
মঈনুদ্দীন নাসের : শুধুমাত্র ইহুদি কিংবা ইসরায়েলিদের প্রতি নয়, বরং সবধরণের ঘৃণা বা সকল সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণাকে অপসারিত করতে হবে। এটিই ছিলো মিনিসোটার ফ্রেশম্যান মহিলা কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমরের কংগ্রেসে ববৃতির মূল সুর। আর তাই-ই গ্রহণ করা হয়েছে কংগ্রেসের প্রস্তাবে, অন্তত আংশিকভাবে। গত ৭ মার্চ, বৃহস্পতিবার, রচিত হয়েছে আমেরিকার কংগ্রেসে এক নতুন ধারা। বিষয়টি যতো সহজ মনে হচ্ছে, ততো সহজ নয়। এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ৪০৭, বিপক্ষে ২৩ জন রিপাবলিকান। অধিকাংশ রিপাবলিকান প্রস্তাবের পক্ষে রয়েছেন। প্রস্তাবটি শুরু হয় ইলহান ওমরের উক্তি নিয়ে। তিনি প্রায় দু’সপ্তাহ আগে বলেন- ‘যারা ইসরাইলকে সমর্থন করেন, তারা দুই দেশের প্রতি আনুগত্য দেখায়।’ আর এ উক্তি পুরো ক্যাপিটাল হিলে ছড়িয়ে দেয় দুরন্ত হাঁসফাঁস। অনেকে ইলহান ওমরকে নিন্দা জানান। বলেন- তার কথা ‘এন্টি সেমেটিক।’
ইলহান ওমর তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমাও চান। তারপরও শান্ত হয়নি বাতাস। চলছে তর্ক-বিতর্ক। অবশেষে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির হস্তক্ষেপ। কংগ্রেসে গৃহীত হলো এন্টি- সেমেটিজমের বিরুদ্ধে প্রস্তাব। ভোটের সময় যখন আসলো, তখন এতে যুক্ত হলো মুসলিমবিরোধী ঘৃণার নিন্দা। এরপর আসলো হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্য অবসান।
প্রস্তাবের শেষে উল্লেখ করা হলো- আফ্রিকান-আমেরিকান, নেটিভ-আমেরিকান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ- ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু, শিখ ইমিগ্র্যান্টস ও অন্যরা, যারা ঘৃণার শিকার তাদের প্রটেকশন।
প্রস্তাব হচ্ছে- ‘অসহিষ্ণুতার ঘৃণামিশ্রিত প্রকাশের’ বিরুদ্ধে, হাউজে তা ৪০৭-২৩ ভোটে পাস হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তা ডেমোক্রেটদের ফ্যাকশনালিজমের বা খণ্ড খণ্ড গোষ্ঠীর ঐক্যের মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ন্যান্সি পেলোসি গত ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে প্রস্তাবের উপর ভোটের ঘোষণা দেন। তিনি রিপোর্টারদের বলেন, সবকিছুকে তিনি সুযোগ হিসেবে দেখেন।
তিনি বলেন, এটি হচ্ছে ইহুদিবিরোধী ঘৃণা, মুসলিমবিরোধী বিবৃতি হোয়াইট বা শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যতার বিরুদ্ধে যতোটুকু পারা যায়, শক্তিশালী উপায়ে বিরোধিতা করা।
মিসেস ওমর তার উক্তিতে আসলে পেন্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। তার উক্তিকে কিভাবে নিন্দা জানাবে, তা নিয়ে ডেমোক্রেটরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ওমরের উক্তি ডেমক্রেটদের ইমোশনাল করে তোলে যার যার ধর্মীয় লাইনে। অনেক ডেমক্রেট সহকারি বিষয়টিকে ‘রান্নাঘরের আগুন নেভানোর প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করেন।
দিন শেষে দেখা যায় সব ডেমক্রেটই প্রস্তাবে ভোট দিয়েছেন। কিছু রিপাবলিকান ভোট দেননি। আর আইওয়ার রিপাবলিকান স্টিভ কিং, যাকে বর্ণবাদী হোয়াইট প্রাধান্য মন্তব্যের জন্য কমিটি এসাইনমেন্ট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, তিনি উপস্থিত বলে ভোট দেন।
প্রস্তাবে বলা হয়- রাজনৈতিক ডান, মধ্য বা বামপন্থা, দলন, বৈষম্য, নির্যাতন, বর্ণবাদ এবং অবাঞ্ছিত বা দ্বিধাবিভক্ত আনুগত্য আমেরিকার রাজনৈতিক বিতর্কে কোনো স্থান নেই। এ প্রস্তাবে ভার্জিনিয়ার চার্লসভিলি, সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটন, পিটারবুর্গে এবং একই সাথে মুসলিম ও মসজিদে হামলার বিষয়ও উল্লেখ করা হয়।
