তপন দেবনাথ : অসুখে পড়লে শারীরিক কষ্ট যেমন পেতে হয়, তেমনি আবার আপন-পরও চেনা যায়। দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগছি। ভুগতে ভুগতে এমন দশা হয়েছে যে অসুখ শরীরে স্থায়ী একটা বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। এ নিয়েই জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আসলে দমটা একদম ফুরিয়ে না গেলে জীবনটা কোনো না কোনোভাবে চালিয়ে নিতেই হয় এটাই বোধ করি জীবনের ধর্ম।
আমার জীবনে যতগুলো দুঃখ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো জ্ঞানের অভাব। ভগবান আমাকে কেন এত কম জ্ঞান দিয়ে সৃজন করলেন, তা আমার বোধগম্য নয়। যদি আরেকটু জ্ঞান থাকত, যদি সহজেই মানুষের ছলচাতুরী ধরতে পারতাম, যদি আবেগটা আরেকটু কম থাকত, তাহলে কতই না ভালো হতোÑকত অপমান থেকে বেঁচে যেতে পারতাম, কত বিরহ-বিচ্ছেদ এড়াতে পারতাম।
গত কয়েক মাস ধরেই একজন লোক একটি বিষয় নিয়ে আমাকে অনুরোধ করে আসছিলÑদাদা, আপনাকে আমাদের সংগঠনের সদস্য করতে চাই।
আমার জ্ঞান-গরিমা আমার বেশ ভালোই জানা আছে। তার ওপর ওই সংগঠনের রাজকীয় পদটি অলংকৃত করতে গিয়ে কোন বোকামির পরিচয় দিই ভেবে বারবার না বলছিলাম। অনুরোধে ঢেঁকি গেলা প্রবাদটি পাশ কাটিয়ে বলা যায়, পছন্দ না হলে অনুরোধে ঢেঁকি কেন, জলপান থেকেও বিরত থাকুন। বুকে জল আটকে মানুষের মৃত্যুও কোনো বিরল ঘটনা নয়। এই যে সেরেছেÑজ্ঞান দিয়ে ফেললাম যে!
তো বারবার অনুরোধে আমি রাজি হয়ে যাই। এমন একটি সময়ে আমি রাজি হই বা কাগজে সই করি, যখন আমি শয্যাশায়ী। তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি যে আমার অসুস্থতাকে তারা কতটা অবজ্ঞা করেছিল। তাদের প্রয়োজনের কাছে আমার সুস্থ থাকা বা শয্যাশায়ী যাওয়া ছিল অতি তুচ্ছ। হায় নিয়তি! মানুষ কি আসলে এমনই হয়। না তো। এমন হয় না। এক-দুজন মানুষ নিয়ে জগৎ-সংসার গঠিত নয় যে।
রাজকীয় পদটি অলংকৃত করার পর পরই শুরু হয় হুকুম তামিল পর্ব। সুস্থ বা অসুস্থ, যা-ই হই না কেন হুকুম তামিল করেই যাচ্ছিলাম। ও মা, একদিন দেখতে পেলাম, আমি আর নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমার চারপাশে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিসের ছড়াছড়ি। আমি তো এমনিতেই জিরো, তার ওপর এসব মহাজ্ঞানীর রাজদরবারে আমার উপস্থিতি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু বলেই আমার বোধগম্য হলো।
কারো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা যদি আলসারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে আর তাকে যদি গরম কড়া কফিপানে বাধ্য করা হয়, তার ফলাফল যে কেউ অনুধাবন করতে পারবে। মহাজ্ঞানীদের কাছে নিজেকে যখন একেবারেই বেমানান লাগছিল, সিদ্ধান্ত নিলাম পদত্যাগ করব। কারো প্রতি বিতৃষ্ণা নয়, নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার প্রত্যয় নিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম।
আমার অনুমানের মধ্যেও ছিল না যে পদত্যাগপত্র জমা দিলে আমি এমন তাচ্ছিল্যের শিকার হব বা হতে পারি। সত্যি বলতে কি, শিক্ষার সঙ্গে শিষ্টাচার না থাকলে যা হয় আরকি। এমন খেলনার পাত্র হতে হব জানলে পদত্যাগপত্র জমা দিতাম না। দিন দিনই তাদের নিচুতা আমাকে দিশেহারা করে তুলেছিল। নিয়তির লিখন হোক আর ভাগ্যের বিড়ম্বনা হোক, ছলনাকারীদের সাথে আমি কিছুতেই কুলাতে পারছিলাম না। ফলাফল যা হবার তা-ই হলো, বারবার শয্যাশায়ী।
