গোধূলি

রেজা নুর

চোখ বুঁজলে এখনও ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কানে আসে। বড় রাস্তার খড়খড়ে মাটিতে সেই প্রতিধ্বনি ওঠে। খুব ভোরে যখন চেনা পৃথিবী চলে যায় অন্য কোথাও, আবছায়া ঝুঁকে থাকে ফলের মতো, সেই সময় অতি ধীরে উৎকর্ণ হয়ে চলেন প্রদীপ সেন। পথের একেবারে কিনারে চলে আসেন। ঘাসের শিশির কী নিশ্চিন্তে সবুজ বিন্দু হয়ে বসে আছে। সূর্য আসে নি। এখনও ঘুম ঘুম দু’পাশের গাছপালা, লতাপাতা।
খানিকটা থেমে এদিক ওদিক তাকালেন প্রদীপ। হাঁটু গেঁড়ে নিচু হয়ে কান পাতলেন মাটিতে। আর্দ্র মাটির হিম-কথামালা গুণ গুণ করছে কানে। বহুক্ষণ রাস্তায় এভাবে কাঁত হয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো। নিজের খেয়ালে অবাক হলেন। আশেপাশের কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে! তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। রাস্তা থেকে কয়েক পা হাঁটলে বাড়ি। সেদিকে তাকালেন। জামগাছটার ডালের ওপারে দোতলা দালানের ছাদের কোণা ভেসে আছে। বেশ পুরনো। প্রায়-জীর্ণ। তবু কী যে ভালো লাগে বাড়িটার দিকে দূর থেকে তাকালে। ছেলেবেলার সাক্ষী হয়ে আছে ইটগুলো। কাচা ঘরের সামনের ছোট্ট উঠোনে ঝোড়াভর্তি ইট নিয়ে গরুগাড়ি এসে থামতো। গাড়োয়ান ও তার সাথের ছেলেটা মাথায় বাঁধা গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে মাটিতে সাজিয়ে রাখতো। কী সুন্দর ইটগুলো! লাল লাল কাঠি লজেন্সের মতো রঙ। ঝন্ ঝন্ ঝংকারে একটার ওপর আরেকটা গেঁথে গিয়ে উঁচু হয়ে থাকতো। পাকাঘর কবে হবে সে-কথা আর ভাবতো না প্রদীপ। চারদিকের কাদামাটির ভেতর ইটগুলোর অমন গায়ে গায়ে লেগে থেকে উঠোনটার মাঝখানে দাঁড়ানো দেখতেই ভাল লাগতো। কিন্তু একদিন যখন তরল সিমেন্টে আঁটকালো একে অপরের গা, তখনই সত্যিকারভাবে ওরা দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো ঘরের চারপাশে।
রাস্তার মোড়ের চা’র দোকানে রেডিওর জোর আওয়াজে চলার তন্ময়তা ভাঙলো। একটু বেশি সকালে দোকানের ঝাঁপ তুলেছে গফুর। গরমের সকাল হলেও এইসময়ে চা পেলে মন্দ হয় না। ফালগুন যায় যায়। তবু সেইরকম চৈত্রের দেখা নেই। এখনও চারদিকে ফুলেল সময়। মৃদু ফুরফুরে বাতাস। মোড়ের বটগাছটায়, পাতার আড়ালে নতুন নতুন কোকিলের আনাগোনা, অবিরাম গান। আকাশের দিকে একবার দেখে আর্দ্র ধুলোভরা পায়ের দিকে তাকালেন প্রদীপ। কারও ডাকে মুখ তুললেন।
নতুন খবর শুইনেচেন, কাকা? রেডিওর ভল্যুম কমিয়ে চুলায় কাঠ এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো গফুর।
না তো, নতুন কইরে আবার কী হইলো? এগিয়ে এসে চটার বেঞ্চে বসতে বসতে জানতে চাইলেন।
মাত্র কয়দিনির মদ্দি আমাগের ছেইলেরা শক্ত জোট বাইনদেচে, টেনিং নেচ্চে, অস্তর-পাতিও শুনলাম আইসতেচে ওইপার তে’। এইবার দেকা যাক, খানেরা যায় কোন্ দিকি? ব’লে দাঁতে দাঁত পিষে হাসলো গফুর।
উগের যাওয়ার কোনো পথ থাকপে না যদি মুক্তিরা সত্যি সত্যি শক্ত হইয়ে থাকে।
ঠিক বলিচেন। কিন্তু ‘সত্যি শক্ত হইয়ে থাকে’ কতাডা বুঝলাম না কাকা।
বুইঝলে না? এক মা’র সব ছেইলে যেমন একরকম হয় না, সেরকম সবাই চায় না, এই বাংলা স্বাধীন হোক।
সে আবার কীরাম কতা কাকা। এতকিচু হইয়ে গেল। নির্বাচনে জিতলাম আমরা, ক্ষ্যামোতা দেলে না। এত বছর গোলামের মতোন ব্যবহার কইরতেচে, তারপরও বাংলার কোন্ সন্তান চাবে না স্বাধীনতা!