অনেক রিপাবলিকান প্রস্তাবটিকে সবকিছুর ‘মিশাল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তারা স্থানীয় চার্চের জিজোবার সাক্ষীদের বাদ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। আবার ইহুদি ডেমক্রেট যারা প্রস্তাবটি শুধুমাত্র এন্টি সিমেটিজমের জন্য তৈরি করেছিলেন, তারা এ প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
ইলহান ওমরের আনুগত্য দ্বিধা-বিভক্ত উক্তি ডেমক্রেট ইহুদিদের বেদনার কারণ হয়। তারা বিষয়টি সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু যখন প্রস্তাব আনা হলো, তখন ইহুদিদের পাশাপাশি মুসলিম, হিন্দু, শিখসহ সব মাইনরিটি গ্রুপের নাম চলে আসলো, বিষয়টি সবার জন্য ‘উইন উইন’ হলেও একশ্রেণির শ্বেতাঙ্গ-প্রাধান্য কংগ্রেসম্যান ও এন্টি সেমিটিজম বিরোধী একটি মহল তাদের পাশে অন্য বর্ণ বা ধর্মের নাম সহ্য করতে পারেনি। ফ্লোরিডার ইহুদি ডেমক্রেট মি. ডাচ বলেন, ‘কেনো আমরা এন্টি সেমিটিজমকে এককভাবে নিন্দা জানাতে পারি না? নিউইয়র্কেও লি জেলডিন যিনি হাউজের দুই ইহুদির মধ্যে এক ইহুদি সদস্য প্রস্তাবে ‘নো’ ভোট দেন। তিনি বলেন, এ প্রস্তাব মেরুদণ্ডহীন। তিনি বলেন, যদি একজন রিপাবলিকান এন্টি সেমিটজম পুশ করেন, সেই প্রতিনিধির নাম উল্লেখিত থাকবে বলে কংগ্রেসম্যান ওমর চাপ সৃষ্টি করেন। তা হলে প্রস্তাবে তার নাম উল্লেখ থাকবে।
কিন্তু স্পিকার পেলোসি বলেন, এ প্রস্তাব ওমরকে টার্গেট করে করা হয়নি। তিনি বলেন, এটি তার বিরুদ্ধে নয়, এ প্রস্তাব সব ধরণের ঘৃণার বিরুদ্ধে।
মিস ওমর কংগ্রেসে নির্বাচিত দুই মুসলিম মহিলার একজন। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে তার বিরুদ্ধে এন্টি-সেমিটিজমের অপবাদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তিনি নিজে ইসলামবিরোধী অপপ্রচারের টার্গেট হয়েছেন। সম্প্রতি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার একটি পোস্টারে তাকে ১১ সেপ্টেম্বরের সাথে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে কংগ্রেসে কিছু না বলেই চলে যান।
কিন্তু তিনি কংগ্রেসের অপর দুই মুসলিম সদস্য- মিশিগানের রাশিদা তাইয়্যিব ও ইন্ডিয়ানরার আঁদ্রে কারসনের সাথে একযোগে এক বিবৃতি দেন। তারা দিনটিকে ঐতিহাসিক আখ্যায়িত করে বলেন, এই প্রথমবারের মতো আমরা ভোট দিয়েছি এমন একটি প্রস্তাবে, যেখানে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মুসলিমবিরোধী ঘৃণাকে নিন্দা জানানো হয়েছে।
নিউইয়র্কের ডেমক্রেট জেরল্ড নাডলার, যার এলাকায় সবচেয়ে বেশি ইহুদি বসবাস করেন; ম্যারিল্যান্ডের জামি র্যাসকিন এবং লুজিয়ানার ডেমক্রেট সেডরিক রিচমন্ডের মধ্যে আলাপ আলোচনার ফলশ্রুতি হচ্ছে এ প্রস্তাব।
মিস পেলোসি চার্লসটনভিলির ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একতরফা বিবৃতিরও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন- প্রেসিডেন্ট ভাবতে পারেন উভয়দিকে ভাল লোক আছে, আমরা তা মানি না।
গত এক সপ্তাহ আগে ক্যাপিটাল হিলে ওমরের উক্তির পর এন্টি-সেমিটিজম নিয়ে কথা হয়। মি. ডাচ ও কংগ্রেসম্যান হাউজ ফরেন এফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান নিউ ইয়র্কের এলিয়ট এনজেল ডেমোক্রেট নেতৃবৃন্দের সাথে কিভাবে এ প্রস্তাব তৈরি করবেন, তা নিয়ে আলাপ করেন। মিস ওমর ফরেন এফেয়ার্স কমিটির সদস্যা।
মিস ওমরের সমর্থকরা মনে করেন, ওমরকে একা বেছে নেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য। হাউজ ডেমক্রেটদের এক বদ্ধ ঘরের বৈঠকে অসন্তোষ আরো ধূমায়িত হয়।
