গুজবের পেছনে ছুটছে দেশ

নিজস্ব প্রতিনিধি : গুজব। দেশ-বিদেশে খুবই পরিচিত এক শব্দ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে একদল লোক গুজব ছড়িয়ে থাকে। গুজব বা অলৌকিকতার প্রতি মানুষের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। বাংলাদেশে এই আকর্ষণ অত্যন্ত প্রবল। এসব নির্দোষ হলে কিছু বলার থাকে না। কিন্তু অনেক সময়ই এগুলো অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে।
কোরআন শরিফ অবমাননা, পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, জামায়াত নেতা সাঈদীকে চাঁদে দেখা, ডেঙ্গু প্রতিরোধে হারপিক, মধু দিয়ে মদ খেলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি-এ রকম নানা গুজবের পেছনে ছুটছে বাংলাদেশের মানুষ। বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে এবং বহু মানুষ এর পেছনে ছুটছে। প্রকৃত ঘটনা না জেনেই হুজুগে মেতে উঠে তারা বিক্ষোভ, ভাঙচুর এমনকি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটিয়ে চলছে।

সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দর কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ তুলে শহিদুন্নবী জুয়েল নামের এক নিরীহ যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে গুজবে বিক্ষুব্ধ অতি উৎসাহী জনতা। পরে তার লাশ পুড়িয়েও ফেলে তারা। অথচ পরে জানা যায়, রংপুরের শালবনের বাসিন্দা জুয়েল কোরআন অবমাননা তো করেনইনি, ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ধার্মিক এবং তিনি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন।
এ অবস্থায় অপপ্রচার, মিথ্যা ও গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এক প্রেস নোটে যেকোনো ঘটনার সত্যতা জানতে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল করতে বলা হয়।
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি গুজবের পেছনে ছোটে মানুষ। এতে কারও প্রাণ গেছে, কারও সম্পদ নষ্ট হয়েছে, কারও-বা গেছে মানসম্মান। তার পরও কোনোভাবেই থামছে না গুজব, মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে এক মুখ থেকে আরেক মুখে। কোনো রকম সত্যতা যাচাই-বাছাই না করেই মানুষ হুজুগের পেছনে ছুটছে। বিশেষ করে, নিরক্ষর-কুসংস্কারাচ্ছন্ন একশ্রেণির মানুষ ‘চিলে কান নেওয়ার মতো’ শোনা কথা জনে জনে বলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের সেরা গুজব ছিল জামায়াত নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এক মসজিদ থেকে এই গুজব ছড়ানো হয়। সাতকানিয়ার বোয়ালিপাড়া, সামিয়ার পাড়া, খলিফাপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামে এই গুজবের ডালপালা বিস্তৃত হয়। লোকজন বেরিয়ে আসে এবং পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এরপর সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে আরও কয়েক জায়গায় এই গুজব ছড়ানো হয়। ফলাফল একশ্রেণির উত্তেজিত মানুষের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ এবং বহু মানুষ হতাহত হয়!
২০১২ সালে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। বাংলাদেশের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ের শুরুতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে। পরে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করে সেতু কর্তৃপক্ষ। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাতে উল্লেখ করা হয়, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি মহল সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে-এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে আরেকটি গুজব ছড়ায়, তা হলো সেতুতে শিশুদের মাথা লাগবে। এ জন্য শিশুদের ধরে নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের মাথা কাটা হচ্ছে। এই ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে শুরু হয় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি। গণপিটুনিতে রাজধানীসহ সারা দেশে অনেকে নিহত হন। পরে এ নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করে সরকার।
একই বছরের নভেম্বরে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজের’ গুজব। পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল’ থেকে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কয়েকটি অনলাইন পোর্টালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়। ফ্রান্সের থ্যালাস এলেনিয়া স্পেস কোম্পানি স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই স্যাটেলাইটের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রতিদিন সফলভাবে অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে গুজব ছড়ায় যে ৫০০ গ্রাম হারপিক ও ৫০০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার একযোগে ঢাললে ড্রেনে যত মশা আছে সব মরে যাবে। ফেসবুকে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মেয়রসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকেও রাস্তা ঝাড়ু দিতে দেখা যায়। পরে বিশেষজ্ঞরা জানান, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। হারপিকের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও বলে এটা গুজব।
গত বছরের নভেম্বরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে লবণের দাম বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। দেশবাসী হুজুগের বশবর্তী হয়ে লবণ কিনতে থাকে কিন্তু এক দিন পরই জানা যায়, লবণের দাম আদৌ বাড়েনি এবং মজুদ আছে প্রচুর।
২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিযুক্ত ১০০ টাকার একটি নোটের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এটি গুজব বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গুজব ছড়ানো হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়েও। চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনা আঘাত হানে। এর কিছুদিন পরই খবর বেরোয়, মধু দিয়ে মদ খেলে নাকি করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের অনেক আলেম গুজব ছড়ান মুসলমানদের ওপর নাকি এই ভাইরাস চড়াও হবে না। তাদের মতে, এ দেশে ইসলাম নিয়ে এত আলোচনা বা ওয়াজ মাহফিল হয়, যে কারণে করোনা বাংলাদেশে আসবে না।
বাংলাদেশকে গুজবের ‘চারণভূমি’ বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। গুজব যে সব সময় গুজব, তা-ও নয়। অনেক সময় একটি শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পরিকল্পিতভাবেও গুজব ছড়িয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটায়। গুজবের পেছনে কাজ করে ষড়যন্ত্রও। আশঙ্কার বিষয় হলো বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই গুজবের শেষ কোথায়, তা কারও জানা নেই!