প্রথম শব্দটির অনেক চমকপ্রদ রেকর্ড গড়েছেন। তিনিই প্রথম ব্ল্যাক মহিলা, প্রথম ভারতীয়-আমেরিকান মহিলা, প্রথম ইমিগ্র্যান্ট কন্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কমলা হ্যারিসের বাবা জ্যামাইকান ও মা ভারতীয়।
জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের ঐতিহাসিক এই বিজয় কেবল তাদের একার নয়; এ বিজয় পুরো আমেরিকার, এ বিজয় অবশ্যই ভোটারদের, এ বিজয় অভিবাসীদের, এ বিজয় গণতন্ত্রের, এ বিজয় নীতি ও আদর্শের, এ বিজয় বিজ্ঞানের। বাইডেনের এ বিজয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উল্লাস করছেন মার্কিন জনগণ।
অন্যদিকে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন বর্ণবাদী, খ্যাপাটে, দাম্ভিক ও একরোখা প্রকৃতির। কথায় কথায় তিনি রেগে গিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে বসতেন। নিতেন স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত। ট্রাম্পের তিরিক্ষি মেজাজ, দুর্ব্যবহার, অশোভন অঙ্গভঙ্গি ভোটারদের মনে নেতিবাচক দাগ কেটেছে। সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী মনোভাব এবং মানুষকে অবমূল্যায়ন করাই ট্রাম্পের কাল হয়ে দাঁড়ায়। হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রশাসন এবং মূলধারার গণমাধ্যমের মাঝে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বারবার। নানা সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের হেনস্তার শিকার হতে হয় সাংবাদিকদের। শুধু সংবাদ সম্মেলনে নয়, নির্বাচনী সমাবেশেও মূলধারার বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে দাম্ভিকতা নিয়ে বেশ সমালোচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। একসময় হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভেবেছিলেন তিনি, যা রীতিমতো সমালোচনার জন্ম দেয়।
ট্রাম্প ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত হয়ে থাকবেন তার ব্যক্তিগত আচরণ ও উপর্যুপরি মিথ্যা বলার জন্য। রিপাবলিকান এই নেতা যতটা না রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের নিকট পরাজিত হয়েছেন, তার চেয়েও বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে তার ব্যক্তিগত ত্রুটি। ট্রাম্পের আমলে দেশটিতে বর্ণবাদী আচরণ তীব্রভাবে লক্ষ করা গেছে। একবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা এ রকম বিপর্যয়ের শিকার দেশগুলোর মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বরং উচিত নরওয়ে বা উন্নত দেশগুলো থেকে অভিবাসীদের আনা। বরাবরই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল ট্রাম্পের। আশ্রয়রত বা অভিবাসীদের বিপজ্জনক ও হিংস্র অপরাধী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে তিনি আমেরিকাকে শক্তিশালী করার প্রতিজ্ঞা করেন। ট্রাম্পের এমন কর্মকাণ্ডকে অহংকার আর খ্যাপাটে স্বভাবের প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। আর এসব কারণেই জো বাইডেনের কাছে হেরে বিদায় নিতে হচ্ছে দাম্ভিক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে। আমেরিকার জনগণ বুঝিয়ে দিল তারা কোনো অহংকারী, দাম্ভিক প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত করতে চান না। তাকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করে তারা আমেরিকায় দাম্ভিকতার অবসান ঘটিয়েছেন।
আমেরিকার জন্য এবারের নির্বাচন ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। পৃথিবীর যেসব দেশে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল, সেখানে নির্বাচন নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি হলে কেউ অবাক হতো না। কিন্তু এ তো আমেরিকা! জর্জ ওয়াশিংটন-আব্রাহাম লিংকনদের আমেরিকা! জ্ঞান-গরিমা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সভ্যতা-ভব্যতায় সারা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার আমেরিকা! এটা সেই আমেরিকা, যার গণতন্ত্র সারা দুনিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, যার গণতন্ত্র সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়, যার গণতন্ত্রের ভিত মহাপ্রলয়েও ইস্পাতকঠিন দৃঢ়। তাইতো মহামারি করোনাকে উপেক্ষা করে মার্কিন ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে বাইডেনকে বিজয়মাল্য পরিয়েছেন আর ট্রাম্পকে করেছেন সিংহাসনচ্যুত।
