চকবাজার ট্র্যাজেডি: দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা অবহেলা : হাইকোর্ট

রাজধানী ডেস্ক : পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রাণহানির ঘটনায় হাইকোর্ট বলেছেন, এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা অবহেলা। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। একজন দায়িত্বশীল আরেকজনের ওপরে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন, এটা ঠিক না। দেশের অর্থনীতির অনেক অগ্রগতি হয়েছে; কিন্ত এ ধরনের ঘটনা ভাব-মর্যাদা নষ্ট করে দিচ্ছে।

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, আগুনে মানুষ পুড়ে মরে, তা হলে সিটি করপোরেশন কী করে? শুধু আন্তরিক হলে হবে না; কাজও করতে হবে। নিমতলীর ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির যে সুপারিশ ছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে চকবাজারে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।

বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পৃথক তিনটি রিটের শুনানিতে এসব কথা বলেন। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণসহ কয়েক দফা নির্দেশনা চেয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এই রিটগুলো করা হয়। রিটে ২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জনের প্রাণহানির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নেরও নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। পৃথক রিটগুলো করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ, নুর মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মো. সায়েদুল কাউছার ও সাগুফতা তাবাসুসম।

আদালতের রিট আবেদনগুলোর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অমিত দাশগুপ্ত ও মো. রিয়াজ উদ্দিন। অন্য দিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।

শুনানির শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সময় চেয়ে আবেদন করেন। এ সময় সরকার অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় খুব আন্তরিক বলেও জানান তিনি। তখন আদালত সিটি করপোরেশনকে সতর্ক করে বলেন, শুধু আন্তরিক হলে হবে না; এ জন্য প্রয়োজনীয় কাজও করতে হবে।এ সময় নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করে আদালত বলেন, নিমতলীর আগুনের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী দুই বোনকে দত্তক নিয়েছিলেন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ সময় বলেন, সরকার এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক।

জবাবে আদালত বলেন, আন্তরিক হলে লাভ নেই। মানুষ তো চলে গেছে। কাজ তো করতে হবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য তুলে ধরে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেই চকবাজারের ঘটনা তদারক করেছেন। এ সময় বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, উনি তো একা দেশ চালাতে পারবেন না। সুপারিশ (নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ড) বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেরও দায়িত্ব রয়েছে। আদালত আরও বলেন, ওই সব এলাকার বাড়ির মালিকরা তিন গুণ বেশি টাকায় গোডাউন ভাড়া দেন। আর নিজেরা থাকেন গুলশানে। মারা যায় গরিব মানুষ। সিটি করপোরেশন দেখেও না দেখার ভান করে। যারা রাস্তায় মারা গেল, তাদের কী দোষ?

নিমতলীতে অগ্নিকাÐের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ১৭ দফা সুপারিশের উল্লেখ করে আদালত বলেন, পত্রিকায় দেখেছি, সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা বাস্তবায়ন করা তাদের দায়িত্ব ছিল। জানি না তারা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না। না নিলে ধরে নিতে হবে, তাদের অবহেলা ছিল।

আদালত আরও বলেন, পুরান ঢাকার রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও যেতে পারে না। ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে না হয় কিছু হবে না। কিন্তু ৭ থেকে ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে কোনো বিল্ডিং থাকবে না। এ ধরনের ভূমিকম্প হলে কাউকে উদ্ধার করারও কেউ থাকবে না।

এ সময় রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, নিমতলীর ঘটনায় কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় চকবাজারের ঘটনা ঘটেছে। তিনি কোর্টকে এ বিষয়ে শুনানি গ্রহণের আবেদন জানান। আইনজীবী বলেন, এ কাজে সরকারকে সম্পৃক্ত না করলে সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে না। তখন আদালত বলেন, আমরা তো সরকারের বক্তব্য শুনতে চাই। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সময় চেয়েছেন। আপনারা সবগুলো রিট একসঙ্গে করে নিয়ে আসেন। গত ২৬ ফেব্রæয়ারি শুনানি গ্রহণ করা হয়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় ৬৭ জন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। এখনও বেশ কজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

১৯ লাশের জন্য ৪৩ জনের নমুনা সংগ্রহ : রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ১৯ জনের মরদেহ হাসপাতাল মর্গে পড়ে আছে অজ্ঞাত হিসেবে। এগুলোর বিপরীতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লাশের দাবিদার হিসেবে পরিবারসংশ্লিষ্ট ৪৩ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ লাশের পরিচয় ১৫ দিনের মধ্যেই শনাক্ত করা যাবে। বাকি পাঁচ লাশের জন্য তিন সপ্তাহ বা এরও বেশি সময় লাগতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, লাশগুলো পুড়ে বিকৃত ও খণ্ডিত হওয়ার কারণে ১৯টির বেশি হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিটি লাশের দাবিদার পরিবারের একাধিক সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ কারণে এখনই লাশ ও নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না।

রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কার্যালয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার এসব কথা জানান।

এ দিকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনোয়ার হোসেন (৫৫) নামে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। রাত সোয়া ১০টায় রিকশাচালক আনোয়ারকে মৃত ঘোষণা করা হয় বলে জানান বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল।

