রেজা নুর
চৈত্রের দুপুর কেবল গড়িয়েছে। রোদে তখনও ঝাঁঝ। সেই রোদের সাথে মিশেছে রাস্তার ধুলোঝড়। পাকিস্তান আর্মীর খোলা জীপে দুই সারিতে বসে আছে ছয়জন জওয়ান। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসা সালাম মওলানা। অন্য সময় হলে গাড়ির পেছনে ছেলেমেয়েদের হই হল্লা শোনা যেত। এখন শুধু ইঞ্জিনের হু হু শব্দ। কঠিনমুখে বসে আছে সৈন্যরা। ওদের চেয়েও শক্ত সালামের মুখ। বাড়ির সামনে এসে জীপ থামলো।
ঘ্যর আ গ্যায়ে, আপলোগ আইয়ে। বিগলিত হয়ে হাত বেঁকিয়ে ইশারা করলো সালাম।
খই ফোটার মতো বুটের আওয়াজ উঠলো মাটিতে। ধূলো ছিটকে উঠে পথের পাশের কচিঘাস আর কলাগাছের সবুজ পাতা মলিন করে দিলো। সাতজোড়া বুট মাটির বুক খাবলে খাবলে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতরে। দুপুরে খেয়ে দেয়ে দহলিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন ইরফান। উঠোনে সোরগোল শুনে ঘুম ভাঙল। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এলেন। পাজামার ওপরে হাতাওয়ালা গেঞ্জি গায়ে। বিকেলের রোদে চিক চিক করছে তাঁর মেহেদি মাখানো চুল আর দাড়ি।
ইয়ে মেরি আব্বুজি হ্যায়।
আচ্ছা। তো কীয়া কারতা হ্যায়, ইয়ে…, আপকি আব্বু? তাচ্ছিল্যের হাত হাওয়ায় মেলে জানাতে চাইল একজন।
প্যাহলে মাদরাসা কি প্রিন্সিপাল থে। আব রিটায়ার র্কা চুকে হে। মসজিদ মে নামাজ পাড়াহ তে হে।
ঈমাম ছাব হে। বোহোত আচ্ছা। বোহোত আচ্ছা। ছালাম ছাব।
ইরফান মুনসী কোনোরকমে হাত তুলে সালামের জবাব দিলেন। ইশারায় সালামকে ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন।
কি ব্যাপার রে। আর্মী আমার বাড়ি কেন?
আব্বা, এরা আজ রাতে আমাদের এখানে খাবে। রাজগঞ্জে ক্যাম্প হচ্ছে, এলাকায় যাতে দেশদ্রোহীরা হুটোপাটা না করতে পারে। এরা খুব ভাল। দেখলেন না, আপনারে কত সম্মান করলো?
তুই, একজন মাদরাসার শিক্ষক। তোর বোধবুদ্ধি এই পর্যায়ের তা তো ধারণা করতে পারি নি আগে!
কি কচ্ছেন আব্বা। কত সাধের পাকিস্তান আমাদের। এরা সেই মূল অংশের লোক। দ্যাখেন না গায় গতরে চেহারায় কেমন রাজা রাজা ভাব।
মূর্খ, তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর রাজাদেরও বের র্ক আমার বাড়ি থেকে।
আব্বা। রাগ করে লাভ নেই। পাকিস্তান রক্ষা করতে হবে। আপনি প্রয়োজনে চুপ থাকেন। ওদের সামনে এইসব কথা বলবেন না। আর, সামাদ কোথায়? ওর সম্পর্কে বাজারে কিছু কথা শুনলাম। ওকে সাবধান করে দিতে হবে।
উঠোনের শেষে, ডানে দহলিজ ঘর। টালির ছাউনি, ইটের দেয়াল। জানালা দক্ষিণে বাওয়ের দিকে খোলা। বিকেলে ওদেরকে চা নাস্তা খাইয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে সালাম। রাতের খাবারের আয়োজন চলছে। নিজে খাশি জবাই দিয়ে ছুলে-কুটে রান্না করতে বলেছে মাকে। মা আগুনচোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরে গিয়ে বসে আছেন। বউ, সালামের দিকে তাকায় নি পর্যন্ত। শুধু ছোট দুটো সন্তানের দিকে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে চলে গেছে। কাজের মেয়ে রান্না করছে। সালাম পাশে বসা। থালাবাটি রেখে রেখে আসছে খাবার টেবিলে। টিমটিমে আলোয় দুটো হারিকেন জ্বলছে। হাতিয়ার দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা। একটু পর পর তাড়া দিচ্ছে।
কীয়া হুয়া মওলানা ছাহাব। ইতনি র্দে কীঊ। পেট মে চুহা দৌঁড় রাহা হে।
হো গ্যাায়া জ্বী। ছব খানা আভি আ’রাহা হে।
কাজের মেয়েটাকে ধমক দিয়ে গোসতের পুরো পাতিল নিয়ে আসতে বললো সালাম। মাথায় ঘোমটা টেনে অতি সাবধানে টেবিলের এককোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল সে। খপ করে হাত থেকে পাতিল নিয়ে টেবিলে রাখলো সালাম। ছয়জোড়া চোখ মেয়েটার দিকে। একজন বলে উঠলো,
আহা, ইতনি শরমাতা কিউ হে। নাম কেয়া হে তেরা?
