নিজস্ব প্রতিনিধি : শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার সুযোগ বা প্রবাসে কাজের ব্যবস্থা পুরো বাংলাদেশকেই বদলে দিয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থান শুধু দেশে বেকারত্বই কমায়নি, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। স্বাধীনতার পরপরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদেশ যাওয়া শুরু হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য ওই সময়ের শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। তারই ধারাবাহিকতায় সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০১ সালে প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন, প্রবাসী ও বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করে সরকার।
একসময় শুধু পুরুষেরাই কাজের জন্য বিদেশে যেতেন। গত কয়েক বছরে নারীদের বিদেশ গমনও বেড়েছে। বিদেশে তাদের জীবন আরও কঠিন। দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও অনেকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক পান না। শারীরিক, মানসিক নির্যাতন তো আছেই, যৌন নিপীড়ন, এমনকি ধর্ষণের শিকারও হন অনেকে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭২টি দেশে কাজ নিয়ে যান বাংলাদেশিরা। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে ৫ থেকে ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে যান। তাদের বেশির ভাগই যান অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। তবে অন্যান্য ভিসা মিলিয়ে ২০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান বলে জানাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এর পরই রয়েছে ওমান, কাতার, বাহরাইনের মতো দেশগুলো। জর্ডান, সিঙ্গাপুর, ইতালিতেও কর্মী যাচ্ছেন। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ একসময় বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। এখনো এসব দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন।
করোনা মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিতে যখন দেশজুড়ে ক্ষোভ-হতাশা এবং আগামী দিনগুলোতে কী হবে -এই প্রশ্ন সবার মধ্যে, তখন চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের কথাও। ভরা করোনা মহামারির মধ্যেও ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার রেমিট্যান্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১০০ কোটি ৮৭ লাখ (১ বিলিয়নের বেশি) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ৮৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। শতাংশ হিসাবে বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে বেশি ছিল ১২ শতাংশ। পরের মাস আগস্টে পাঠান ২০৩ কোটি ৭৮ (২.০৪ বিলিয়ন) ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। এই দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ৪১৩ কোটি ৪১ লাখ (৪.১৩ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ছিল ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের আড়াই মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) ৫১৪ কোটি ২৮ লাখ (৫.১৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দর ১০৮ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা।
পক্ষান্তরে বিদেশগামী শ্রমিক যেমন বাড়ছে, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। ঢাকার বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। করোনার আগে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আট হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতেন। ২০০৯ সালের চেয়ে এ সংখ্যা প্রায় তিনগুণ। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, গণিত ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যতম গন্তব্য যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব কমই কাজের সুযোগ পান। যারা স্কলারশিপ নিয়ে যান, তাদের ছাড়া বাকি সবাইকে দেশ থেকে টাকা নিতে হয়। দেশ থেকে টাকা নিয়ে লেখাপড়া করে তাদের বেশির ভাগই ওইসব দেশে স্থায়ী হন। একসময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সে দেশে নিয়ে যান। একপর্যায়ে তারা পৈতৃক সম্পদ বিক্রি করে সেই টাকাও নিয়ে যান।
এদিকে কোটি প্রবাসী শ্রমিক বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে দেশকে বদলে দিলেও নিজেদের ভাগ্যের চাকা বদলাতে পারেননি তারা। গরিব এই শ্রমিকেরা কেবল দেশ ও দেশবাসীকে দিয়েই চলেছেন, বিনিময়ে দেশ থেকে তারা কিছুই পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রবাসে নানা কারণে আসা ধনী বা পেশাজীবীরা দেশকে তো কিছু দিচ্ছেনই না, উল্টো দেশের টাকা প্রবাসে নিয়ে আসছেন। এই ধনীদের বেশির ভাগ কেবল নিতে জানেন, দিতে জানেন না। ইদানীং ইউটিউবে এ-সংক্রান্ত একটা ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার ভিডিও এটি। বক্তৃতার বিষয় ‘অভিবাসী শ্রমিকদের দেশপ্রেম আর ধনী বা পেশাজীবীদের দেশকে ঠকানো’।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওই বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আজকে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূল ভিত্তি হচ্ছে এই দেশ থেকে শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাওয়া প্রায় এক কোটি মানুষ। এই দেশ তাদের কিছুই দেয়নি। এই দেশের কাছে তাদের কোনো ঋণ নাই। কিন্তু বিদেশে গিয়ে তারা তাদের বাবা-মায়ের জন্য, সন্তানের জন্য টাকা পাঠায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আজকে যে রিজার্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটা হচ্ছে তাদের কারণে। দেশের অর্থনীতি যে স্টেবল (স্থিতিশীল), তার কারণও সেই প্রবাসী শ্রমিকরা।’
অন্যদিকে ধনী বা পেশাজীবীদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের শিক্ষিত লোক যারা বিদেশে গেছেন, বিশেষ করে প্রফেশনাল (পেশাজীবী) যারা বিদেশে গেছেন, তারা কিছু পাঠান না। তারা অনেকেই ওখানে অনেক বড় বেতনে চাকরি করেন। দেশের গরিব মানুষের টাকা দিয়ে তারা পড়াশোনা করেছেন। এরপর বড় ডিগ্রি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ওই দেশে গিয়ে তারা অনেক টাকা রোজগার করেন। কিন্তু সেই টাকা দেশে পাঠান না। তারা উল্টো এ দেশ থেকে নিয়ে যান। তাদের বাবা মারা গেলে বাবার বাড়ি বা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নিয়ে যান।’
এর বিপরীত চিত্রের কথাও বলেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেছেন, ‘বদিউল আলম মজুমদার বিদেশে ছিলেন, ফজলে হাসান আবেদ, অধ্যাপক ইউনূসও বিদেশে ছিলেন। কিন্তু তারা স্থায়ীভাবে থাকেননি, তারা দেশের মায়ায় চলে এসেছেন।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এ বক্তব্য হাঙ্গার প্রজেক্টের ১৬তম জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া। সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র মিলনায়তনের সেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বদিউল আলম মজুমদার নিজেও। হাঙ্গার প্রজেক্ট ছাড়াও তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লারমন্ট গ্র্যাজুয়েট স্কুল থেকে স্নাতকোত্তর এবং কেস ওয়েস্টার্ন রিভার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সিয়াটল ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া কিছু সময় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। সব ছেড়ে ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘শ্রমিকরা দিয়েই যাচ্ছে, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে বিদেশে অবস্থানরত পেশাজীবীদের অবস্থা দুদিক থেকেই দেখা যায়। তাদের একটা বড় অংশ দেশ থেকে নিয়ে যান এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হচ্ছে তাদের অনেকেই দেশে ফেরার পরিবেশ পাচ্ছেন না। আমরা সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি। স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পেলে তাদেরও অনেকে ফিরতেন।’ তার ভাষায়, ‘বিদেশে স্থায়ী হওয়া বাংলাদেশি পেশাজীবীদের চেয়েও খারাপ একশ্রেণির ব্যবসায়ী। তারা দেশের গরিব শ্রমিকদের ঠকিয়ে নিজেরা ধনী হচ্ছেন। অন্যদিকে সরকার থেকে প্রণোদনা পাচ্ছেন। দুইয়ে মিলে ফুলেফেঁপে উঠছেন। সেই ধন তারা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। একসময় তারা বিদেশে গিয়ে থিতু হচ্ছেন।’ বিদেশে অবস্থানরত পাচারকারী বাংলাদেশিরা আরও খারাপ বলে মন্তব্য করেন তিনি।