ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া

যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি

ঠিকানা রিপোর্ট : বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে- ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া। অর্থাৎ আগের কাজটি আগে না করে পরের কাজটি আগে করা। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ক্ষেত্রেও যেনো এমনটিই হয়েছে। দীর্ঘ এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটির জন্য এখানকার নেতারা তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা করছিলেন। ঢাকা ও লন্ডনে নানাভাবে যোগাযোগ করে আশ্বাসও পেয়েছিলেন। তাই তারা প্রত্যাশা করছিলেন, অচিরেই ঘোষণা করা হবে তাদের বহুল কাক্সিক্ষত কমিটি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ১৭ আগস্ট নিউইয়র্ক স্টেট বিএনপি এবং নিউইয়র্ক সিটি উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তিন শাখা কমিটির প্রতিটিতে ৪১ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২০টি স্টেটে বিএনপির কমিটি গঠন করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি দেশের জেলা কমিটির মতো মর্যাদাশীল। নিয়ম অনুযায়ী, ইলেকশন কিংবা সিলেকশনের মাধ্যমে দেশের যেকোনো জেলা কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি। আর জেলা কমিটি গঠিত হওয়ার পর ওই জেলার আওতাধীন উপজেলা, পৌরসভা কিংবা ওয়ার্ড কমিটি গঠনের দায়িত্ব জেলা কমিটির। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। কেন্দ্রীয় বিএনপি প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির অনুমোদন দেবে, তারপর ওই কমিটি বিভিন্ন স্টেট কিংবা সিটি কমিটি গঠন করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। মূল কমিটি গঠনের আগেই গঠিত হয়েছে সব শাখা কমিটি। তাই অনেকে একে ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে’ দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। বলছেন, এর মাধ্যমে দলীয় চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির দ্বন্দ্ব-কোন্দল আরো বাড়বে, অর্থাৎ দলীয় কোন্দলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হলো।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে যেসব সাবেক ছাত্রনেতা, যুবনেতা এখন বিএনপি নেতা নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে যারা খুব সংগত কারণেই মুখিয়ে ছিলেন, এ ঘটনায় তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। তারা আশা করেছিলেন স্টেট কিংবা সিটি কমিটির পাশাপশি যুক্তরাষ্ট্র কমিটিও আসবে। তাই, হতাশা, অপমান আর ক্ষোভে-দুঃখে তারা এখন নির্বাক হয়ে গেছেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হওয়ায় তারা রাজনীতির এই জটিল অঙ্ক বুঝতে না পেরে মাথার চুল ছিঁড়ছেন। তাদের অনেকে নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষের দিকে বলেও শঙ্কা করছেন। ক্ষোভে, দুঃখে ও অভিমানে অনেকে বিএনপির রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বা পড়বেন। ত্যাগী এই নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- আব্দুল লতিফ সম্রাট, ডা. মজিবুর রহমান মজুমদার, জিল্লুর রহমান জিল্লু, গিয়াস আহমেদ, প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন, আলহাজ্ব সোলায়মান ভূঁইয়া, শরাফত হোসেন বাবু, মন্জুর আহমেদ চৌধুরী, মোস্তফা কামাল পাশা বাবুল, মো. হেলাল উদ্দিন, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, কাজী সাখাওয়াত হোসেন আজম, এমদাদুল হক কামাল, অ্যাডভোকেট জামাল আহমেদ জনি, আক্তার হোসেন বাদল, মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ফিরোজ আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, মাহমুদ চৌধুরী, শামসুল ইসলাম মজনু, নিয়াজ আহমেদ জুয়েল, সৈয়দুল হক, শাহাদত হোসেন, মো. শাহ আলম, মো. মাহবুবুর রহমান, এমলাখ হোসেন ফয়সাল, আলহাজ্ব মো. বাবর উদ্দিন, মো. আব্দুস সবুর, মোশারফ হোসেন সবুজ প্রমুখ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দলের প্রয়োজনেই যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি আগে গঠন করা দরকার ছিল। কমিটি হলে এখানে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা হতো। মেইন স্ট্রিমে জোরালো ভূমিকা রাখা যেত। সরকারের দুর্নীতি এবং ভোট চুরির কথা জানানো যেত। দেশে সরকারের নিপীড়নের ভয়ে নেতাকর্মীরা যা বলার সাহস পান না, প্রবাসের নেতারা তা অনায়াসেই বলতে পারতেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় ধরনের আন্দোলন করা যেত। এমনিতেই বিএনপির আন্তর্জাতিক লবিং নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংকে দুর্বল করে ফেলে। অনেকের নামে মামলা-মোকদ্দমা দেওয়া হয় এবং চূড়ান্ত হয়রানিও করা হয়। অত্যাচরের কারণে অনেকেই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বিএনপির