চালুর অপেক্ষায় সিলেটের নতুন কারাগার

সিলেট : ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সিলেট-১ আসনের প্রার্থী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, নগরীর ধোপাদীঘির পাড় থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে সেখানে উন্মুক্ত উদ্যান গড়ে তুলবেন। উন্মুক্ত উদ্যানহীন নগরবাসী বর্তমান অর্থমন্ত্রীর এমন প্রতিশ্রুতিকে সানন্দে স্বাগত জানায়। এরপর ২০১০ সালে নগরীর উপকণ্ঠে বাদাঘাটে শুরু হয় নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণকাজের প্রক্রিয়া। তবে কয়েক দফা মেয়াদ বৃদ্ধির পরও এখনো নতুন এ কারাগার চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে পুরনো কারাগারে আদৌ উন্মুক্ত উদ্যান নির্মাণ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট কারাগার পরিদর্শন শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, চলতি সেপ্টেম্বরেই পুরনো কারাগার থেকে নতুন কারাগারে বন্দি স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন কারাগারের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে হলেও এটি চালুর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমুখী-বাদাঘাট সড়ক। সড়কটির ভগ্নদশার কারণেই মূলত নতুন কারাগারের উদ্বোধন আটকে আছে। সড়কটির সংস্কারকাজ শুরু হলেও সেপ্টেম্বরে বন্দী স্থানান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে ডিসেম্বরের আগে সড়কের সংস্কার শেষ হবে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
১৭৮৯ সালে সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থল ধোপাদীঘির পাড়ে ২৪ দশমিক ৬৭ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় সিলেট জেলা কারাগার। ১৯৯৭ সালে এটি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে রূপান্তর হয়। আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো এ কারাগার নগরীর কেন্দ্রস্থল থেকে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে একনেকে ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ ও স্থানান্তর প্রকল্প অনুমোদন পায়। ২০১১ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন জালালাবাদ থানার বাদাঘাটে নতুন কারাগার নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এক বছর পর ২০১২ সালে শুরু হয় নির্মাণকাজ।
প্রাথমিকভাবে এ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে। তবে দুই ধাপে সময় বৃদ্ধি পেয়ে এ সময় নির্ধারিত হয় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। গণপূর্ত অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাদাঘাটে চেঙ্গেরখাল নদীর তীরে আধুনিক এ কারাগার নির্মাণে সর্বশেষ বরাদ্দ ছিল প্রায় ২২৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে প্রায় ২২০ কোটি টাকার কাজ শেষ হয়েছে। উদ্বৃত্ত প্রায় ১১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ।
সূত্রমতে, সিলেটের নতুন এ কেন্দ্রীয় কারাগার গড়ে উঠেছে ৩০ একর জায়গাজুড়ে। এর মধ্যে মূল কারাগারের ভেতরে রয়েছে ১৪ একর ও বাইরে ১৬ একর জায়গা। পুরো কম্পাউন্ডজুড়ে থাকছে মোট ৬৪টি ভবন। কারাগারের বন্দী ধারণক্ষমতা দুই হাজারজন। নবনির্মিত কারাগারে হাসপাতাল থাকছে পাঁচটি। আরো রয়েছে ডে কেয়ার সেন্টার, মসজিদ, স্কুল ও লাইব্রেরি। এছাড়া কারাগারে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে।
নতুন এ কারাগারে বন্দী স্থানান্তর ও পুরনো কারাগারে উন্মুক্ত উদ্যান নির্মাণ নিয়ে কথা হয় সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদ ইসলাম শাহীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকলেও আজো কারাগার স্থানান্তর করতে পারেননি। সম্ভব হয়নি তার প্রতিশ্রুত পুরনো কারাগারের স্থলে উন্মুক্ত উদ্যান নির্মাণও। আগামীতে তিনি আর দায়িত্বে না থাকলে এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ এরই মধ্যে স্থানান্তরের পর পুরনো কারাগারের জায়গা দখলে অনেকেই চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। ফলে পরবর্তীতে এ জমি ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
কথা হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা সিলেট নগরে কোনো উন্মুক্ত স্থান নেই। নেই কোনো উদ্যান। তাই অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুরনো কারাগারের স্থলে দ্রুত উন্মুক্ত উদ্যান নির্মাণের জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।
নতুন কারাগারের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার বিষয়ে সিলেট গণপূর্ত উপবিভাগ-১-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার বলেন, গত জুনে কাজ শেষ হওয়ার পর জুলাইয়ে কারা অধিদপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে। এর আগেও কারাগারের প্রতিটি স্থাপনা শেষ করার পর আমরা কারা কর্তৃপক্ষকে আলাদাভাবে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। তারা যখনই বলবেন, তখনই আমরা স্থাপনাগুলো তাদের বুঝিয়ে দেব।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল জানান, গণপূর্ত থেকে আলাদা আলাদা মোট ৪১টি স্থাপনার কাজ শেষ হওয়ার চিঠি দেয়া হয়েছে। এগুলো সমন্বিতভাবে গত ৩০ আগস্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা যেকোনো মুহূর্তে নতুন কারাগারের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। তবে তেমুখী-বাদাঘাট সড়কের বেহালের কারণে কিছুটা চিন্তিত। কারণ শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এ পথ দিয়ে বন্দিদের আনা-নেয়া খুবই বিপজ্জনক। তাই দ্রুত এ রাস্তার সংস্কার শেষ করার জন্য বলা হয়েছে। সড়ক সংস্কারের পর বন্দী স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু করলে ভালো হবে।
তেমুখী-বাদাঘাট সড়ক সংস্কার প্রসঙ্গে এলজিইডি সিলেট কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী সরকার মো. সাজ্জাদ কবির জানান, গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে সড়কটির জরুরি সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। আগামী নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের শুরুর দিকে এ কাজ শেষ হবে।
এদিকে পুরনো কারাগারের জমিতে উদ্যান নির্মাণ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক নুমেরী জামান বলেন, এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি। বন্দী স্থানান্তরের পর এ জমির বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হবে।