সুমায় হলি বুজদি পারবা, গফুর। এখন এক কাপ চা দ্যাও দিনি।
গফুর ধীর-হাতে চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে থামলো একবার। দুধে চা মিশে খুব সুন্দর রঙ টলটল করছে কাচের কাপটায়। তরলের ঘূর্ণনের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রদীপ। কাপের গায়ে বেয়ে পড়া পানিটা গামছা দিয়ে মুছে বাড়িয়ে ধরলো গফুর।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন প্রদীপ। ফিনফিনে রাঙা রোদ সারা উঠোন জুড়ে। গোলাঘরের ছায়াটা বেশ দীর্ঘ হয়ে আছে। গোয়ালের গরুগুলো জাবনা শেষ করে বাইরে বের হবার অপেক্ষা করছে। টিউবওয়েলের দিকে এগোতে যাবেন, এমন সময় ছেলে সুদীপের ডাক।
বাবা, সামাদ এসেছে, তোমার সাথে দেখা করতে চায়।
কোথায় ও?
দহলিজে বসতে বলেছি।
আচ্ছা।
পাঁচিলের কোণায় দহলিজ ঘরটা পাহারার মতো দাঁড়ানো। শানের বারান্দায় বেঞ্চ পাতা। ভেতরে একটা খাট টেবিল আর বেশ কয়েকটা চেয়ার। প্রাইমারি স্কুল থেকে রিটায়ার করবার পরে সকাল বিকেল কিছু ছেলেমেয়ে পড়ান প্রদীপ। সুদীপ বাবার স্কুলেই শিক্ষকতা করছে। জমিজমা যা আছে তাতে তাদের এই গ্রামের বেশ সচ্ছল গৃহস্থ বলা যায়। সবরকম মানুষের আনাগোনা, নানারকম গল্পগুজবে ভরে থাকে এই দহলিজ ঘরটা। বাড়ির দিকের দরোজা খুলে ভেতরে এলেন প্রদীপ। একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে সামাদ। কনুই থেকে হাতের পাতা পর্যন্ত সমান্তরালভাবে বিছানো টেবিলের ওপরে। মাঝে মাঝে হারমোনিয়ামের রীডে আঙুল বুলিয়ে যাবার মতো কাঠের ওপর সারি সারি শব্দ তুলছে, টুক্ টুক্ টুক্। প্রদীপের দরোজা খুলে ভেতরে ঢোকা টের পায় নি। ওর মতো ক’রে টেবিলে কয়েকবার টোকা দিলেন প্রদীপ। ধীরে মাথা তুললো সামাদ। অন্যান্য দিন হলে উঠে দাঁড়াত। আজ এ অন্য কেউ। চোখ দুটো লাল। চুল ঝাঁকড়া হয়ে নেমে আসতে চাইছে দু’কান বেয়ে। পঁচিশ বছরের যুবকের ভেতর হঠাৎ পঁয়ত্রিশ বছরের পূর্ণতার প্রতাপ। এই ক’মাস আগেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে দেখা করতে এসেছিল। কালো সুঠাম দেহে সেদিনও ছিল বালকত্বের ছাপ। আজ সেই শরীরে অন্যভাষা। সোজা-শক্ত দৃষ্টি। উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ভাবনায় মোড়ানো।
স্যার, বসেন। স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছে আজ মাসখানেক হলো। এলাকায় আর্মীর আনাগোনাও শুরু হয়েছে। মুক্তি বাহিনী আরও মজবুত করা দরকার। পরামর্শ দেন।’
আরও বেশি যুবক ছেলেদের সংগঠিত করো। তোমার আব্বার সাথে কথা হয়েছে?