ছলনাকারীদের থেকে একটি মেসেজ পেলাম যে আমার পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করতে তারা অপারগ। এর কারণটি কি হতে পারে এ রকম যে আমি একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিধায় আমাকে হাতছাড়া করলে তারা কানা হয়ে যাবে? না, মোটেও সে রকম নয়। আমি কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নই। তাহলে? তামাশা! আমাকে নিয়ে তামাশা খেলা হচ্ছে। আমাকে নিয়ে তামাশা খেলা হচ্ছে বুঝতে পারছি কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।
যখন আমাদের কিছু করার থাকে না, তখন আমরা নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিই। ভাগ্য যেদিকে নিয়ে যায় যাবে এই ভেবে সান্ত¡না খুঁজি।
ভাগ্য যেদিকে নিয়ে যায় যাক, সেটা ভাগ্যের সুবিচার। যখন দেখলাম যে সংগঠনটির কার্যকলাপ অষ্টম শতাব্দী ছাড়িয়ে গেছে, তখন শঙ্কিত না হয়ে পারলাম না। মামলা- মোকদ্দমা আমার চারপাশে কক্ষপথের মতো ঘুরছে বলে অনুমেয় হলো। আর সে রকম কিছু যদি হয় সেটা হবে আমার জন্য আরো বিরাট বিপর্যয়। দার্শনিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে আমার। অভিযোগকারীদের অভিযোগÑআমি যেন কিছু একটা করি। কিন্তু তাদের বোঝাতে পারছি না যে আমি অসহায়। কিছু করা আমার সাধ্যের বাইরে। বিপদ আমার সন্নিকটে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমি যে সংগঠনের সাথে আছি, সেটা প্রমাণিতÑআমি যে নেই সেটা প্রমাণ করতে পারছি না। আমার অবস্থান এখন মাইনকার চিপায়। দূরদর্শিতার অভাব থাকলে কী পরিণতি হতে পারে, সেটা উপলব্ধি করছি আমি।
মানুষ হাসানোর কাজটি করতে পারছি না বলে কষ্টটা বোধ হয় বেশি পাচ্ছিলাম। কোনো গত্যন্তর না দেখে ফেসবুকের আশ্রয় নিলাম। কাজটি আমার মজ্জাগত নয় কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে এ কাজটি করতে হলো আমাকে। ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলাম আমি ওই সংগঠনের পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি, ওই তারিখ থেকে ওই সংগঠনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
দুই দিন পর বেচারা ভগবান কাঠগড়া থেকে মুক্তি পেলেন। ভগবান আমাকে কোনো বুদ্ধি দেননি বলে যে অভিযোগ করেছিলাম, তা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করে নিলেন। অর্থাৎ সংগঠনের পক্ষ থেকে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়া হলো যে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং অন্য একজনকে ওই পদে স্থলাভিষিক্ত করা হলো।
কয়েকজন আবার এটিকে ফেসবুকে একটি বীরোচিত কাজ বলে মন্তব্য করল। আমি হাসতে ভুলে গেলাম। আমার কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী কারণ জানতে চাইলে আমি নানা কৌশলে এড়িয়ে গেলাম। ‘সে তো মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’ বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। আসলে আমি যে কত কিছু করতে পারি না তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
