
সস্ত্রীক পথে যেতে যতে সম্প্রতি পরিচয় হয়ে গেলো একজন রুশ এর সাথে। ইংরিজি উচ্চারণ শুনেই বুঝলাম সেও আমাদের মতই পরদেশী। জিজ্ঞেস করলাম তোমার বাড়ি কোথায়? বললে, রাশিয়া। বললাম, কেমন আছে তোমার দেশ? সে মাথা নাড়লো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী নাই? খাওয়ার অভাব? বললে,না। বললাম স্বাস্থসেবা, চিকিৎসা? তার কী অবস্থা? বললে, সবার জন্যে ডাক্তার ফ্রি। ওষুধ কিনতে হয়। অভাব কী তাহলে? বললে, গাড়ি কেনার অনুমতি মেলে দু বছরে। সব ভালো জিনিষের জন্যে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। আমি বললাম ৮৬- ৮৭ সালেও তো শুনেছি মাংসের জন্যে লম্বা লাইন ছিল। ন্যায্য মূল্যে মিলতো শুধু হাড্ডি। ভালো মাংসের জন্যে বাড়তি ডলার লাগতো।আমার মেয়ের কাছে শোনা। সে গিয়েছিল পড়তে। এখন লেখাপড়ার কী দশা?-“অশিক্ষিত থাকাটা অপরাধ”। আমি বললাম, দেখো এদেশে তো অনেক হোমলেস দেখছি পথে ঘাটে। তোমাদের কী অবস্থা?-উ: হোমলেস হওয়াই বেআইনী এবং অপরাধ। বাড়ি কী ফ্রি? – “আগে ছিল”। এখন?- “এখনও ফ্রি। তবে ২০ বছর লাগে ফ্রি বাড়ি পেতে”। বললাম, নাই কী তাহলে কিসের এত অভাব? উ:“চাকুরি, কাজ, এমপ্লয়মেন্ট। সেই জন্যেই তো এখানে এসে ট্যাক্সি চালাচ্ছি”। দেশে কবে গিয়েছ শেষবার?- “সাতদিন আগে এসেছি”। বললাম, আচ্ছা আমাদের দেশে দুর্ণীতি তো ঘরে ঘরে। তোমাদের কী অবস্থা? একটা দীর্ঘশ্বাস।তারপর উত্তর : দুর্ণীতি শিরায় শিরায়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মজ্জায় মজ্জায়।
আমি বললাম, শুনেছি আগে নাকি কাজের অভাব ছিল না।
-হ্যা তাই। কাজ না করাটাই ছিল তখন দন্ডনীয় অপরাধ। আর এখন কাজই জোটেনা।লেখাপড়া জানা লক্ষ লক্ষ বেকার। তারা অপরাধ করছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই করছে। তারপর ড্রাগস নিচ্ছে।
আমি বললাম,আমাকে আর একটা কথা বলো। সমস্যা কী কী ছিল আগের দিনে? বললে,“সে অনেক সমস্যা। দাদীমা বলেন, তখন প্লেনের টিকিট ছিল খুব শস্তা। যেখানে খুশি যাওয়া যেত। কিন্তু গাড়ি কেনা যেতনা। যে চাকুরি দিত সেই বাড়ি দিত। কিন্তু নিজের কোন বাড়ি ছিল না। সবার একই রকম বাড়ি ঘর। একই রকম খাওয়াপরা। এই সমতা দাদিমা পছন্দ করতেন না। তার বাবার অনেক কিছু ছিল।কম্যুনিস্টরা সব কেড়ে নিয়ে তাকে ফকির বানিয়ে দিয়েছিল।
দাদিমা চাননি, তার বাবার জমিতে কাল যে ব্যাগার খাটতো সেও তার মত বিবিসা‘ব হয়ে একই রকম বাড়ি একই রকম শয্যা ও খানাপিনা পাক। তার পোলাপান স্কুল কলেজে যেয়ে ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েদের গলা ধরেহাটুক। এসব দেখে তিনি শেষে ড্রাগস নেয়া শুরু করেন। আর এখন?-না এখনও তিনি সুখী না। কেন?