ট্রাম্পের আমলে মার্কিন সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই এই বিভক্তিকে উসকে দিয়েছিলেন। অতীতে কোনো নির্বাচনেই মার্কিন সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। এই বিভক্তি যতটা না পার্টি লাইনে ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ব্যক্তিনির্ভর। একদিকে ট্রাম্প, অন্যদিকে বাকিরাÑএভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সমাজ। এই নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জন্ম হয়েছিল। পুরো ফলাফল ঘোষণা করার আগেই কোথাও কোথাও ভোট গণনা কেন্দ্রে হামলা হয়েছিল। এ ধরনের হামলা অতীতে কোনো নির্বাচনের পর দেখা যায়নি। এই নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল মানতে অনীহা ও ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বেমানান। এটা মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গেও বেমানান। মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি কখনোই প্রাধান্য পায় না। প্রাধান্য পায় নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে দায়বদ্ধতা ইত্যাদি। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের উত্থান এবং দ্বিতীয়বার পুনর্নির্বাচনে বিজয়ী হতে তার নানা কৌশল ছিল গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটা মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনো ‘ব্যক্তি’ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। পালন করে দলীয় নীতি।
গেল চার বছর ব্যক্তি ট্রাম্প যেভাবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার ব্যক্তিগত আচরণ ও নীতি যেভাবে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, প্রশ্ন হলো জো বাইডেন তা থেকে কতটুকু মুক্ত থাকতে পারবেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর বাইডেন তার নিজ রাজ্য ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে শত শত সমর্থকের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তার গুরুত্বও কম নয়। সেখানে চারটি বিষয়কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, জাতিগত বিদ্বেষ কমিয়ে আনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। করোনাভাইরাস মার্কিন সমাজে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে, তা ট্রাম্প কখনোই স্বীকার করেননি। কিন্তু জো বাইডেন তা শুধু স্বীকারই করেননি, বরং তার অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমেই রেখেছেন। তিনি ইতিমধ্যে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই যে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বড় কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছেন, তা তিনি স্পষ্ট করেছেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। এটা যে একটা মহামারি, তা ট্রাম্প বিশ্বাস করতেন না। এমনকি তিনি কোনো নিয়মকানুন মানতেন না। মাস্ক ব্যবহার করতেন না। বিজ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিলেন। কোভিড-১৯-এ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। নতুন করে করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সেখানে আঘাত হেনেছে। মৃত্যুর সংখ্যাও সেখানে আবার বাড়ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতাই জো বাইডেনকে ক্ষমতায় বসাচ্ছে। এখন দেখার পালা জো বাইডেন করোনা মোকাবিলায় কতটা সফল হন।
যুক্তরাষ্ট্র সুপরিচিত অভিবাসীদের দেশ হিসেবে। কিন্তু ট্রাম্প ছিলেন সবচেয়ে বেশি মাত্রায় অভিবাসনবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট। গত চার বছরে তিনি সীমান্তে ৪০০ মাইলেরও বেশি নতুন দেয়াল নির্মাণ করেছেন। আর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সীমান্ত-নিরাপত্তা জোরদার করে তোলাকে তিনি নিজের সাফল্য হিসেবে বেশি প্রচার করেছেন। ট্রাম্পের কট্টরপন্থী সমর্থকরা এই নীতির প্রশংসা করলেও অনেকেই এর সমালোচনা করেছেন। তার আমলেই অভিবাসীদের ৪ শতাধিক শিশুকে তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৫ শতাধিক শিশু এখনো তাদের বাবা-মাকে খুঁজে পায়নি। শিশুদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই অমানবিক পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী প্রবল সমালোচিত হলেও কট্টর অভিবাসনবিরোধী ট্রাম্প তার অবস্থান থেকে একটুও নড়েননি। তা ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে বহু অভিবাসীকে আমেরিকা ছাড়তে হয়েছে। তার আমলে নতুন করে আমেরিকায় নাগরিকত্ব পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে। বাইরের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশেও ছিল কড়াকড়ি। অপরদিকে নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে আনডকুমেন্টেড অর্থাৎ কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের বৈধ অভিবাসী করা।