মরতে মরতেই এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। বিনা দোষে কারাবাস করার পর মুক্তির যে আনন্দ, আমি সে আনন্দ লাভ করলাম। ঘটনাটি এ রকম না হলে আমাকে আরো অবজ্ঞার সম্মুখীন হতে হতো। মজার ব্যাপার হলো, আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না জানিয়ে দেওয়ার পর আমি ফেসবুকের আশ্রয় নেওয়ায় কেন ফেসবুক মারফত অব্যাহতি দেওয়া হলো, তা আমার বোধগম্য নয়।
মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরে খুব ভালো লাগছে আমার। গত কয়েক মাস যাবৎ বুকটা খুব ভারী হয়ে ছিল। আমি এখন পাখির মতো মুক্ত। পাখি যেমন তার ডানার ওপর ভরসা রাখে, ডালের ওপর নয়Ñআমি এখন নিজের ওপর ভরসা রাখি, সংগঠনের ওপর নয়।
অন্য একটি সংগঠনের সাথে ছোট মেয়েকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ৪০-৫০ মাইল দূরে লেক প্যারিসে বনভোজনে গেলাম। পাহাড়ঘেরা লেক, বেশ মনোরম দৃশ্য। আমার ভালো লাগল। বুকটা এখন খুব হালকা বোধ করছি। আগের মতো নিঃশ্বাস ভারী লাগছে না। পরিচিত-অর্ধপরিচিত-অপরিচিত লোকজনের সাথে এক দুপুর ভালোই কাটল। বনভোজন পর্ব শেষে আমরা চিনো হিলে স্বামী নারায়ণ মন্দির পরিদর্শনে রওনা হলাম। এ মন্দিরটির নাম এর আগে আমি শুনেছি, তবে কখনো যাওয়া হয়নি। ভারতীয়দের দ্বারা মন্দিরটি পরিচালিত। মন্দির দর্শনে মুগ্ধ হলাম। এত কারুকাজখচিত কোনো স্থাপনা এর আগে দেখেছি বলে মনে হয় না। মানুষের মনে কত সৌন্দর্য লুক্কায়িত থাকে, শিল্পের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে। স্বামী নারায়ণ মন্দিরের ভেতরের কারুকাজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর, স্থাপত্য কাজগুলো কতটা দৃষ্টিনন্দন।
মন্দির পরিদর্শন শেষে সবাই ঘোরাঘুরি করছে। সন্ধ্যা হতে এখনো দেরি আছে। মন্দির কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সবাইকে ডিনার করাবে। ডিনারের পর লস অ্যাঞ্জেলেসের উদ্দেশে গাড়ি ছাড়বে। সবাই হাঁটাহাঁটি করছে। কেনাকাটা করছে। আমি মেয়েকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, কিছু কেনাকাটা করে ঘাসের ওপর বসে আছি। ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে।
কত বছর যাবৎ ঘাসের ওপর বসা হয় না। মনটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলো। মুখোমুখি, সামনাসামনি কত বিকেল যে কেটেছে ঘাসের ওপর বসে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে কত দিন। কত চীনাবাদামের দশাসই হয়েছে। এত কোলাহলের মধ্যেও মনটা ফিরে গেল অতীতে। কিছুক্ষণের জন্য যেন একা হয়ে গেলাম। দেবযামীকে অনেক আগে থেকেই আমি চিনতাম। সে ও তার পরিবার আমাদের সাথে বনভোজনে এসেছে। আমরা একই গাড়িতে ছিলাম। এমনিতে দেখা-সাক্ষাৎ খুব বেশি একটা হয় না। কোনো অনুষ্ঠানাদি হলেই কেবল দেখা হয়। ফেসবুকে খুব অ্যাকটিভ সে। বেশ দরকারি পোস্ট দেয় ফেসবুকে। পরোপকারী ও সংগ্রামী মহিলা বলেই তাকে আমার মনে হয়। তার স্ট্যাটাসে কীভাবে দুঃখকে জয় করতে হয় সে রকম বার্তা পাওয়া যায়। আমি সেগুলো পড়ি এবং লাইক দিই।
আমাকে একা বসে থাকতে দেখে সে আমার খুব কাছে চলে এল এবং আমার সামনাসামনি মুখ করে ঘাসের ওপর বসল। বিকেলটি কেমন যেন নানা রঙে ঝলসে উঠল। হাত জোড় করে প্রণাম করল দেবযামী আমাকে। তারপর সহাস্যে বলল, অতুলদা আপনার শরীর ভালো এখন? কী হয়েছিল আপনার?
