নিজস্ব প্রতিনিধি : সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের সামাল দিয়ে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখা আওয়ামী লীগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের এবং জেলা-উপজেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকদের দফায় দফায় ঢাকায় এনে দলীয় স্বার্থে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য বলার পাশাপাশি কঠোর হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার পরও নির্বাচনী এলাকায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করেছেন।
৩০০ নির্বাচনী এলাকায় প্রতিটিতে সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের তালিকা কেন্দ্রের হাতে রয়েছে। ২০০টির বেশি আসনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৪ দলের শরিক, এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ সমমনা অন্যদের সঙ্গে সমঝোতা সাপেক্ষে ১০ থেকে ১২টি আসনে মনোনয়নের হেরফের হতে পারে। এসব আসনসহ দুই শতাধিক নির্বাচনী এলাকায় অভ্যন্তরীণভাবেই প্রকট সমস্যায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের শরিক দলগুলোর অর্ধশত আসনেই আওয়ামী লীগের যোগ্য, জনপ্রিয় ও সম্ভাবনাময় প্রার্থী রয়েছেন। দলের বৃহত্তর স্বার্থে গত নির্বাচনে শরিকদের মেনে নিলেও এবার আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা কঠোর অবস্থানে। এমনকি শরিক দলগুলোর হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, শিরিন আখতার, শরীফ নুরুল আম্বিয়াসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন। মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জি এম কাদের, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদসহ জাতীয় পার্টির শীর্ষস্থানীয় দুই ডজনেরও বেশি নেতার বিপক্ষে আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ ৫০টির বেশি আসনে ছাড় দিচ্ছে। এসব আসনের প্রতিটিতে জাতীয় পার্টির বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের যোগ্যতর, জনপ্রিয় প্রার্থী রয়েছেন। বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকদের ছাড় দিলেও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এবার আর ছাড় দিতে রাজি নন। গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে সতর্ক করেছে, দলের মধ্যে আগ্রহী ও সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য থাকায় এদের এখনই বসিয়ে দিতে না পারলে সামনে তারা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দেবেন। ৩০০ আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৯০ থেকে ১০০টি আসনে দলীয় মনোনয়ন লাভকারীরা অভ্যন্তরীণভাবেই তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। নির্বাচন ও মনোনয়নপত্র জমা দিতে আগ্রহী রয়েছেন অনেকেই। প্রতিটি আসনে চার থেকে পাঁচজন দলীয় লোক মনোনয়নপত্র জমা দেবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। এদের মধ্যে অনেককে নানা প্রক্রিয়ায় বসিয়ে দেওয়া সম্ভব হলেও সবাইকে তা করা যাবে না। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২২৫টি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। কয়েকজন মন্ত্রী, প্রভাবশালী এমপির আসনেও একাধিক মনোনয়নপত্র পড়বে। এই আসনগুলোর মধ্যে অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি আসনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাদের কর্মীরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। এর সুযোগ নেবে বিএনপি, কিছু কিছু এলাকায় জাতীয় পার্টি।
আওয়ামী লীগের জেলা নেতারাও এ অবস্থাটা নিয়ে বিচলিত। তারা কেন্দ্রকে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের প্রার্থীদের লড়াই হবে সব জায়গায়ই। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের আসনগুলোতেও লড়াই হবে। অনেক এলাকায়ই এ লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এ অবস্থাটা দলের জন্য হবে দুর্ভাগ্যজনক। এমনই অবস্থায় ৭০-৭৫টি নির্বাচনী এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকলে বিজয় অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে আওয়ামী লীগের ও ১৪ দলের প্রার্থীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার দিকে মুখিয়ে আছে বিএনপি। তারা এ অবস্থার সুযোগ নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। উন্নয়নের জোয়ারের টানে ভোট ভেসে আসবে, অর্থাৎ বিজয় নিশ্চিত বলেই সরকারি মহল গভীরভাবে আশাবাদী হলেও দলের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের অনেকে ভিন্ন চিন্তাও করছেন। তাদের মতে, সরকার অনেক উন্নয়নকাজ করলেও সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ দূর করতে পারছে না। ছাত্রলীগের অত্যাচার ও পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নিরবচ্ছিন্ন সড়ক দুর্ঘটনাও ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা সরকারকে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি করে রেখেছে। বিএনপিসহ তার সহযোগীদের আন্দোলন নিয়ে সরকার যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন নীরব ভোটার সাধারণের নিরুত্তাপ নির্লিপ্ততা নিয়ে। এদের বড় অংশের ভোট আওয়ামী লীগের পক্ষে আসে বলে আওয়ামী লীগ মহল ধারণা করে। এবার এর ব্যতিক্রম হয়ে যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীনদের অনেকেই। এর মধ্যে দলীয়ভাবেই বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলে ভোটের রাজনীতি বিএনপির অনুকূলে চলে যাবে। এমনকি ৭০-৭৫টি নিশ্চিত আসনও ধরে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে। সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখতে দলগতভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সমন্বয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক উপজেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকে আনা হচ্ছে। আগ্রহী প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া যদি সম্ভাব না-ও হয়, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিশ্রুতি ফলদায়ক না হওয়ায় জেলার মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থী ও স্থানীয় ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়েছে। তাতেও ফল হচ্ছে না। দলীয় প্রধান নিজে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা যায়।
আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিরোধ সামনে আরও প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। কেন্দ্রীয় নেতারা থেকে নিয়ে শীর্ষ পর্যায় থেকে নানা প্রলোভন, আশ্বাস দেওয়া হলেও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর বিদ্রোহীরা তা প্রত্যাহার না-ও করতে পারেন। শরিক দলগুলোর ২৭ থেকে ৩০টি আসতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন না। দলীয় ৪০ থেকে ৪৫টি আসনেও একই অবস্থা হতে পারে। আওয়ামী লীগের স্থানীয়ভাবে অভ্যন্তরীণ বিরোধ যত বাড়ছে, বিএনপির তৃণমূল থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চাপও ততই তীব্র হচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে তারা পুরো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যাপক জনমত তাদের পক্ষে রয়েছে বলেই তারা আস্থাশীল। মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তাদের পক্ষে অভাবিত ফলাফল আসবে বলেই তারা মনে করেন।