জ্বী, আব্বার সাথে প্রথমে কথা বলেই আমি যশোরে গিয়েছিলাম। উপর থেকে আমাদের এলাকার দায়িত্ব আমাকে নিতে বলেছে। হাতিয়ার দিয়েছে বেশ কয়েকটা।
তাহলে তো বেশ। তবে খুবই সাবধানে। বিভীষণ কিন্তু সবখানেই থাকে। যাবার আগে সুদীপের সাথে কথা বলে যেও।
ওর সাথে কথা হয়েছে আগেই। ও আছে আমাদের সাথে। প্রয়োজন হলেই ডাক দেবো। আজ উঠি স্যার।
কিছু খেয়ে যাও। সকালে তো কিছু খাও নি এখনও মনে হয়।
বাড়ি যেয়ে খাবো, স্যার। আব্বা অপেক্ষা করছেন।

উঠোনের চৌকিতে বসে আছেন ইরফান মুনসী। বাওয়ের দিকে দৃষ্টি। ঝাঁপা বাওড় রাজগঞ্জ হাই স্কুল ছুঁয়ে, একটু বেঁকে আছড়ে পড়েছে মানিকগঞ্জের এই অঞ্চলের পায়ে। বড় রাস্তার পাশের জনপদের সারি সারি বাড়ির দক্ষিণ জানালা খুললে চোখে পড়ে স্বচ্ছ জলের ঢেউ। রোদে রোদে তারা খেলে যায় ঢেউয়ের বোঁটায়। সবুজ শেওলার পাতা ও ফুল পতাকার মতো দোলে। সামাদ বাড়ি ফিরে আস্তে আস্তে বাবার দিকে এগিয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে দূরের দৃষ্টিপথ জানতে চাইলো যেন। ওই জলের ঢেউয়ে, সকালের এই প্রায়-সোমত্ত রোদে, নড়েচড়ে ওঠা নারকেল পাতায় বাবা-ছেলের একই ভাবনার দুলুনি। চপ্পলের পট পট শব্দে ফিরে তাকাল সামাদ। মা আসছেন। হাতে গামলা আর প্লেট। চৌকির একপাশে রাখতে রাখতে বললেন,
হাত পা ধুইয়ে আয়। খাইয়ে নে তুরা। সালামের মাদ্রাসা বন্দ দেছে কয়দিন। ও আসপেনে আইজ। খবর পাটায়েচে।
ভালই হলো। কথা আছে ভাইর সাথে। সামাদ আনন্দিত স্বরে বলল।
ওর সাথে কী কথা বলবি, ফল হবে না।
কেন আব্বা?
গত সপ্তায় বাড়ি আইছিল, ওর কথাবার্তার ভাব ভাল না। দেখ, সামাদ। এই দেশ আর কত অবিচার অনাচার শোষণ বঞ্চনার শিকার হবে! ওই বাওড়ের পানির মতো স্বচ্ছ বাংলার মানুষের মন। আর তাই নিয়ে খেলা করেছে দু:শাসকেরা। এদেরকে এবার খেদানোই লাগবে। এই জিনিসটা সালাম কেন বুঝতে চাইছে না, ভেবে অবাক হই। আমি কতভাবে বললাম, তাও মানাতে পারলাম না।
কথায় না মানলে ভাষা বদলাতে হবে আব্বা। এইবার দেশ স্বাধীনের প্রশ্ন।
ম্যাসাচুসেটস।