আমার যে কিছু হয়েছিল, সেটা আমার মনে আছে। বলতে গেলে বেশ ভালো করেই মনে আছে কিন্তু আমার অসুখের খবর দেবযামী জানল কী করে? আমি তো তাকে বলিনি কোনো দিন। তা ছাড়া তার সাথে তো আমার দেখা-সাক্ষাৎও তেমন হয় না, ভাবলাম আমি। দেবযামী এমন করে আমার সামনে মুখ করে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল যে আমরা যেন কতকালের পরিচিত, কত আপনজন। তার ঘনিষ্ঠতা আমাকে রোমাঞ্চিত করেনি, মুগ্ধ করেছে তার অন্তরঙ্গতা, আমার অসুস্থতার খবর জানতে চাওয়া। দেবযামী হাসছে। সে হাসিতে কোনো কৃত্রিমতা নেই, প্রাণোচ্ছল সে হাসি।
হাত জোড় করে দেবযামীর প্রণামের জবাব দিয়ে বললাম, এখন অনেকটা ভালো আছি। আমার অসুখের খবর আপনাকে কে বলল?
কেন অতুলদা, ভুলে গেলেন? ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন না ওই সংগঠনের পদ থেকে পদত্যাগ চেয়ে, তখনই তো অসুস্থতার কথা লিখেছিলেন? আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। ও তাই তো, হো হো করে হাসলাম আমি। এত দিন পড়েও আপনি মনে রেখেছেন?
মনে রাখব না? আমার সম্পর্কে তার জানতে চাওয়ার কৌত‚হল অদম্য। এখন অনেকটা ভালো আছি। তবে পুরোটা সারেনি। আমার সম্পর্কে কী কী শুনেছেন বলুন তো?
কী কী শুনেছি সে কথা না হয় না-ই বললাম। আপনার কী অসুখ হয়েছিল, বলুন তো? মৃদু হাসি তার মুখে, যেন আমার সব অসুখ সে এখনই সারিয়ে তুলবে।
কেন, চিকিৎসা করবেন নাকি? একটু হাসলাম আমি। দেবযামী তো হেসেই যাচ্ছে। বললাম, অনেকগুলো অসুখ হয়েছিল আমার। কয়েকটা অসুখের নাম বললাম।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে দেবযামী বলল, বুঝে গেছি। একদম ভুলে যান আপনার অসুখের কথা। মনে করুন, আপনার কোনো অসুখই হয়নি। যতই অসুখ অসুখ করবেন অসুখ আপনাকে চেপে ধরবে। স্ত্রী-কন্যা-পরিজন, সবার কথা ভুলে যান। মনে রাখবেন, আপনার জন্যই তারা, তাদের জন্য আপনি নন।
দেবযামীর শেষ লাইনটি আমাকে শিহরিত করল। ভেতরে ভেতরে আমার কাঁপন শুরু হয়ে গেছে। বলে কী মহিলা, স্ত্রী-কন্যার কথা ভুলে যাব? একি নিষ্ঠুরতা নাকি নিরেট বাস্তবতা? নাকি জীবনের অভিজ্ঞতা? হ্যাঁ, সামনের দিকে মাথা ঝাঁকায় দেবযামী। আপনি আছেন, সব আছে। আপনি নেই, কিছু নেই। আমারও কঠিন অসুখ হয়েছিল একবার। অসুখ হলে আপন-পর চেনা যায়। যাদের জন্য আমার অসুখ হয়েছিলÑআমার অসুস্থতার সময় তাদের কোনো সহমর্মিতা আমি পাইনি। আমি তো প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন বুঝতে পারলাম, জগতে কেউ কারো নয়। যাদের জন্য আপনার আজ এ অবস্থা, এখন দেখবেন তারা কেউ আপনার পাশে নেই। শুধু শূন্যতা, শুধু হাহাকার। এখন দেবযামীকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। তার সব দুঃখগুলো যেন একসাথে প্রকাশিত হতে চায়। কিন্তু আমি তো জানি না তার দুঃখগুলো কী।
