গহনা

জর্জেস মোহাম্মদ :

ভবানীবাবুর বাড়ি। ভবানী কুমার রায়। নামে ডাকে কে না জানে? জ্ঞান, অর্থ, ব্যবহারের কথা হিন্দু-মুসলমান সমানভাবে জানে। ভেতর বাড়িতে বড় উঠোন, সদর দরজায় কোনো কপাট নেই, কিন্তু ভিক্ষুকও জানে বাড়িতে ঢোকা নিষেধ। এত বড় বড় ঘর, দাস-দাসী, অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ বাড়ির ভেতরেই, বাইরে নয়। দাসীদের কেউ একটা গান ধরলে দাসদাসীদের তর্ক ওঠে তুঙ্গে। গানটা কার লেখা হবেÑরজনীকান্ত না অতুলপ্রসাদ, যতক্ষণ খুড়িমা এসে বণ্টন না করে। এটা তো রবিঠাকুরের। সুখের হই-হুল্লোড়ের বাসা। টিনের চালে চালকুমড়া চুনের প্রলেপ আটা। দরজার ধারে ডালিমগাছে থোকা থোকা ডালিম, রয়নাগাছে ময়না। আনন্দ আর আনন্দ। এ বাড়ির শান, এ বাড়ির মান, পরিবারের সন্তান, ভবানীবাবুর একমাত্র কন্যা, বাড়ির গহনা রাজলক্ষ্মী।

রাজলক্ষ্মী আজ যাবে না বাড়িতে, অর্থাৎ ভেতর বাড়িতে। সারা দিন শান-বাঁধানো পোস্তার ওপর বসে থাকবে। জলপাইগাছের নিচে। পোস্তাটা তার অতি প্রিয় জায়গা। প্রত্যেক মানুষের একান্ত নিজস্ব একটা জায়গা মনের মাঝে গেঁথে থাকে। কেউ প্রকাশ করতে পারে, কেউ পারে না। কেউ উপভোগ করতে পারে, কেউ পারে না। রাজলক্ষ্মী উপভোগ করে তার একান্ত নিরিবিলি বিলাসী পোস্তাটি। কত যুগ আগের কামিনিগাছটা এখনো ঠাঁই দিয়ে যায় লাল-সবুজ পিঁপড়েকে, কোনো অভিযোগ নেই। পোস্তাটির অর্ধেকের বেশি ডুবে গেছে মাটির নিচে, বাকিটুকুর কিছু শেওলাপড়া, সুন্দর শেওলা কারুকাজ।

সামনে ফল বাগানের পরেই বিশাল ধু-ধু মাঠ, পুবালি হাওয়ায় ঢেউ খেলে যায়, কিশোরী ধান শস্যের গায়। গ্রামের বাড়িতে এলে সাদামাটা পোশাক পরে সে। আজও পরেছে সাদা সেমিজের ওপর হালকা সবুজ পাঞ্জাবি। হাতের কারুকাজ সাথে পায়জামা আর সতীনাথের স্যান্ডেল, বাবা এনেছে বিক্রমপুর থেকে। খোলা চুলে মাথার এপাশ-ওপাশ ব্যারেড খিচানো। অপরূপা শিক্ষিতা যুবতী। জ্ঞানের আলোর সাথে যুবতীর রূপ মেশানো কষ্টসাধ্য। বেশির ভাগ রূপসী রূপচর্চায় প্রাধান্য দিয়ে থাকে। জ্ঞানচর্চায় নয়। রাজলক্ষ্মী আঁকড়ে ধরেছে দুটোই, যেমন শিক্ষায়, তেমনি রূপচর্চায়।

যেটুকু রোদের তাপ আসে পাতাবাহারের লুকোচুরি খেলা শেষে, বড়ই মিষ্টি লাগে সেই পোস্তায় বসে। ঘন ঘাসে ঘেরা পোস্তাটি দেখতেই মনে হয়, যেন ঘন জঙ্গলের মাঝে মরূদ্যান। পিঁপড়ে ও ঘাসপোকারা বিচরণ করে, যেমন মরুতে উটেরা সারি বেঁধে বড় বড় বোঝা পিঠে হেঁটে চলে। পিঁপড়াও সামর্থ্যরে বেশি বোঝা কাঁধে পোস্তার এপাশ-ওপাশ করে, সারি সারিতে বড় ব্যস্ত জীবন ওদের, কেউ আগে কেউ পরে। সবারই কাজ, কিসের যেন তাড়া। লাল বড় পিঁপড়ে হানা দিলে পথ ছেড়ে দেয়। মনে হয়, মরুর দস্যুরা হানা দিয়েছে। আবার নিয়ম মেনে চলা, সোজা সারি বাঁধা। ছোট ছোট পাতা কাটা ঘাড়ে তুলে ধায়, যেমন চলে নির্মল বায়ুতে পালতোলা নায়।

ওদের কোনো কষ্ট না দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে, দেখে ওদের ব্যস্তময় জীবন। মনে হয়, ওরা যেন আজীবন সাথি। একটুও জায়গা হবে না, বসার মতো একটু জায়গা রাখেনি আজ। দু-একটা বেহিসাবি বেড়ে ওঠা ঘাস
পোস্তা দখলে উদ্যত। তবু পাশ কেটে বসেছে রাজলক্ষ্মী, তার প্রিয় পোস্তার

