চলো আগে নেচে নিই

হুমায়ূন কবির

বুকে পানি নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়া অচেতন এই রোগীটিকে নিয়ে প্রথম দিন খুব চিন্তায় ছিলাম। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নির্দিষ্ট কিছু ধরা পড়ছিল না। তবে পরের দিন সকালের রাউন্ডেই সব পরিষ্কার হলো। থাইরয়েড হরমোনের মারাত্মক স্বল্পতা। ডাক্তারি পরিভাষায় রোগের নাম মিক্সোডিমা কমা। আমার ডাক্তারি জীবনে মাত্র কয়েকবার পেয়েছি, এটাই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। চিকিৎসা শুরুর একদিন পরেই নড়াচড়া শুরু করলো। সপ্তাহান্তে অনেকটা সুস্থ, আইসিইউ থেকে ফ্লোরে পাঠানো গেলো। আরো এক সপ্তাহ পরে এবার বাড়ি পাঠানোর পালা।
এ দুই সপ্তাহে বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। সম্পূর্ণ অচেতন ছিল যে, সে এখন সুযোগ পেলেই আমার হাত চেপে ধরে, কিছুতেই ছাড়বে না। নার্সরা এসে জোর করে ছাড়ায়। সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটি বার বার মাফ চায়। কী করবে? রোগীতো জন্মেছে ডাউনস সিন্ডোম নিয়ে। ভালো মন্দ বুঝে না।
গ্যারি’র বাবা-মা বেঁচে নেই। ভাই ট্যারি তার দেখাশোনা করে। কেস ম্যানেজমেন্টের একজন প্রশ্ন তুললো, এই রোগীকে বাড়িতে পাঠানো ঠিক হবে কী? ভাইটি কি যথাযথ যতœ করেছে তার? থাইরয়েডের স্বল্পতা এতোটা মারাত্মক কি একদিনেই হলো? ঠিকমতো ডাক্তারের কাছে নেয় না, ইত্যাদি। কথাটায় যুক্তি আছে। ঠিক হলো পরের দিন মিটিং হবে। প্রয়োজনে সোস্যাল সার্ভিসে খবর দেয়া হবে। ওরা তদন্ত করুক।
বিকেলে অফিস শেষে ঘরে ফেরার আয়োজন করছি। শার্লি, আমার অফিস ম্যানেজার, এসে সামনে বসলো। ভাবসাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘ কিছু একটা আলাপ শুরু করবে। থামিয়ে দিয়ে বললাম, কাল হবে। আজ তাড়া আছে। শার্লি নাছোড়বান্দা।
-কাল হলে হবে না। আজই শুনতে হবে।
-কেন? কি হয়েছে?
-গ্যারি’র ডাক্তার ঠিক করেছে তাকে নার্সিং হোমে পাঠাবে। ওর ভাই এসে কান্নাকাটি করছে।
-কান্নাকাটি করলেই হলো? গ্যারি তো মারাই গিয়েছিলো প্রায়। ভাই দেখাশোনা করছে না ঠিকমতো। শুনেছি সারা বছরে একবার মাত্র ডাক্তারের কাছে নিয়েছে। বাড়িতেও নাকি তেলাপোকা ঘুরে। গ্যারি’র সার্বক্ষণিক দেখভাল দরকার। ওর জন্য নার্সিং হোমই ভালো।
এভাবেই আলোচনার শুরু। কিন্তু শার্লির মুখে পরের আধঘণ্টা কাহিনীটার শেষ শুনে অবাক হয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। গ্যারি’র জন্ম জার্মানির স্টুগটার্ট শহরে। বাবা ছিলেন মিলিটারিতে। পার্ল হারবার আক্রান্ত হওয়ার সময় হাওয়াইতে চাকরির শুরু। এরপর কোরিয়া হয়ে শেষে জার্মানি। গ্যারি’র জন্মের কিছুদিন পরেই ডাক্তাররা জানালেন, ডাউনস সিনড্রোম। ভালো হবে না। দুর্ভাগাদের দুঃসংবাদ একে একে আসে। গ্যারি’র জন্মের এক বছরের মাথায় বাবার হার্ট এটাক। মিলিটারি থেকে অবসর নিয়ে বাড়ি। বাড়ি মানে কেন্টাকির প্রত্যন্ত এক গ্রাম। আর বাড়ি ফেরার তিন বছরের মাথায় মারা গেলো বাবা।
এবার মার হাতে সংসার। পেনশনের টাকা আর অন্যান্য আয় দিয়ে কায়ক্লেশে চলছিল কোনো মতে। আশায় আছে দিন ভালো হবে। গ্যারি’র কিছু না হলেও ছেলে-মেয়ে দুটি আর স্কুলে যাচ্ছে। সামনেই সুদিন।
কিন্তু সুদিন দেখার সময় পেল না মা। ক্যান্সারে ভুগে ভুগে মারা গেল। মরার আগে ট্যারি’র হাত ধরে বলে গেল, গ্যারিকে দেখিসরে বাবা। ওকে নার্সি হোমে পাঠাস না। মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের হাত ধরে কথা দিয়েছিল ট্যারি, বেঁচে থাকতে এ কাজ করবে না সে।
হাইস্কুল শেষ করার পর আর পড়াশোনা করেনি ট্যারি। স্থানীয় একটি কলেজে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ তার। সামান্য বেতন। বিধবা বোন জেনিফারও থাকে এক বাড়িতে। বোনের ছেলেমেয়ে নেই। কাজেই গ্যারির দেখভালের কোনো অসুবিধা নেই। শার্লিকে জিজ্ঞেস করলাম কথাটা।
-ট্যারি বিয়ে করার পর কী হবে?
-ট্যারি ঠিক করেছে বিয়ে করবে না।
-তুমি বিশ্বাস করেছো সেটা?
বুঝা গেল উত্তরটা তৈরি ছিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো শার্লি।
-জগতে কতো অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো ঘটে। গল্পটাই প্রায় অবিশ্বাস্য। তাই নয় কি? এবার অমার চুপ করে থাকার পালা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপারটা বড়ই কঠিন। না, গ্যারিকে নার্সিং হোমে পাঠানো হয়নি। বাড়িতেই গেছে সে, ভাইয়ের সঙ্গে। ভাঙা ট্রেলারটি ঠিক করাবার জন্য টাকা তোলা হচ্ছে এখন। ভাইবোন দুজনে মিলে গ্যারির যতœ নেয় ঠিকঠাক। ডাক্তারের কাছে নেয় নিয়মিত। আমার কাছে নিয়ে আসে তিনমাস পর পর। গ্যারি এখন বেশ চটপটে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হলেও দেখতে শুনতে আর আচার ব্যবহারে বাচ্চা ছেলের মতো।
খ্যাতনামা চিকিৎসক ও মননশীল সাহিত্যিক, টেনেসি।