দেবযামীর কথায় আমার যেন চোখ খুলে যাচ্ছে। আমি অবাক বিস্ময়ে তার কথা শ্রবণ করছি। সে আমাকে আরো বলল, ওষুধ একদম খাবেন না। লতাপাতা-শাকসবজি বেশি করে খাবেন। দেবতাকে মানুষ যেভাবে প্রণাম করে, ঘাসের ওপর সেভাবে প্রণামের কায়দায় দেবযামী আমাকে একটি যোগব্যায়াম শিখিয়ে দিল। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে একজন পুরুষ মানুষের সামনে এভাবে যোগব্যায়াম করলে শরীর অনাবৃত হতে পারে বা শরীরের গোপন অঙ্গ দেখা যেতে পারে।
আমি দেবতা হয়ে যাইনি কিন্তু দেবযামীর গোপন কোনো বস্তু আমার নজরে পড়লেও আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। এ মুহূর্তে আমার কাছে সে এক অন্য মানুষ। তার উচ্ছল, প্রাণবন্ত অনুপ্রেরণাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করছে। ভেতরে ভেতরে মরে যাওয়া মনটা সজীব হয়ে উঠছে। মনে মনে বললাম, দেবযামী এত দিন পরে আভিভর্‚ত হলে তুমি? কোথায় ছিলে এত দিন? জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি আমার মনে পড়ল।
মেয়েটা আবার দূরে যায় কি না তাকে চোখে চোখে রাখছি। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেবযামী বলল, বললাম না আপনার সমস্যা বুঝতে পেরেছি। একদিন তো মেয়েরা চোখের আড়ালে চলে যাবেই। সেদিন কি একা থাকবেন না? মনকে শক্ত করুন। মন শক্ত না করলে রোগ সারবে না। আপনার বাৎসল্য খুব বেশি।
মেয়েরা সত্যি সত্যি একদিন দূরে চলে যাবে। যেতে দিতেই হবে। কীভাবে কাটবে আমার দিনগুলোÑভাবতেই মনটা আবার ভারাক্রান্ত হলো। জগৎকে মায়া দিয়ে বেঁধে রাখতে চান অথচ জগৎ শক্ত পাথরে গঠিত। দেবযামী তার অসুখের কথা, সেরে ওঠার প্রচেষ্টার কথা বলেই যাচ্ছে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি।
কয়েক মিনিট ধরে মেয়েটাকে দেখছি না। আমার উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে। অচেনা জায়গা, অপরিচিত লোক…। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। দেবযামীর কথায় মনোযাগ দিতে পারছি না এখন। আমার মনের অবস্থা দেখে দেবযামী বলল, চিন্তা করবেন না। এক্ষুনি চলে আসবে। এখান থেকে আর যাবে কোথায়?
কয়েক সেকেন্ড পরই মেয়েটা চোখের সামনে এল। আমি মেয়েকে উদ্দেশ করে বললাম, চোখের আড়াল হবে না, মা। আমরা একটু পরই চলে যাব। আমার দিকে তাকিয়ে দেবযামী মৃদু হাসল। তার এবারের হাসির কোনো কারণ আমি বুঝলাম না। আমার হাত ধরে টেনে দেবযামী আমাকে দাঁড় করাল। চলুন তো একটু হেঁটে আসি।
আমি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। পরস্ত্রী পরপুরুষের হাত ধরে আছে। তার স্বামীও এখানে কাছাকাছি আছে, সমাজ-সংসার-নিন্দা, কোনো কিছুই দেবযামীকে স্পর্শ করছে না। আমাকে হেঁচকা টান দিল দেবযামী। আমি শুধু গোঁৎ গোঁৎ করে বললাম, দিদি, দেবযামী। শুকিয়ে যাওয়া গোলাপটা যেন জলের ছিটা পেয়েই তরতাজা হয়ে উঠল।
আমি অশ্রæসিক্ত হয়েছিলাম কি না আমার ঠিক মনে পড়ছে না, তবে ভেতরটা কেমন ছলাৎ ছলাৎ করছিল বলে মনে পড়ছে।
-লস অ্যাঞ্জেলেস।