-তা জানিনা। তবে মাংসের দাম বেড়ছে। ভোতকার দাম বেড়েছে। প্লেনভাড়া বেড়েছে। বাড়িভাড়া বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তার প্রিয় হাভানা চুরুটের দাম। তার একটা নাতি হুলিগান হয়ে ফেরার রয়েছে। আর একটা ক্রাইম করে জেল খাটছে। আমি বেকার। এই সব নিয়ে দিনরাত গজ গজ করছেন দাদিমা। নির্ঘুম রাতভর বিলাপ। পুতিনকে প্রতিনিয়ত শাপান্ত করছেন। ড.জিভাগো বইটা পুড়িয়ে ফেলেছেন। গ্লাস্ত নস্ত ও পেরেস্তেকার নিকুচি করছেন। গরবচেভের ছবিতে কালি লেপে দিয়েছেন। পাগলামি বেড়েছে শুনে গত সপ্তায় দেখতে গিয়েছিলাম।
কেমন দেখলে?- আর বোলোনা। ভোদকা আর চুরুট পেয়ে বেজায় খুশি।আমাকে বললে, তাড়াতাড়ি যা বাছা। চাকরিটা হারাসনে। ডাক্তার চেম্বার এসে গেলো। স্ত্রীকে নিয়ে নেমে পড়লাম রুশ বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।
(২)
দুর্ণীতি একটা আদিম পাপ। প্রাচীনতম ব্যাধি। কবে ছিলনা? এমন প্রশ্ন এখন অনেকেই উত্থাপন করছেন। তাদের কথা আগে যা হওয়ার হয়েছে। সে সব নিয়ে মাথা ঘামানো ঠিক হবে না। চুরি করে যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে পারলে তাদেরটা ফিরিয়ে আনো। পারলে এখন যে চুরি করছে তাকে ধরো। চুরি কে করেনি তাই বলো।
পন্ডিতরা বলছেন, ইংরিজিতে একটা কথা আছে,`There is a crime behind every wealth’- যার শাব্দিক অর্থ, হতে পারে, প্রত্যেকটা সম্পদের পিছনেই রয়েছে একটা না একটা অপরাধের পরম্পরা। সহজ বাংলায় চুরি না করে কেউ ধনী হয়নি। বড় লোক হয়নি।
২৫ জানুয়ারি ২০১৫ বিবিসি নিউজ জানায়,” বিশ্বে বর্তমানে ৪ কোটি ৭০ লাখ ধনী ব্যক্তি আছেন। এদের মধ্যে এক কোটি ৮০ লাখই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউরোপের মধে ফ্রান্সে অতি ধনীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ সংখ্যা ৪৫ লাখ। তবে ইউরোপের মধ্যে জার্মানির অর্থনীতি সবচেয়ে সবল হওয়া সত্বেও দেশটিতে ধনীদের সংখ্যা ২৮লাখ। সৌদি আরব, কুয়েত, অরব আমীরাত, অধুনা ভারত চীন রাশিয়া মায় ভিয়েৎনাম কেরিয়াতেও ধনীদের বিপুল প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। বাংলাদেশও ধন ও ধনী প্রবৃদ্ধিতে পিছিয়ে নেই।তবে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। মঙ্গা পালিয়েছে। তিন ফসলী ৫ বিঘা জমির মালিকও আর গরীব নেই। তারাও এখন ক্ষুদে সামন্ত। ৬০ এর দশকে রাশিয়া চীন ভিয়েৎনাম কোরিয়া কিউবা চিলিতে লাল বিপ্লবের বান ডেকেছিল। সেই তালে মেতে উঠেছিল ভারত ইন্দানেশিয়া চিলি ঘানা। সেই সময়ে আমাদের এই সবুজ বাংলা ভূখন্ডে যারা লাল বিপ্লবের নেশায় মেতেছিলেন তাদেরই একজন বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে শেখ হাসিনার মনে দুর্বার সাহস যুগিয়েছেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রই সবুজ বিপ্লবের লাল বার্তা নিয়ে এসেছিল আমাদের দেশে। সার এসেছিল।