এ প্রস্তাবে বিগতদিনের ধর্মভিত্তিক ঘৃণা নিয়ে বিশদ বিবরণ দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট-কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক বিশ্বাস নিয়েও কথা হয়। ইহুদি ফ্রান্স আর্টিলারি ক্যাপ্টেনকে অহেতুক জার্মান হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এসব বিষয় উল্লেখ করে প্রস্তাবে বলা হয়- ‘শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক লাভের জন্য রক্তচক্ষু ও ঘৃণাকে হাতিয়ার করে প্রচলিতভাবে নির্যাতনের শিকার মানুষদের টার্গেট করেছে। তাদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান, নেটিভ আমেরিকান ও অন্যান্য বর্ণের মানুষ- ইহুদি, মুসলিম, হিন্দু, শিখ অভিবাসী ও অন্যরা রয়েছেন। তাদের মৌখিকভাবে উস্কিয়ে ও সহিংসতার মাধ্যমে দলন করা হয়েছে।
মিস ওমর তার টুইটে বলেছিলেন, ইসরাইলের প্রতি সমর্থন ‘বস্তুত সবকিছু বেঞ্জামিনের শিশু।’ তাতে সমালোচকদের যে বিশ্বাস- ইহুদিরা ফরেন পলিসি নিয়ন্ত্রণ করছে- তার প্রতিধ্বনি করা হয়েছে। ১০০ ডলারের বিলের কথা বলা হয়নি যেখানে বেঞ্জামিনের দাবি আছে। ওমর এ জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন।
মিস পেলোসি ওমরকে দ্বিতীয়বার ক্ষমা চাইতে না বললেও, তিনি ব্যাখ্যা দেবেন কিনা, তা তার বিষয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এটি তার বিষয়, তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেবেন কিনা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে, তার কথায় পূর্ণ ভারিক্কি সে বুঝেছে।’
দক্ষিণ ক্যারোলিনার ডেমক্রেট জেসম ই. ক্লাইবার্ন হিল পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন, সোমালিয়া থেকে ছোট অবস্থায় যুদ্ধ ছেড়ে ইলহান ওমর এসেছেন। রিফিউজি ক্যাম্পে চার বছর কাটিয়েছে সে। ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণায় আক্রান্ত হয়েছে কেনিয়ার ক্যাম্পে। হলোকাস্ট থেকে উদ্ধার পাওয়া ইহুদিদের চাইতে কম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয় তার। জাপানের বন্দীত্ব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট ও অন্যান্য সহিংস অতীত ঘটনার চাইতেও তার অভিজ্ঞতা দুঃখের। অনেকে যেমন বলেন, আমার পিতামাতা হলোকাস্ট থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত। কিন্তু তার মুক্তিও তার জন্য অতীতের অনেক দুঃখকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি তার সাথে কথা বলেছি। আমি বলতে পারি, সে অনেক বেদনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে।
রিপাবলিকান জেলডিন বলেন, ক্লাইবার্নের মন্তব্য অত্যন্ত নোংরা। আর তা হলোকাস্টকে হালকা করে দেখা হয়। তার ব্যাপক গুরুত্বকে খাটো করা হয়। আর তার কারণ, ভিকটিম, তাদের পরিবার, উদ্ধারপ্রাপ্ত ও বিশ্বের উপর ব্যাপক প্রভাব। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুসলমানরা সারাবিশ্বে আজ বিপদগ্রস্ত। একদিকে সন্ত্রাসী, অন্যদিকে সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করার মতো কর্মকাণ্ড। আর মাঝখানে শান্তিপ্রিয়দের ওপর ঘৃণার মরণ কামড়। এরমধ্যে ইলহান ওমর হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছে। বিশ্বের একমাত্র শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা অন্তত একটুখানি হলেও বুঝতে পেরেছে, তাদেরও শক্তি রয়েছে।
প্রকারান্তরে যে প্রস্তাব পাস হয়েছে, তাতে শুধু মুসলিম নয়, হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নামও সন্নিবেশিত হয়েছে। আজ ইলহান ওমরকে অন্তত সে কারণে সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ।