চাঁদ কি কোনদিন হবে রুটি?

আব্দুল কাইউম আনোয়ার :

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
কবিতা তোমায় আজি দিলেম ছুটি,
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

বাংলাভাষী ক্ষণকালীন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্ষুধাক্রান্ত বাঙালির ক্ষুধার রাজ্যে পরিভ্রমণ করেছিলেন। আত্মস্থ করেছিলেন ক্ষুধার মাহাত্ম্যকে। তাইতো পেটের ক্ষুধা কবির চোখের দৃষ্টিকে নিয়ে গেছে সীমাহীন দিগন্তে। তারাময় রাতের অনন্ত আকাশে চাঁদকে কেড়ে নিয়ে তৃপ্তি মেটাবার বাসনায়, কবিতার পঙক্তিমালা পরিয়ে দিতে পাঠককূলের গলে।

মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ক্ষুধা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ইতিহাস বলে আদম-হাওয়াকে নিষিদ্ধ গন্ধম খেতে আল্লাহ নিষেধ করেছিলেন, তবুও তারা খেয়েছিলো! কারণ কি শুধু মজাদার খাদ্যের লোভে, নাকি ক্ষুধাও ছিল পেটে? আমরা যেহেতু আদম-হাওয়ার বংশধর, আমাদের মধ্যে সেই গন্ধম জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার নেশায় মত্ত করে রাখে। তাইতো ক্ষিধে পেলে হাতের নাগালে ভোজ্য দ্রব্য যা পাই, তা ভক্ষণ করি। আর যখন নাগালের ভেতরে কিছুই পাই না, ক্ষিধের জ্বালায় হণ্যে হয়ে উঠি। তখন সেই পূর্ণিমার চাঁদকে কল্পনার মধু মাখিয়ে রুটির মতো খেতে চাই।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বে যে বিশ্বযুদ্ধটি প্রকটভাবে বিরাজমান, সেটি হলো- ক্ষুধা যুদ্ধ। পেটের ক্ষুধার বলী হচ্ছে হাজার-কোটি মানব প্রাণ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা দিনের ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে একবেলাও খাবার মুখে তুলতে পারছে না। এমন কি শিশু সন্তানেরা যেখানে মায়ের বুকের দুধে নির্ভরশীল, সেই শিশুরা অভুক্ত মায়ের বুকের দুধের অপর্যাপ্ততার কারণে মায়ের কোলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে ইয়েমেন, ইথিয়পিয়ায় শত-কোটি মানবকূলকে যে যুগান্তকারী আকাল কাবু করে আছে, সেই অসহায় প্রাণের ত্রাণের সংস্থান করতে বিশ্বের উন্নত দেশ ও জাতিগোষ্ঠী কতটুকু কি করছে? ধরা যাক, বিশ্বের মোড়ল এই যুক্তরাষ্ট্র, সেকি ঐসব নিঃস্ব অসহায় মানব গোষ্ঠীর চরম বিপদের মুহূর্তে যথেষ্ট সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে? না, তা আমরা দেখতে পাই না। কারণ কি? কারণ একটিই, তা হচ্ছে সেইসব অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কোন স্বার্থ জড়িত নেই। সুতরাং, ওই নিপীড়িত জনগণের সহায় হবে না যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্র ন্যাটো দেশসমূহ। বিশ্বেও ফুড প্রোগ্রামের প্রধান ডেভিড বিসলে তাঁর সাম্প্রতিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেনÑ ঠিক এ মুহূর্তে বিশ্বে ৩৪৯ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন-রাত্রি অতিবাহিত করছে।

দুই. পক্ষান্তরে আমরা যদি ইউক্রেনের দিকে তাকাই, দেখি মাত্র তিন মাসের যুদ্ধাক্রান্ত দেশে ন্যাটো দেশসমূহ ছাড়াই কেবল যুক্তরাষ্ট্রই সাড়ে সতেরো বিলিয়ন ডলার সাহায্য পাঠিয়েছে। এই সাহায্যের অর্ধেকও যদি ঐসব তৃতীয় বিশ্বের অভুক্ত মানুষের অসহায়ত্ব দূরীকরণে ব্যয় করা হতো, তবে কয়েক শত কোটি মানব প্রাণ ক্ষুধার তাড়না মুক্ত হতো। ইউক্রেনকে রাশিয়ার ক্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করাকে যুক্তরাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব মনে করার কারণ একটিই, ইউরোপীয় কোন অঞ্চলেই রাশিয়া যেনো আস্তানা গাড়তে না পারে।

এক সময় বিশ্বে দুই পরাশক্তি ছিল, এখন একটি। একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র চায়, সেই একমাত্র মোড়ল থাকবে, অন্য কেউ নয়। আর সেই কারণেই ইউক্রেন যাতে পরাজিত না হয়, সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নগদ ডলারই নয়, আধুনিক যুদ্ধ সামগ্রীও সরবরাহ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বার্থ বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ অনেক মৌলিক চাহিদাকেও অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

প্রসঙ্গত বলি, প্রখ্যাত সাংবাদিক মেলিন্দা লুস্কম্ভে বিশ্ব প্রোগ্রামের প্রধান ডেভিড বিস্লেকে যখন ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন, তখন তিনি উত্তর দেন ‘I am very upset with world leaders. They are all running around playing Whack-a-Mole and not solving serious problems in the world.’ wZwb Av‡iv e‡jb, slow down, solve Yemen, solve Ethiopia, solve Ukrain- just solve one of them.’

এদিকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন সফরে গেছেন। সিএনএন ভোরের সংবাদে এটি প্রচার করেছে। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস থেকে মোটরযানে কিয়েভ পৌঁছান। সেই কিয়েভে হাজারো জনতার সামনে বক্তব্য দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন মঞ্চে ওঠেন, তাঁর মুখের বেদবাণী শোনার জন্যে উন্মুখ হয়ে সবাই তাকিয়েছিল তার মুখের দিকে এবং কান ভরে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তা। বক্তৃতার এক পর্যায়ে

সেই শুভক্ষণ এলো, প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো- ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার এই অন্যায় আক্রমণকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরো ৫০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করলাম। এই ঘোষণার পর হাজারো জনতা মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানালো। আর এই সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও অনেককে খুশি করেছে। প্রেসিডেন্টের বড় সমালোচক দক্ষিণ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামকেও স্বস্তি দিয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টের এই সফরকে যথাসময়ে যথার্থ বলে প্রশংসা করেছেন। তিন. উপসংহারে বলবো, উন্নত বিশ্বে যেসব দেশসমূহ অর্থে-বিত্তে প্রাচুর্য ধরে রেখেছে, তারা তাদের শৌর্য-বীর্য প্রকাশ করবে ঠিকই, কিন্তু মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে সেসব নিতান্ত অসহায় অভাবগ্রস্থ মানবকূলকে তাদের সাদামাঠা জীবন ধারণের যে প্রধান উপাদান. দু’বেলা অন্ন সংস্থানের বন্দোবস্ত করতে উদ্যোগী হবে। এতে বিশ্ব মানবতা রক্ষা পাবে এবং উন্নত দেশ ও জাতিসমূহ নিজেদের অস্তিত্ব আরো সুদৃঢ় করতে পারবে। আর তখনই কেবল সুকান্তের মানবকূল আকাশের সেই রুটিকে হাতের নাগালে পাবে।

লেখক : কলামিস্ট।