একমাত্র ভরসা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীরা। কারণ, অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি ব্যাপক অবদান রেখেছে। নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ওয়ান ইলেভেনের সময় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি তুমুল আন্দোলন করে। ওয়ান ইলেভেনের সময় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বন্দী। কোথাও তিনি বক্তব্য দিতে পারছিলেন না। ঠিক সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার সেই বক্তব্য সারা বিশ্বে প্রচার করা হয়েছিল। সেই সময় প্রায় ১০ জন সিনেটরের স্বাক্ষরযুক্ত একটি চিঠিও দেয়া হয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি জাতিসংঘ এবং হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ করে। তা ছাড়া তারা জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টেও চিঠি দিয়েছিলেন। তাদের আন্দোলন এবং চাপের কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ সুগম হয়েছিল। বর্তমানে কেন্দ্রীয় বিএনপি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সেই শক্তিকে ক্ষয় করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সূত্র জানায়, ২০১২ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি ভেঙে দেওয়া হয়। ওই সময় দলের গঠনতন্ত্রও মানা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী সম্মেলন করে কমিটি করা হয়। সম্মেলনেই আগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয় এবং নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এমনকি কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর আহ্বায়ক কমিটিও দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে।
তারা বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নতুন কমিটি দেওয়ার ইচ্ছে নেই। তারা আরো বলেন, ‘আমাদের কোনো দাবি নেই, কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, দেশে ব্যবসা চাই না, কেন্দ্রীয় কমিটির পদ চাই না- আমরা চাই শুধু যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নতুন কমিটি।’
দলীয় সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন যুক্তরাষ্ট্র শাখার ৫০১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লুকে আহ্বায়ক এবং সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টনকে সদস্যসচিব করা হয়। কিন্তু এই কমিটি থেকে অনেকে বাদ পড়েন এবং অনেককে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে এই কমিটি গঠন করা হলেও উল্টো সংকট আরো বাড়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্্যাপন কমিটি ঘোষণার পর ঐক্যের বদলে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিতে চরম অনৈক্য দেখা দেয়। গত এক দশকে কমিটি না পেয়ে নেতৃত্বের বিরোধ যতটুকু ছিল, সুবর্ণজয়ন্তীর কমিটি ঘোষণার পর বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি। দলীয় দ্বন্দ্ব-কোন্দল বেড়ে গিয়ে তা প্রকাশ্যে রূপ নেয়। সেই সময় সুবর্ণজয়ন্তীর কমিটিকে অনেকে ‘আগুনে ঘি ঢালা’ বলে মন্তব্য করেন। বর্তমানে এই কমিটি অনেকটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, কমিটি বিলুপ্তির পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে লন্ডনে ডেকে পাঠান। তাদের মধ্যে ছিলেন- সাবেক সভাপতি আব্দুল লতিফ সম্রাট, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ডা. মজিবুর রহমান মজুমদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু ও সিনিয়র সহ-সভাপতি গিয়াস আহমেদ। তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করতে প্রথমে আব্দুল লতিফ সম্রাট, জিল্লুর রহমান জিল্লু ও গিয়াস আহমেদ গিয়েছিলেন। পরে গিয়েছিলেন ডা. মজিবুর রহমান মজুমদার। সেই সময় সবার ধারণা ছিল, তারেক রহমান এই শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি দেবেন। ওই সময় লন্ডন থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছিলেন, কমিটি নিয়ে তাদের কথা হয়েছে। ওই সময় জিল্লুর রহমান জিল্লু ও গিয়াস আহমেদ সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। তারেক রহমান দুজনের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা তারেক রহমানের ওপর ভার ন্যস্ত করেছিলেন। তারেক রহমানকে বলেছিলেন, আপনি যাকে সভাপতি এবং যাকে সাধারণ সম্পাদক দেবেন, আমরা তাদের নেতৃত্বেই কাজ করব। তারেক রহমান তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি দেবেন। ওই সময় তিন শীর্ষ নেতাকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীরা ফুলের মালা দিয়ে এয়ারপোর্টে বরণ করেছিলেন। এরপর এক দশক অতিবাহিত হলেও তারেক রহমান বা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কমিটি আজ পর্যন্ত দেননি। ফলে দলে হতাশা এখন চরম আকার ধারণ করেছে।