কীটনাশক এসেছিল। শ্যালো টিউবেল এসেছিল। ডীপ টিউবেলও এসেছিল। আর্সেনিক এসেছিল ভূগর্ভেও নিকটতর স্তরে। জাতির জনক শেখ মুজিব খাদ্য বিপ্লবের যে ফর্মূলা দিয়েছিলেন সেটার বর্ণ ছিল অবশ্য গোলাপী। মালিক একভাগ। খোদ কৃষক একভাগ।আর এক ভাগ পাবে সমবায় সমিতি।সরকার ঋণ দেবে, উপাত্ত উপকরণ দেবে।
আমদানী সহায়তা দেবে। বাজারজাতকরণে মদদ দেবে। গুদাম দেবে। সবাই পাবে সরকারের দেয়া প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সব রকমের ভর্তুকি সমবায় সমিতির মাধ্যমে সমানহারে। মালিক পাবে শ্রমিক পাবেনা, তা হবেনা। আবাসী হোক আর অনাবাসী হোক জমির মালিকানা যেমন আছে তেমন রবে। কম্যুনিস্ট বন্ধুরা স্লোগান দিলেন, “লাঙ্গল যার জমি তার”। জাল যার জলা তার। তাদের কথায় তুর্কী পিতা কামাল পাশা কান দেননি। মিশরের বিপ্লবী নেতা গামাল আবদেন নাসেরও কর্ণপাত করেননি।
কঙ্গোর উদয়ের কবি লুমুম্বা ভুল করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ-আইদিতও লক্ষ্য অর্জনের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে ভুল করেছিলেন। ভুল করেছিলেন চিলির মার্ক্সবাদী প্রেসিডেন্ট ড. আলেন্দে। তাঁরা মাশুল গুনেছিলেন প্রাণ দিয়ে। এমনকি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী জয়বর্ধনকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল কেবল স্বপ্ন দেখেই।
১৯১৭ সালে রাশিয়ার কোজাকরা ছুটে গিয়েছিল রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ভি. আই লেনিনের কাছে। সত্যিই কী তুমি বলছো লাঙ্গল যার জমিও তার হবে? লেনিন বলেছিলেন,হ্যা আমি তাই চাচ্ছি। চীনের মাও জে দঙ একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু ভূমিহীন কৃষক বিনা রক্তপাতে সে উপহার গ্রহণ করতে পারেনি রাশিয়ায় রেড আর্মি ও চীনে পিপলস আর্মি থাকা সত্বেও তাদের অকাতরে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সরকারি হিসাবেই ১০/২০ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছিল ভুমি দাঙ্গায়।
সিআই দাবি করেছে, রাশিয় ও চীনে ৫০ লক্ষ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল ভূমি জাতীয়করণ বলবৎ করতে বা ব্যক্তি মালিকানা রহিত করতে যেয়ে। তারা হিটলারের হলোকাস্ট এবং রাশিয়া -চীনের ভূমিদাঙ্গার কোরবানিকে একই পাল্লায় মাপছে।
“লাঙ্গল যার জমি তার” এবং “জাল যার জলা তার” মানেই হচ্ছে কম্যুনিস্ট বিপ্লব। ১৯ বছর ৫ মাস ৪ সপ্তাহ ১ দিন যুদ্ধ করে ভিয়েৎনাম কম্বোডিয়া ও লাওসে কম্যুনিস্ট বিপ্লব সফল হয়। এই বিপ্লবকে পৃথিবীর মানুষ জেনেছে “ভিয়েৎনাম যুদ্ধ “ হিসেবে। ১ নভেম্বর ১৯৫৫ শুরু হ’ল যুদ্ধ। শেষ হ’ল ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫।
ভিয়েৎনাম থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার পর দক্ষিণ ভিয়েৎনাম, কম্বুডিয়া ও লাওসে কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে। উত্তর ও দক্ষিন কোরিয়ার পুনরেত্রীকরণ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৪ সালে ভিয়েৎনামের খন্ডিত দুই অংশের পুনর্মিলনের লক্ষ্যেই ফরাসী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদের যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে উত্তর ভিয়েৎনাম জয়লাভ করে। দক্ষিণ ভিয়েৎনামকে পৃথক রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর হয়ে যুক্তরাষ্ট্র মাঠে নামে ১ নভেম্বর ১৯৫৫।
যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যসংখ্যা ৫০০,০০০ (পাঁচ লাখে) দাঁড়ায় ১৯৬৯ সালে। চীন রাশিয়াও ততোদিনে ভিয়েতনামের পাশে এসে দাড়িয়েছে সব রকম সাহায্য নিয়ে। সুদীর্ঘকালস্থায়ী সেই যুদ্ধে ১৫ লক্ষ উত্তর ভিয়েৎনামী ও ভিয়েৎকং যোদ্ধা প্রাণ হারালো। সরকারি হিসাবেই এই বিপ্লবী যুদ্ধে প্রাণহানি ২০ লক্ষ মানা হয়। ২৫ জুন ১৯৫০-২৭ জুলাই ১৯৫৩, কোরীয় যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার এক কোটি ৫ লক্ষ ৫০ হাজার লড়াকু মানুষ হতাহত হয়। ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিদাতা সুকর্ণকে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উৎখাত করা হয়। এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বাংলাদেশের অভীষ্ঠ স্বাধীনতার ইশতেহারে বলা হয়: “স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক, শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে”। তার আগে স্বপ্নের স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। ৭ই মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের কাছে সর্বশক্তি নিয়ে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আহবান রেখেছেন। এবং রণকৌশল ঘোষণা করেছেন রেসকোর্স ময়দানের জনসমূদ্রে। একহাতে ব্যালট বিপ্লবের গণম্যান্ডেট অন্যহাতে রণতূর্য। মেধা মননে প্রজ্ঞা, ইতিহাসের শিক্ষা ও দূরদর্শিতা। আকাশে সশস্ত্র বায়ুসেনাদের সতর্ক পায়তারা ও সদম্ভ বিচরণ। উচ্চ ভবন শীর্ষে মোতায়েন রয়েছে রিকয়লেস রাইফেল,ও বিডিআর কামান। কোথাও কোথাও এন্টি এয়ারক্রাফট গান। আগের রাতে সাহেবজাদা ইয়াকুব ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকে অনরোধ জানিয়েছেন, মুজিব তুমি এমন কিছু করবা না যাতে আমাকে নিষ্ঠুর হতে হয়।
তা সত্বেও জাতির জনকের বলিষ্ঠ উচ্চারণ এবং বজ্রনিনাদে ঘোষণা: ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। একটু অসতর্ক হলেই অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ ও ভিয়েৎনামের মাইলাই এর গণহত্যার রেকর্ড এবং চেঙ্গিশখানের কাতলে আওমের ইতিহাস ম্লান হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধ পিছিয়ে যেত হাজার বছর। নিয়াজি ১৫ ডিসেম্বর ’৭১ বলেছিল সেকথা জেনারেল জ্যাকবকে। ‘আমরা আত্মসমর্পন করবো না। হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করবো’। জবাবে জেনারেল জ্যাকব যা বলেছিলেন তার বাংলা মানে হ’ল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের উঁই এর ঢিবি বানিয়ে রেখেছে। আত্মসমর্পণ নইলে মৃত্যু, তাছাড়া আর কোন বিকল্প নেই এখন তোমাদের সামনে।
(৩)
