চা

জাভেদ তালহা :

চায়ের প্রতি অনেক মানুষেরই দুর্বলতা আছে। তাই শত বছর ধরেই বিভিন্ন নাটক, প্রবন্ধ ও উপন্যাসে উঠে এসেছে চা, চা-বাগান আর চা-শ্রমিকদের প্রতি একধরনের অনুরাগ, ভালোবাসা। লেখক আর পাঠক দুজনের কাছেই তা সমাদৃত। আর এসবের মধ্যে ভিলেনের ভূমিকায় দেখা যায় সেই ইংরেজ সাহেব, তাদের মালিক ব্রিটিশ কোম্পানি আর অধুনা তাদেরই উত্তরসূরিদের। অথচ এই ভিলেনরাই জন্ম দিয়েছে এই জগৎটাকে। শত বছরের পুরোনো গল্প যখন উঠে এল, তাই শ্রদ্ধা সেই ব্রিটিশ প্লান্টারদের, যাদের জন্য আজ আমাদের চা-শিল্পের জন্ম।

১৯৭১ পরবর্তী সময়ে পাট, চামড়া ও অন্যান্য শিল্প যখন অবধারিতভাবে নিম্নমুখী, তখন গুটি কয়েক বাঙালি প্লান্টার এবং তখন পর্যন্ত এদেশে থেকে যাওয়া ব্রিটিশ প্লান্টারদের হাতে চা-শিল্প শুধু স্থিতিশীলই থাকেনি, উন্নতির পথেও এগিয়ে চলে। ১৯৭২ সালে চা-শিল্পের জন্য নেওয়া সরকারের ইতিবাচক মনোভাবই ছিল এর মূল চালিকাশক্তি। সেই থেকে এ পর্যন্ত চায়ের উন্নয়নে এদেশীয় বিনিয়োগকারীদের সকল অর্জন একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে আজ মহাসংকটে। বৈশ্বিক নানা কারণে সরকার যখন দেশের সামগ্রিক সংকট নিরসনে ব্যস্ত, তখন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের লাগাতার আন্দোলনের নামে নতুন করে সংকট সৃষ্টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

গত ১৩ আগস্ট থেকে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবিতে টানা নয় দিন ধরে বিক্ষোভ করে আসছিলেন চা-শ্রমিকেরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। পরে শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় বৈঠক হয়। বৈঠকে মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করা হলেও আন্দোলন চালিয়ে যান তারা। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের আশ্বাসে তারা কাজে ফিরলেন।

৫০ বছর ধরে চলমান নিয়মে এ বছরও শ্রমিক ইউনিয়ন আর মালিকপক্ষের সংগঠনের আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে কাজ বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে? এতে ক্ষতি কি শুধু মালিকপক্ষেরই হয়েছে? এই ভরা মৌসুমে শ্রমিকদের আয় সর্বাধিক হয়ে থাকে। চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্টেকহোল্ডারদের নির্ভরশীলতা। বাইরে থেকে যারা বাহবা দিচ্ছে, তারাও সেই হিসাবটা ঠিকই জানে, কিন্তু তা তাদের বিবেচ্য নয়।

দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি করা হলেও একজন শ্রমিক বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪০০ টাকার সমপরিমাণ সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রত্যক্ষ সুবিধার মধ্যে দৈনিক নগদ মজুরি ছাড়াও ওভারটাইম, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ছুটি ভাতা, অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিলের ওপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট গড়ে দৈনিক মজুরির প্রায় দ্বিগুণ নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভর্তুকির মাধ্যমে দুই টাকা কেজি দরে প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি মাসে প্রতি ৪২.৪৬ কেজি চাল অথবা গম রেশন প্রদান করা হয়। তা ছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রায় ৯৪ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বণ্টন করা হয়েছে।

১৯০ বছরের পুরোনো শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের অন্যান্য যেকোনো শিল্পের তুলনায় অনেক আগে থেকেই প্রতিটি চা-বাগানে শ্রমিক আইন অনুসরণ করা হচ্ছে। শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য নিশ্চিতে ১৬ সপ্তাহের মজুরিসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের বসতবাড়ির জন্য পরিবারপ্রতি বাড়িসহ সর্বমোট ৫ হাজার ৮০০ বিঘা জায়গা প্রদান করা হয়েছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুটি বড় আকারের ও ৮৪টি বাগানের হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫টি ডিসপেনসারিসহ সর্বমোট ৮৯১ জন মেডিকেল স্টাফ নিয়োজিত আছেন। ৭৬৮টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ১ হাজার ২৩২ জন শিক্ষক দ্বারা বর্তমানে ৪৪ হাজার ১৭১ জন শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের ভাতা, বিভিন্ন রকম শ্রমিক কল্যাণ সূচি, যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানি, ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, পূজা, বিনোদন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬৮টি বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের বাগান কাজ করছে, যেখানে ১.৫ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। উপরন্তু, বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি চায়ের বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ।

আন্দোলনের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামের ১৬৮টি চা-বাগানে দৈনিক ২০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সাল থেকে ১০ বছরে চায়ের নিলাম মূল্যের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ১৬ হারে বৃদ্ধি পেলেও চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয় ৯৪.২০ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এই অচলাবস্থার পুরোপুরি অবসান হোকÑএটাই কাম্য।
আরও এক কাপ চা বেশি পান করুন, বিকশিত হোক আমাদের চা।

লেখক : প্রাক্তন টি-প্লান্টার।