বিগত চার বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে কেবল খারাপ কাজই করেছেন, তা নয়। অনেক ভালো কাজও তিনি মার্কিন নাগরিকদের উপহার দিয়েছেন। এর বড় প্রমাণ বাইডেনের সঙ্গে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে তার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বাইডেন যেমন ৭ কোটির বেশি ভোট পেয়েছেন, তেমনি ট্রাম্পও প্রায় ৭ কোটি পপুলার ভোট পেয়েছেন। ২১৪টি ইলেকটোরাল ভোটও তার ঝুলিতে জমা পড়েছে। চূড়ান্ত ফলাফলে সেটা আরো বাড়তে পারে। ট্রাম্পের আমলে মার্কিন অর্থনীতি ছিল বিরাট চাঙা। দেশের সীমান্ত ছিল সুরক্ষিত। ট্রাম্পের আগের অনেক প্রেসিডেন্ট বিশ্বে যুদ্ধের দামামা বাজালেও এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প ছিলেন ব্যতিক্রম। বরং তিনি বহির্বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। কিন্তু তার এসব ভালো কাজ ছাইচাপা পড়ে গেছে কেবল তার দাম্ভিকতা আর ঔদ্ধত্যের কারণে।
ডেমোক্র্যাট পার্টি ও জো বাইডেনের জন্য সামনের দিনগুলো কিন্তু মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। এখন স্বাস্থ্য সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, বর্ণবাদ সংকট, জলবায়ু সংকট এবং প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সংকট মোকাবিলায় ডেমোক্র্যাটদের গলদঘর্ম হতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং অনিশ্চয়তা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। এই অর্থনৈতিক ক্ষত ও ক্ষতি সারিয়ে তোলা হবে নতুন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ, কার্যকর টিকা উদ্ভাবনে বিনিয়োগ, টিকা ব্যবস্থাপনা, বৈষম্য নিরসন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, শিক্ষার্থীদের ঋণ, অভিবাসন এবং আরও অনেক বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ট্রাম্পের নীতি থেকে আমেরিকার মানুষ কি এবার মুক্ত হবে? আমেরিকানদের বিশ্বাস, জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় আমেরিকার মানুষ, সেই সঙ্গে বিশ্বের মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি, হুংকার ও বিরক্তিকর বক্তৃতা থেকে মুক্তি ও স্বস্তি পাবে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোতে এবার একটু বেশিই মাতামাতি হয়েছে। এর কারণও অবশ্য ট্রাম্প। শুধু মার্কিন নাগরিকেরাই নন, ট্রাম্প হেরে যাওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। কারণ ট্রাম্প গোটা বিশ্বকে করে তুলেছেন আগের তুলনায় আরো অনেক বেশি অনিরাপদ। তিনি ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি উদ্যোগের পথে সৃষ্টি করেছেন নানা জটিল সমীকরণ। সেখানকার দেশগুলোর মধ্যে বিভাজনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়। ট্রাম্পের চার বছরে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। ফলে জো বাইডেনের মূল চ্যালেঞ্জ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে পুনরুদ্ধার করা।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারের নির্বাচনে হারবেন, এ ব্যাপারে আমেরিকা বা বহির্বিশ্বে কোনো সন্দেহ ছিল না। মার্কিন জনগণ সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে দুটি মেয়াদে নির্বাচিত করেন। এটি করেন তারা সরকারের স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য। কোনো ব্যক্তি টানা আট বছর ক্ষমতায় থাকলে তিনি তার দেশ এবং সরকারের জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন। তার পরও যদি কোনো প্রেসিডেন্টকে জনগণ দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত না করেন, তাহলে বুঝতে হবে সেই প্রেসিডেন্টের দেশ শাসনে নিশ্চয়ই বড় কোনো গলদ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন ১১তম প্রেসিডেন্ট, যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ওভাল অফিস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না। নির্বাচনের ফল নিয়ে সংশয় না থাকলেও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কতটা অতীতের মতো প্রচলিতভাবে