রুটি বানানো হাতে লেগে থাকা শুকনো আঁটা খুটতে খুঁটতে মুখ আরও নামালো মেয়েটা। সালাম উত্তর দিলো, উচ্কা নাম, ঝরণা হে।
ঝারণা ! ইয়া নে কি ব্যাহতা পানি। ইয়ে তো জান্নাত কি প্যারী লাগরাহা হে। ইয়া মিঠা পানি মে ত্যায়ার তে হুয়ে মাছলি। নাজর আতেই খলবালি মাচতা হে দিলমে। হাঠাও, হাঠাও, পারদা হাঠা দো মুহ ছে।
জানালার পর্দা সরিয়ে একঝাঁক বাতাস ঘরে এলো। কাঠের পাল্লাদুটো সটান সরে গেলো দু’দিকে। সচকিত চোখে তাকাল সবাই। তারপর খাবার মুখে দেবার জন্য হাত উঠাল। সালাম দৃষ্টি সরালো না। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসা বন্দুকের নলে চোখদুটো বিস্ফারিত হতে লাগলো। কয়েক সেকে-। মুহূর্তেই গুলির আওয়াজ। একজন সৈন্যের মুখের কাছের মাংসখ- ছিটকে সালামের চোয়ালে এসে লাগল। ঘরের এককোণায় গিয়ে কাঁপতে লাগলো সে। অন্যান্যরা হেলান দেয়া অস্ত্র ওঠাতে যাবে, এমন সময় বারান্দা দিয়ে উঠে এলো দশবারো জন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁঝরা করে দিলো ওদের শরীর। চেয়ারের ওপরে, মাটিতে ময়লার ঢিবির মতো পড়ে রইল নি:সাড় দেহ। ইরফান মুনসীর হাতে গাছকাটা দা। আগে আগে ঘরে ঢুকে যে সৈন্যটা ঝরণার হাত ধরেছিল, তার নিস্তেজ হাতের ডানায় কোপ দিলেন। হাতখানা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেলো। একটি হারিকেন টেবিলের কোণায় পড়ো পড়ো হয়ে জ্বলছে। আরেকটা নিচে পড়ে গিয়ে কেরোসিন ছড়িয়েছে। চিমনি ফেটে কাচের গুঁড়ো ভেজা কেরোসিনের ওপর। এক চাঙড়া আগুন হয়ে জ্বলছে হারিকেনটা। সামাদ সৈন্যদের হাতিয়ার এক জায়গায় করলো। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললো, এই তোরা এদেরকে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা কর। পয়লা অপারেশন, সাকসেস।
দা উঁচিয়ে কোণার দিকে গেলেন ইরফান। উবু হয়ে বসে সালাম ভীত চোখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। ইরফান দা নামালেন না। কোপ দেবার ভঙ্গি করলেন। চোখ বুঁজলো সালাম। পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
কেঁদে লাভ হবে না। তুই এইসব হারামীদের চাইতেও খারাপ।
মাফ করে দাও আব্বা। আর এমন করবো না।
একবার মাত্র মাফ করতে পারি, তাও এক শর্তে। সামাদের গ্রুপে কাজ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।
করবো আব্বা, করবো। আল্লাহর কসম, করবো।
পয়লা সাজা হিসেবে তুই এখনই, এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হ। কোথায় থাকবি জানি না।
মণিরামপুর থানা থেকে পূবদিকে ছিয়ানব্বই গ্রাম। এই গ্রামগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে তুলসীর ঘ্রাণ, শঙ্খনাদ আর সকাল-সন্ধ্যার উলুধ্বনি। থানায় এলাকার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প করেছে আর্মীরা। ধূলো উড়িয়ে টহল দিয়ে চলেছে। আজ আরও বেশি সাঁজোয়া যাত্রা সেদিকে। মৌচাকের মতো গেঁথে থাকা গ্রামগুলোর রাস্তায় শুধু ইঞ্জিনের শব্দ। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এলাকার কিছুলোক। তাদের মাঝখানে বসে আছে সালাম। চোখে আগুন। জীপটা আস্তে চললেও হালকা বাতাসে কালো আলখাল্লা পাজামার পায়ের দিক থেকে উড়ছে। মাজা পর্যন্ত উড়ে গোল হয়ে আছে। মাজার গামছার কারণে পুরো শরীরে বাতাস ঢুকতে পারছে না। স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় মাঠে কিছু ছেলেরা ফুটবল খেলছে দেখতে পেলো। হুংকার দিয়ে গাড়ি থামাতে বললো।