মহামানব যীষু বলেছেন, পাপকে ঘৃণা কর।পাপীকে না। একথার তাৎপর্য্য বিশাল। বহুমুখী ও গভীর। সহজ অর্থে পাপ থাকলে মানুষ পাপবিদ্ধ হবেই। পাপ না থাকলে পাপী সৃষ্টি হবেনা। পরবর্তীকালে কালজয়ী দার্শনিক কার্লমার্কস সিস্টেমকেই দায়ী করেছিলেন সব অপরাধের জন্যে। মহামতি লেনিন, মাও, হোচিমীন,কিম ইলসুং, টিটো, ফিদেল ক্যাস্ট্রো সেই নষ্ট সিস্টেমের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘুনে ধরা সমাজটাকে নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন।
সত্যদর্শী সত্যসাধক মহামতি যীষু ঘোষণা করেছিলেন, রোম সম্রাট মিথ্যাচার করছে। সে একজন নগন্য মানুষ। সে ঈশ্বর নয়।মহাপিতা ঈশ্বর বিরাজ করেন সপ্তাকাশে। ধরাধামে তিনিই ঈশ্বরের প্রিতিনিধি ও ইহুদিদের রাজা। এই ঘোষণাই তাঁকে বিপন্ন করেছিল। একদিন যীশু পথে হাঁটতে বেরিয়ে দেখতে পেলেন একজন অসহায় নারীকে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে। ধর্মযাযকদের জুরি তাকে পতিতা, পাপিষ্ঠা,ভ্রষ্ঠা, বিবেচনায় মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। পাথরখন্ড হাতে নিয়ে ঘাতকরাও প্রস্তুত। দর্শকরাও নারী হত্যার সেই নারকীয় দৃশ্য দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। যীশু সেই বিচারমঞ্চে আবির্ভূত হয়ে বললেন ক্ষান্ত হোন প্রভুগণ। আমার ছোট্ট একটা কথা আছে। অপনাদের বিচার নির্ভুল। রায়ও অভ্রান্ত। আমি সহমত। দ্বিমতএকটাই কেবল পাথর ছোঁড়ার হাতগুলি নিয়ে। আমি দাবি করছি কেবলমাত্র সেই মানুষের হাত দিয়েই ঐ পাপীষ্ঠাকে পাথর মারা হোক, যে মানুষ নিজে নিষ্পাপ, যার একটি হাতও কখনও পাপ স্পর্ষ করেনি। কথিত আছে এই কথা শোনার সাথে সাথেই নির্বাচিত ঘাতকদের হাত থেকে পাটকেল গুলো খসে পড়লো। দর্শকরা প্রস্থান করলেন। বিচারকরাও রণেভঙ্গ দিলেন।
কিন্তু পৃথিবী থেকে সেই সঙ্কট আজও দূর হয়নি। পাপ আছে, পাপী আছে। বিচারক আছে। ঘাতক আছে। নেই শুধু নিষ্পাপ মানুষ। আর নেই ‘কখনও পাপ স্পর্শ করেনি এমন দুটো নিষ্কলঙ্ক হাত’।
আমার প্রিয় গ্রীক দার্শনিক ডায়েজিনিস সপ্রাণ ছিলেন বিশ্বজয়ী মহাবীর সম্রাট আলেকজান্ডারের সময়। একদিন দেখা গেলো সূর্য্য করোজ্জল দিন দুপুরে তিনি হাঁটছেন হাতে জ্বলন্ত হারিকেন নিয়ে। একজন ভক্ত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, গুরু, আপনি এই দিনমানে হারিকেন নিয়ে “কী খুঁজিতেছেন?” গুরুবললেন,“আমি একজন সৎ লোককে খুঁজিতেছি”। আজও সেই সৎ মানুষটি ফেরার রয়েছে।
বাঙালি জাতির জনক খুঁজে পাননি ৭২ সালে তাকে। তাঁর সুযোগ্য কন্যাও তাকে খুঁজে পাচ্ছেননা। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়, লোম বাছতে কম্বল সাফ। সেই পুরানো কথারই অনুরণন চারিদিকে।
আমি নিজে নিষ্পাপ নই। একথা বলার সাহস আমার আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জিরো টলারেন্সের কথা বলার জন্যই সে গল্পটা বলতে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আদেশ নং ১৬ জারি হ’ল ’৭২ সালে। পাকিস্তানী অবাঙ্গালিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাহারা দেয়ার দায়িত্ব চাপলো পূর্তমন্ত্রণালয়ের উপর। জোয়ালটা আমার ঘাড়ে। মন্ত্রীর হতে চাবুক। সেদিন দুপুরে একজন ম্যাজিস্ট্রেট টহলদার পুলিশের সাথে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় গিয়েছিলেন একটাবাড়ি সিলগালা করতে। পড়বি পড় মালির ঘাড়ে। কিন্তু এ লিচু চোর তো নজরুলের সেই ‘নিষ্পাপ’ শিশু লিচুচোর না। এ যে হোমরাচোমরা ধাড়ি চোর।