এ নিয়ে চুড়িহাট্টায় নিহতের সংখ্যা ৬৮ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জনের মরদেহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তকরণে কাজ করছে সিআইডি। এসব মরদেহের বিপরীতে পরিবারসংশ্লিষ্ট ৪৩ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে এসব নমুনা পরীক্ষা করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল হায়দার বলেন, ‘৬৭টি মরদেহের মধ্যে ১৯টি এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অন্যদের মরদেহ শনাক্ত করে জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই মরদেহের একাধিক দাবিদার হিসেবে ১৯টি মরদেহের বিপরীতে ৩৮ জনের গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মরদেহের মাসল ও রক্ত নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলোর পরিচয় নিশ্চিত হতে সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় লাগবে। বাকি পাঁচটি মরদেহের অবস্থা খুবই খারাপ হওয়ায় সেগুলোর মেরুদণ্ড ও ঘাড়ের হাড়ের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো থেকে স্যাম্পল সংগ্রহের পর্যায়ে আসতেই অন্তত তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। এরপর ডিএনএ ম্যাচিংয়ের বিষয়টি আসবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মহাখালীতে আমাদের কেমিক্যাল ল্যাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট তদন্ত দপ্তর ফায়ার সার্ভিস সহায়তা চাইলে সেসব পরীক্ষায়ও সহায়তা করবে সিআইডি।’

পরবর্তী সময়ে কোনো পরিবার লাশের দাবি করলে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ২৫৭টি ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ৬৭টি মরদেহের স্যাম্পলই আমাদের কাছে রয়েছে এবং এটা যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত থাকবে। কোনো পরিবার পরবর্তী সময়ে দাবি জানালে তখন পরীক্ষা করা হবে। তবে এই চ্যালেঞ্জের বিষয়টি অবশ্যই আদালতের মধ্য দিয়ে আসতে হবে।’

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-ফরেনসিক) রুমানা আক্তার বলেন, ‘চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ৬৭টি মরদেহ থেকে ২৫৬টি (রক্ত, টিস্যু, হাড় ও বাক্কাল সোয়াব) ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি বিচ্ছিন্ন হাতকে পৃথক আলামত হিসেবে গণ্য করে সেটি থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ফলে মোট সংগৃহীত নমুনার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৭টি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। স্বজন নিহত বলে দাবি করা পরিবারের একাধিক সদস্যও নমুনা দিয়েছে।’

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত অস্থায়ী বুথের মাধ্যমে লাশের দাবিদারদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৩ জন নিকটাত্মীয় থেকে ৪৩টি রেফারেন্স নমুনা সংগ্রহ করা হয়। অশনাক্তদের পরিচয় নিশ্চিত হতে সিআইডির ফরেনসিক টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে।

সিআইডির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের খণ্ডিত লাশের ক্ষেত্রে সংখ্যা নিরূপণ কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ১৯টি লাশ বলেই এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে। এই লাশের সংখ্যা ও পরিচয়- দুটি বিষয়ই ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ কারণে নিখোঁজ দাবি করে আসা ৪৩ জনের নমুনাই গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একই পরিবারের একাধিক সদস্যও আছে। তিনি আরো বলেন, নিহত যুবক ব্যক্তির বাবা ও মায়ের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের নমুনাও গ্রহণ করা হয়েছে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে একটি নমুনাই গ্রহণ করা হয়েছে।

চলে গেলেন রিকশাচালক আনোয়ার : গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ১০টায় বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আবস্থায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) চিকিৎসকরা আনোয়ার হোসেন নামে আরেকজনকে মৃত ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক আধ্যাপক ডাক্তার আবুল কালাম জানান, আনোয়ারের শরীরের ৬১ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। সোহাগসহ আরো তিনজনের অবস্থাও সংকটাপন্ন।

নিহত আনোয়ারের ছেলে হৃদয় জানান, তার বাবা রিকশাচালক ছিলেন। ঘটনার সময় রিকশা চালিয়ে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন দগ্ধ হন। আনোয়ারের বাড়ি রাজবাড়ী হলেও বর্তমানে স্ত্রী হাজেরা, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ছাপড়া মসজিদ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন।

পুরান ঢাকার ডাটাবেজ তৈরিতে মাঠে রাজউক: পুরান ঢাকার ভবনগুলোর ডাটাবেজ তৈরি করতে মাঠে নেমেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রথম ধাপে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে চকবাজার দিয়ে। পর্যায়ক্রমে পুরান ঢাকাসহ রাজউকের আওতাধীন পুরো এলাকার ডাটাবেজ তৈরি করার পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি। ঢাকায় কতগুলো ভবন আছে, কোনটি কয়তলা, কোন ভবনে কী ধরনের কার্যক্রম চলমান প্রভৃতি তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে এতে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে বৈঠক করে দুপুরেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠে নামে রাজউক। প্রথম দিনে ৪৭টি ভবনের ডাটা সংগ্রহ করেন রাজউকের কর্মকর্তারা। গত ২৫ ফেব্রুয়ারিও স্বল্প পরিসরে এই কাজ চলেছে বলে জানান রাজউকের পরিচালক (জোন-৫) শাহ আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, রাজউকের জনবলের অভাব রয়েছে। তারপরও এ কাজটি করতে হবে। এতে রাজউকের কাছে ভবন সম্পর্কিত তথ্য থাকবে এবং যেসব ভবনে মিশ্র ব্যবহার চলবে, সেগুলোকে নোটিশ দেওয়া যাবে। এ ছাড়া রাজউকের অনুমোদনহীন ভবনগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে ভবন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রাথমিকভাবে পুরান ঢাকায় তা ফিরিয়ে আনা হবে।