ওপর। জগতের অন্যান্য শালিন যুবতীর মতো বসার আগে বাম হাতে পাছাটা পরিষ্কার করে নিতে ভুল করল না।
কেন শান্ত স্বভাবের মেয়েরা ট্রেনে, বাসে অথবা ক্লাসে বসার আগে ডান অথবা বাম হাতে পাছাটা পরিষ্কার করে নেয়। হয়তো শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজের ইস্ত্রির ভাঁজ ভেঙে যাওয়ার ভয়। হয়তো মানসিক প্রশান্তি।

এগাছ-ওগাছের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ মন। অপূর্ব এই সৃষ্টি। গাছের পাতা, নানা রং নানা সাজে সাজানো। ফুল, ফুলের কলি, ছোট-বড় ফল, মৃদু বাতাসে ছোট ছোট দোল, রূপের ভার সহে নাÑএসবই গাছের গহনা। আর আকাশ? সে তো অতি ব্যস্ত নিজেকেই সাজাতে। আকাশের গহনা তার নানা ঢঙ্গের গর্বিত মেঘমালা। ঘোড়ার মতো, ভেড়ার মতো, পাহাড়ের মতো, তুলার মতো কতই না তার রূপ। রবির প্রখরতায় সাজানো আকাশ। অপূর্ব…। রাতে সাজে তারার মালায়, শশীর ভাষায়। আকাশের গহনা রবি, শশী, তারা, মেঘমালা। গাছের গহনা শাখা-প্রশাখা, পাতা ও তার রংÑকতই সুন্দর। কচি পাতা চিকচিক আলো। আর ফুল ও ফল বলাবাহুল্য। নদীর গহনা ছোট-বড় ঢেউ, দু’ধারে কাশবন, পালতোলা নাও। মানুষের গহনা মানুষ নিজেই। তার চোখ, নাক, ঠোঁট, দাঁত যতই সুন্দর হয়, সবাই তাকে সুন্দর বলে। গাছ, লতাপাতার সৌন্দর্য একতরফা, শুধু বাইরের সুন্দর দেখেই সুন্দর বলে থাকি। গুণাগুণ পরখ করি না। মানবের সৌন্দর্য শুধু বাইরেই নয়, ভেতরেও বটে। যার মন সুন্দর ও বাইর সুন্দর, চলন ও বলন সুন্দর, সে-ই প্রকৃত সুন্দর। মানুষ যদি তার গহনাকে সযতনে রাখে, পরিচর্যা করে, পরিধান যাই করুক না কেন, তার সৌন্দর্য গোপন থাকে না। প্রকাশ পায়। মানব একটা চলমান গহনা।

দেশের গহনা নাগরিক। নাগরিক যত শিক্ষিত, মার্জিত হবে দেশের প্রচার-প্রসার, সুনাম বিশ্বময়। রাজলক্ষ্মী ভবানীবাবুর সংসারের গহনাই নয়, সে এ গাঁয়ের গহনা। প্রতিটি শিশুই প্রতিটি পরিবার ও জন্মভূমির গহনা। সুন্দরভাবে ঘষেমেজে সাজিয়ে রাখলেই পরিবার ও দেশের মুখ উজ্জ্বল হয়।
বড়দের মুখে একই কথা। হেঁশেলে, ঘাটে, উঠোনে গোপনে গোপনে রাজলক্ষ্মীর বিয়ে। অতি গোপনে সবাই জানে কিন্তু না জানার ভান। ওপার বাংলায় এপার বাংলার মেয়েদের অনেক সম্মান। যাওয়ার সাথে সাথেই ভালো পাত্র মিলে যায়। কৌলিন্যের বালাই নেই। এ বাংলায় নমশূদ্র জাতভেদ দিনক্ষণের বালাই এখনো বিদ্যমান। ওখানে দপ্তর ছুটির দিনই শুভ দিন। যাদের বসত আজ ওখানে, একসময় অনেকেরই পোরখ ছিল এ মাটিতে। মনের টানে, মাটির টানে, মনের অজান্তেই মন খুঁজে বেড়ায়, কেউ একজন জন্মেছে সেই নাড়িপোঁতা গায়। তারই একটা রূপ।

সবাই জানে রাজলক্ষ্মী যাবে ঢাকায়। কেউ কেউ জানে কোথায়, সুদূর কলকাতায়। বুড়িরহাট থেকে যশোর বেনাপোল, শিয়ালদা থেকে বনগাঁয়। খসে পড়ল আরও একটি গহনা, এ গাঁয়ের কন্যা। এ ভূমির গহনা। মন থাকে সেই পোস্তার আঙিনায়, দেহ হাটে আরও অজানায় সুদূর বনগাঁয়। এ গাঁয়ের গহনা রাজলক্ষ্মী শোভা বাড়ায় অন্য দেশের ভূমিতে। যদিও অজানা, তবু মানিয়ে নেয়।