স্যার, ইনলোগোকে শিকসা দো। ইয়ে লোগ দো’দিন বাদ মেরে ভাই কি তারাহ মুক্তি মে জায়েগা। ছব কাফের হে, পাকিস্তান কি খিলাফ হে।
পাঁচটি জীপে জনা পঞ্চাশেক পাকিস্তানী আর্মী। দ্বিতীয় গাড়ি থেকে ওদের লিডার নেমে মাঠের দিকে গেল। ছেলেরা খেলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুয়েকজন দৌঁড়ে পালাতে যাচ্ছিল। ফাঁকা গুলির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াল। হাতের ইশারায় ওদেরকে ডেকে লিডার বলল, আগার পাকিস্তানমে র্যাহনা হে, তো পাকিস্তানি বানকে র্যাহনা পাড়ে গা। ওয়ারনা ¯্রফি দো রাস্তা খোলা হে, এ্যক, মউতকি ছমুন্দর, দুছরা, হিন্দুস্তান।
রাজগঞ্জ মিলিটারি ক্যাম্পে আর্মী বাড়ানো হয়েছে। এই এলাকা মুক্তিবাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, এইকথা মিথ্যে করবার জন্য অভিযানে নামবে তারা। হানুয়ার প্রথম টার্গেট। সেখানে কাদের বাস তা আসল কথা নয়। ওখানে কয়েকঘর হিন্দু বাস করলেও সব মুসলমানরা নাকি দেশটাকে আবার হিন্দুস্তান বানাবার চক্রান্তে লিপ্ত। ক্যাম্প থেকে চারটে আর্মী ট্রাক রওয়ানা দিলো মানিকগঞ্জের দিকে। বড়পুলের কাছে এসে হাত-মাইক নিলো সালাম মওলানা।
‘এলাকাবাসী, হানুয়ারবাসী, কান খুলে শোনো। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রে তোমরা হিন্দুদের সাথে মিলিত হয়েছ, হিন্দুদের মতোই পরিণতি ভোগ করতে হবে। হানুয়ার গ্রামে সর্ষে ফলিয়ে ছাড়বো আমি। আজই মুক্তিরা আত্মসমর্পণ না করলে কাল অপারেশন শুরু।’ বলতে বলতে হাত ইশারায় ড্রাইভারকে হানুয়ারের দিকে যেতে বলল।
আর্মীর গাড়ির আনাগোনায় ও সালামের ধমকে এলাকা থমথমে। গাছের পাতা নড়ছে না। অন্যান্য দিন বড় রাস্তায় বিক্ষিপ্ত লোকজন গল্প করতে করতে বাজারে যায়। রাতে আবার সেভাবে বাড়ি ফিরে আসে। আজ সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। যেন কেয়ামত কাল। ছিয়ানব্বই গ্রামের কথা শুনেছে সবাই। অসহায় মানুষের ¯্রােত দেখেছে। দেখেছে নবজাতকের মৃত্যু। বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবা দৌঁড়োছে। একটু গেলেই যেন বেঁচে উঠবে তার সন্তান। ঝুঁড়ির ভেতর মৃত মাকে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে চলছে দু’সন্তান। এই ভূমি মরার পরেও কি তাদের আশ্রয় হতে পারতো না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রুর ধারায় দেখেছে এই জনপদের নরনারী, কীভাবে প্রসূতি তার সন্তান প্রসব করে মৃত ভেবে প্রাণের ভয়ে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে। তিন বছরের মেয়ে কোলে কখন মরে আছে টের পায় নি পিতা। পাশে হেঁটেচলা মা’কে বলেনি। শেষে কান্নায় চলা থেমে যায়। উফ, অবিশ্বাস্য। এই চোখ দেখেছে কি এমন! কাল কি তাদেরও পরিণতি তেমন হতে চলেছে!