হবে, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না। কেননা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি। নির্বাচনের আগে কয়েক মাস ধরে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে হেরে গেলে ট্রাম্প বিজয় দাবি করবেন এবং জালিয়াতির অভিযোগ আনবেন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি বরাবরই তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভোট বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তিনি টুইট করে যাচ্ছেন যে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন। তার প্রচার শিবিরের আইনজীবীরা বিভিন্ন রাজ্যে মামলা করছেন, চেষ্টা করছেন কী করে ভোট গণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া যায়। তবে নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এ প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মার্কিন নির্বাচনের ফল চ্যালেঞ্জ করে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আইনি লড়াই শুরু করেছে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার শিবির। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের জয়ের দাবি প্রত্যাখ্যান করে এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই কেবল শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ও হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কেইলি ম্যাকএনানি গত ৯ নভেম্বর সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। শেষ এখনো অনেক দূরে। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের এই মুখপাত্র নির্বাচনে কারচুপির একগাদা অভিযোগ আনলেও জালিয়াতির তেমন কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি, যা ফল বদলে দিতে পারে। জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করলেও সোমবার ট্রাম্প ফের নির্বাচনের ফল মেনে নিতে আপত্তি জানান। অকাট্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি টুইটারে দেওয়া পোস্টে বলেন, ৩ নভেম্বরের ভোটে ‘অভাবনীয় ও অবৈধ কর্মকাণ্ড’ হয়েছে। ১০ নভেম্বর মঙ্গলবারও ট্রাম্প জয়ের আশা প্রকাশ করে এক টুইটে লেখেন, ‘আমরা জিতব।’ অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের পর থেকেই দাবি করে যাচ্ছেন, ভোট গণনায় কারচুপি হয়েছে এবং নির্বাচনে আসলে তিনিই জয়ী হয়েছেন। এবার এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় আইনজীবীদের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। তবে তিনি যখন এই নির্দেশ দিয়েছেন, তখনো সরকারিভাবে ভোট গণনা শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অ্যাটর্নিকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি দিয়েছেন উইলিয়াম বার। এতে তিনি বলেন, আমাদের ভোটদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তাই আমি নির্বাচনের ফলাফল সরকারিভাবে ঘোষণার আগেই ভোট-সংক্রান্ত অস্বাভাবিকতার তদন্ত করার এখতিয়ার আপনাদের দিচ্ছি। যদি এমন কোনো গুরুতর অস্বাভাবিকতার অভিযোগ এসে থাকে, যা কোনো রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে পারবে বলে আপনাদের ধারণা, সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তদন্ত ও পর্যালোচনা করা যেতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেলের চিঠি প্রকাশ্যে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচার বিভাগের নির্বাচনী অপরাধ দপ্তরের প্রধান রিচার্ড পিলগার পদত্যাগ করেছেন। এক ই-মেইল বার্তায় তিনি জানিয়েছেন, আফসোস নিয়ে এ পদ থেকে সরে দাঁড়ালাম। নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের অভিযোগ এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের তদন্তের নির্দেশ জারির ঘটনায় শেষ পর্যন্ত মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ট্রাম্প রীতি অনুযায়ী আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকবেন। যদিও নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার তার কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তবু এ সময়ের মধ্যে তিনি আবার কোন চাল চালেন, সে আশঙ্কা তো রয়েই গেছে। এ জন্য আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত কিছু দৃশ্যের অবতারণা হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার কোন ট্রাম্পকার্ড ছুড়ে মারেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।