ম্যাজিস্ট্রেট তো হতবাক। কিংকর্তব্য বিমূঢ়। ফোন পেয়ে আমিও হতবুদ্ধি। কিন্তু মাথা খুলে গেলো। পিআইডিতে ফোন করে ডিউটিরত একজন ফটোগ্রাফারকে তৎক্ষণাৎ অকুস্থলে যেয়ে পাপ এবং পাপীদের ছবি তোলার নির্দেশ দিলাম। মন্ত্রী মহোদয়কে খুলে বললাম সবকথা। মন্ত্রী মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে ক্যাবিনেট নোট লিখতে বললেন একান্ত সচিব সাবেক সিএসপি আব্দুল মঈদ চৌধুরিকে। এটা তারই কাজ। কিন্তু বিব্রত বোধ করলেন তিনি। কারণ অভিযুক্তদের একজন সরাসরি তার সার্ভিসের টপ বস। অন্যজনও সমান পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। মঈদ চৌধুরী আমাকে বললেন, ঘাড় পেতে ঝামেলাটা আপনিই নিয়েছেন,ভাই’ এখন শেষটাও আপনিই টানেন। অপিস থেকে বেরিয়ে আমি একফাঁকে দেখে এসেছিলাম সরেজমিনে যেয়ে ধানমন্ডি ৪ নং সড়কে তিব্বত কোম্পানির একজন ডাইরেক্টর ও নগরীর সোল এজেন্ট এর দোতালা বাড়ি থেকে কোটি টাকার মালামাল বের করে ট্রাক বোঝাই করার দৃশ্য। দুজনই সরকারি উচ্চপদাসীন বিশিষ্ট কর্মকর্তা। মনে হয় ব্যক্তিগত ভাবে তদারক করছেন। মূল্যবান জিনিষ বলে কথা। ক্যামেরায় তারা সক্রিয় অবস্থায় বন্দী হয়েছেন। সম্ভবত: তাঁরা ঐবাড়িটাকে নিজেদের বাসস্থান হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন।
সরকারিভাবে নিয়মমাফিক সেটার জন্য তারা বরাদ্দ চাইতে পারতেন। ঘটনার ছবি সহ কেবিনট নোট পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অভিযুক্ত দুজন সচিবকেই সাময়িক বরখাস্ত করলেন। তাঁদের একজন সাবেক সিএসপি নুরুল কাদের খান (ঝিলু), এসটাবলিশমেন্ট সেক্রেটারি। অন্যজন স্বাস্থ্যসচিব। বিস্মৃত সেই নামটা সম্প্রতি মনে করিয়ে দিলেন তখনকার এমএনএ গাইবান্ধার ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী রেজা ওয়ালিউর রহমান। তিনি নিশ্চিত করলেন, দ্বিতীয় অভিযুক্ত ব্যক্তি ডা. টি আলি। একাত্তরে প্রবাসী সরকারেরও সচিব তারা দুজনই। এই ঘটনার পরে তারা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। সংস্থাপন সচিব মহোদয় একটা বিরাট পোষাক শিল্প গড়েছিলেন বনে মনে পড়ে। সে সময় যাদের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, তাঁদের মধ্যে রেজা ওয়ালিউর রহমানই কেবল বেঁচে আছেন। তিনি অনেক স্মরণীয় ঘটনার স্বাক্ষী। অনেক অভিজ্ঞতার সাথী। বয়স আশির উপরে। থাকেন মোহম্মদপুরে একটা ভাড়া বাড়িতে। তাঁকে বললাম ভাই অবস্থার তো কোন পরিবর্তন দেখছিনা তেমন। বঙ্গবন্ধুর এমএনএ রেজা ভাই বললেন অবলীলায়, যাক না গাঁ উজাড় হয়ে,না থাকুক কম্বল লোমশ। তবু পাপকে তো হত্যা করতেই হবে। আজ না হলে একদিন না একদিন কেউনা কেউ তো সেটা করবেই।
৯ মার্চ, ২০১৯ ক্যালিফোর্নিয়া।