সন্ধ্যা পেরিয়েছে। চারদিকে আলো কমেনি তবু। আজ পূর্ণিমা। চাঁদ দুষ্টু শিশুর মতো পৃথিবীর দিকে হেসে আছে দিগন্তে। জ্যৈষ্ঠ’র মাঝামাঝি এই সময়ে বাতাসের মেজাজও ফুরফুরে, ঘ্রাণময়। প্রদীপ সেনের বাড়ির পেছনের কাঁঠালবনের বাতাস ম ম করছে। তার কিছু ঘ্রাণ এই দহলিজের প্রায়ঘন অন্ধকারে বসে থাকা মানুষের মুখচোখ ছুঁয়ে আছে।
খাটের ওপরে সারি সারি বসে থাকা ছায়ামূর্তিগুলোর হাত শক্ত হয়ে আছে। চোখে জীবন-মরণের পণ। সামাদ ও প্রদীপ মুখোমুখি। সুদীপ দাঁড়ানো।
প্রথম শুরু কোথা থেকে করবা, সামাদ।
বাড়ি থেকে। আমাদের বাড়ি থেকে স্যার। তারপর ক্যাম্প।
মানে?
সালামরে আর রাখা যাবে না।
কী বলছো, সামাদ। ও তোমার মায়ের পেটের ভাই।
ছিল । এখন নেই। ও আমাদের সব ঘাঁটি জেনে গেছে। দিনে দিনে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
ওকে পাবা কীভাবে। ওর সাথে তো আর্মী থাকে।
আজ বিকেলে ধমক দিয়ে মনে করেছে এলাকা ওদের আয়ত্বে। বিকেলে বাড়ি এসেছে। একা একা। হাসছে ঘন ঘন। সুদীপ, তুমি ক্যম্প অপারেশনে নেতৃত্ব দেবে। গফুর তোমার এসিসট্যান্ট। স্যার, আপনি থাকবেন আমার সাথে।
সামাদ, তুমি নিজ হাতে… ।
না, স্যার, নিজ হাতে না। লোক আছে। তবে আমি নিজ চোখে দেখবো।
আমি না গেলে হয় না? একজন বাবা হয়ে আমি এই দৃশ্য কীভাবে দেখবো বলো। বন্ধুর সন্তানের মরণ! তা’ছাড়া ও আমার ছাত্র।
স্যার! আপনি…। আপনি বলছেন এমন কথা? শক্ত করেন মন। এখন আমাদের সামনে শুধুই দেশ। দেখেন, এই সন্ধ্যার চাঁদ কেমন চুপি চুপি আলো জ্বেলে আছে আমাদের আকাশে। আমাদের রসময় ঋতু পাকাফলের ঘ্রাণে কেমন ভরিয়ে তুলেছে বাতাস। এই বাতাসে আর কদাকার নিশ্বাস যেন না পড়ে।
আগে বাড়ি এসে মাঝে মাঝে দহলিজ ঘরে ঘুমাতো সালাম। সেদিনের ঘটনার পর ভয়ে আর ওখানে যায় না। মাঝের ঘরে একা শুয়ে আছে। দু’দিন আগে ওর বউ, বাচ্চাদুটোকে নিয়ে কোমলপুর বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে।