প্রাথমিকভাবে ডাটাবেজ তৈরির জন্য একটি ফরম তৈরি করা হয়েছে। এই ফরমে রয়েছে এলাকার নাম। তারপর রাস্তার নাম ও প্রশস্ততা, হোল্ডিং নম্বর, মালিকের নাম, ফোন নম্বর, হোল্ডিংয়ের জমির পরিমাণ বা আয়তন, হোল্ডিংয়ের তলার সংখ্যা, ইমারতের বিবরণ, প্রতি তলার ব্যবহার, রাজউকের অনুমোদন থাকা বা না থাকা, হোল্ডিংটির নির্মাণকাল সংবলিত সরণি রয়েছে ফরমে। এ ছাড়াও সর্বশেষ পর্যায়ে আরেকটি সরণি রয়েছে, যেখানে এসব তথ্য সংগ্রহকারী অথরাইজড অফিসার, চিফ ইন্সপেক্টর, ইন্সপেক্টর ও সহকারী অথরাইজড অফিসার তাদের মতামত দেবেন। কোনো ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে তারা মতামতের সরণিতে এ সম্পর্কে মতামত দিতে পারবেন। কোনো ভবনের সামনে রাস্তার প্রশস্ততা কম থাকলে সে ব্যাপারেও জরিপকারী কর্মকর্তা মতামত দিতে পারবেন। জরিপকারী পুরো ভবন পর্যালোচনা করে স্বাক্ষরসহ মতামত দেবেন। তিনি ভবনের মালিক বা মালিকপক্ষের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে ডাটাবেজ তৈরি করবেন।

প্রথম ধাপে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে চকবাজারের চুড়িহাট্টা থেকে। পরে বাবুবাজার থেকে সাভারের বংশী নদী পর্যন্ত রাজউক এলাকায় (রাজউকের ৫ নম্বর অঞ্চল) এই জরিপ পরিচালিত হবে। রাজউক মনে করে, এ ধরনের জরিপ করে ডাটাবেজ তৈরি করলে বাড়ির মালিকরা ইচ্ছামতো ভবনের মিশ্র ব্যবহার করতে সাহস পাবেন না এবং পুরান ঢাকায় তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। একটি এলাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ডাটাবেজ হচ্ছে এরই প্রথম ধাপ। গত ২৪ ফেব্রæয়ারি ৫ নম্বর জোনের (বাবুবাজার থেকে সাভারের বংশী নদী পর্যন্ত) ১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠ পর্যায়ে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তিনজন সহকারী অথরাইজড অফিসার, নয়জন ইন্সপেক্টর ও তিনজন চিফ ইন্সপেক্টর। এই জোনে বর্তমানে অথরাইজড অফিসারের পদ শূন্য থাকায় সহকারী অথরাইজড অফিসার সুরত আলী রাসেল মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সুরত আলী রাসেল বলেন, কাজটি করা বেশ কঠিন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ভবনের মালিকরা তথ্য দিতে চাইছেন না। রাজউকের লোক শুনলেই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তারপরও সবাইকে বুঝিয়ে প্রথম দিনে প্রায় ৫০টি ভবনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিনে আরও কিছু ভবনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ভবন চুড়িহাট্টা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত ধ্বংসস্তূপের আশপাশের চারটি সড়কের।

সুরত আলী রাসেল আরও বলেন, যেসব ভবনের তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেরই অনুমোদিত নকশা নেই। দু-একজন ছাড়া অন্যরা কেউ ভবনের নকশা দেখাতে পারেননি। কয়েকজন বলেছেন, নকশা পরে দেখাবেন। প্রাথমিকভাবে তাদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে, ভবনের কোন তলা কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে। দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ভবনেরই মিশ্র ব্যবহার চলছে। ভবনের নিচতলায় বেশির ভাগই দোকানপাট হিসেবে কিংবা বাণিজ্যিক অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার কারখানা-গোডাউনও আছে। ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক সংরক্ষণের পাশাপাশি আবাসিক হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে কিছু তলা। এক কথায় মিশ্র ব্যবহারের চিত্র পাওয়া গেছে প্রায় প্রতিটি হোল্ডিংয়ে।

রাজউকের পরিচালক শাহ আলম চৌধুরী বলেন, ১০ বছর আগে রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। এবার সব ভবনের তথ্যই সংগ্রহ করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে কি না, এবারের জরিপের পর সেটাও বেরিয়ে আসবে।