চাঁদ এখন মাথার উপরে। এত তীব্র জোছনা আগে দেখে নি সামাদ। নাকি এমন করে দেখা হয় নি। কাঁধে হাতিয়ার ঝুলিয়ে গায়ে গামছা জড়িয়ে প্রদীপের দহলিজ থেকে রাস্তায় নামলো কয়েকটা ছায়ামূর্তি। বাতাস আরও গন্ধভারাতুর। গন্ধরাজ কি? নাকি পথের পাশের অজানা এমন কোনো ফুল যার নাম জানা নেই। ঘ্রাণও চেনা চেনা অচেনা। এই ক’মাসে কতবার কত জায়গায় অপারেশনে গিয়েছে সামাদ। প্রতিবার বের হবার সময় জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ভেবেছে। জীবনের যবনিকা যদি আজ হয় তবে আজকের মতো সুদিন আর নেই। শহীদের রক্ত থেকে জন্ম নেবে অজ¯্র মুক্তিসেনা। বিজয়ের দেরি নেই। হয়ত কালই। বিকেলের জন¯্রােত বার বার চোখের তারায় ফিরে ফিরে আসে। বড়পুলের পরে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পায় ওই বেনাপোল বর্ডার। ম্লান গোধুলির আলোয় এই দেশের চিরহাস্যময় প্রাণ¯্রােত মিলিয়ে যাচ্ছে অজানা দেশের রেখায়। একটা ঢেলায় হোঁচট খেলো সামাদ। পায়ে প্রচ- ব্যথা। একটু সময়ের জন্য ঝুঁকে ব্যথাস্থানটা ডলে দিয়ে হাঁটছে আবার।
বাড়ির পাশে এসে থামলো। লোক পাঠিয়ে জেনে নিয়েছে কোন্ ঘরে ঘুমিয়েছে সালাম। মা-বাবা দু’জনই বলেছে মাঝের ঘরে শোবে ও। কাছে অস্ত্র নেই। মুখের গামছা টেনে কয়েকজন গুটিপায়ে এগোল। নীরব চারপাশ। বাড়ির পেছনে, কলার পাতায় দু’ফোঁটা শিশির শব্দ তুললো শুধু। মাঝের ঘরের পেছনের জানালা খোলা। একজন আলতো করে চোখ রাখলো। কলাপাতা পিছলে একটুকরো আলো পড়েছে সালামের গায়ের ওপর। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। একটা বন্দুকের নল উঁচু হলো। সামাদ ইশারায় মানা ক’রে, আঙুল দিয়ে বাতাসে অর্ধবৃত্ত এঁেক দরজা দেখিয়ে দিলো।
প্রথমজনের লাথিতে দড়াম করে শব্দ হলো। দ্বিতীয়জন একটু দূর থেকে দৌঁড়ে এসে ঘাড় কাত করে ধাক্কা দিতেই হা হয়ে গেলো দরোজা। সালাম তড়াক করে উঠে ঘুমচোখে ঘুরতে লাগলো। প্রচ- ঘুসিতে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। ধরে ফেলে বাইরে টেনে আনলো ওরা। ভয়ে স্বর বের হচ্ছে না সালামের। আর্ত ক্ষীণস্বরে বলছে,
তুমরা কারা। ভাই, ভাই তুমরা কারা। আমারে মাইরে না। সামাদ কনে? সামাদ কনে?
শেষ শব্দ উচ্চারণের পরই ব্যথায় ককিয়ে উঠলো সালাম। একজন বুকে নল ঠেকিয়ে গুলি করলো। অন্যজন ধরে শুইয়ে দিলো মাটিতে। নিথর হয়ে গেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সামাদ। চাঁদটা একেবারে টর্চের মতো আলো ফেলে আছে মৃতদেহের ওপর। উঠোনে লাল আলোর নদী, বয়ে চলেছে বাওড়ের দিকে।
ম্যাসচুসেটস।