মোহাম্মদ সোহরাব আলী :
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় আমরা পড়েছি, রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/ রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,/ রানার চলেছে, রানার! কই গেল সেই চিঠির যুগ!
আগে চিঠি ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। প্রচলন ছিল বেশি। সেই চিঠি এখন পৌঁছে গেছে জাদুঘরে! চিঠির বক্সে এখন ঘাস গজাচ্ছে, ইঁদুর বাস করছে। আবার কিছু কিছু বক্স যত্নের অভাবে মরীচিকা পড়ে গেছে, ভেঙে ঝুলছে। চিঠি পোস্ট করার জন্য যে অফিসে লোকজন লাইনে দাঁড়ানো থাকত, সে অফিস জনশূন্য। মোবাইল আসার পর থেকে চিঠির প্রচলন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। মোবাইল এখন ফ্যাশন হয়ে গেছে। প্রায় সবার হাতে মোবাইল দেখা যায়। স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা মোবাইল ব্যবহার করে। এ যুগে আর প্রেমিক-প্রেমিকা চিঠির মাধ্যমে কোনো যোগাযোগ করে না। একে অপরের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে, মেসেজ পাঠায়, ভিডিও কল দিয়ে একে অপরকে দেখে আর মনের সব কথা বলে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মান-অভিমান, ভালোবাসা কত কী যে ঘটে!
চিঠি এখন আর কেউ তেমন ব্যবহার করে না। অনেকটা মৃত্যু ঘটেছে। আগে এক দেড় মাস পরে একটা করে চিঠি পাঠাত, সেই চিঠি পড়ে খবরাখবর জানা যেত। ডাকপিয়ন হাটে-ঘাটে, বাজারে ও বাড়িতে গিয়ে চিঠি বিলি করে আসত। চিঠি পাঠানোর জন্য কেউ কেউ পোস্ট অফিসে গিয়ে অথবা ডাকপিয়নের কাছ থেকে খাম কিনত। চিঠি লেখে খামে ভরে পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট করত অথবা ডাকপিয়নের কাছে দিত।
ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে বাইরে থাকলে পিতামাতা বলত, বাবারে মাঝে মাঝে চিঠি লেখে জানাবি, কেমন আছিস। আবার ছেলেমেয়েদের টাকাপয়সার দরকার হলে বাবার কাছে চিঠি লিখত। বাবা-মা পড়ালেখা না জানলে ছেলে চিঠি দিলে কারও কাছে চিঠিটা নিয়ে যেত অথবা কারও বাড়ি ডেকে নিয়ে আসত চিঠি পড়ে শোনানোর জন্য। পড়ালেখা না জানার জন্য তারা অন্যকে দিয়ে চিঠি লেখাত। পরে পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট করে দিত। আগে কম-বেশি প্রায় বাড়িতে চিঠি পাওয়া যেত। কেউ আবার সব চিঠি এক জায়গায় জমা করে রাখত। সেই চিঠি এখন চলে গেছে মিউজিয়ামে! অনেক খোঁজাখুঁজি করেও একটা চিঠির সন্ধান মেলে না। ডাকপিয়ন আর আগের মতো চিঠি বিলি করতে বাড়ি বাড়ি আসে না। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ আধুনিক যুগে একেবারেই কমে গেছে।
মনে পড়ে, কত চিঠি রাত জেগে লিখেছি। কত গোপনে গোপনে রাতে পড়েছি। প্রেমের প্রথম চিঠি যখন প্রিয়তমার কাছ থেকে পেয়েছিলাম, সেই চিঠি যে কতবার পড়েছিলাম! আমিও প্রিয়তমাকে লিখেছিলাম। এখন কেউ আর প্রেমের চিঠি লেখে না। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া দখলে নিয়ে গেছে। মেয়ে সেজে ছেলে প্রেম করে এবং ছেলে সেজে মেয়ে প্রেম করে। মুখে মেকআপ দিয়ে সুন্দর হয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ সেই চেহারা দেখে পাগল হয়ে যায়। কেউ করতে যায় বিয়ে। আসল রূপ যখন দেখতে পায়, বিয়ে না করে ফিরে আসে। আগে হাতের লেখা চিঠিতে প্রেম হতো-এখন প্রেম হয় মোবাইলে। প্রেম ভাঙেও এই মোবাইলে।
আগে প্রিয়তমার চিঠির অপেক্ষায় কত দিন গুনেছি, কবে পাব তার হাতের লেখা চিঠি। এক সপ্তাহ অথবা দুই সপ্তাহের মধ্যে চিঠি না পেলে বুকের মধ্যে ধড়ফড় শুরু হয়ে যেত। মাথা ঘুরপাক খেত আর মনের মধ্যে চিন্তার জাল তৈরি হতো। চিঠি পেতে যত দেরি হতো, দুশ্চিন্তা ততই বেড়ে যেত। ডাকপিয়নের কাছে খোঁজ নিতাম পোস্ট অফিসে গিয়ে। অধিক আগ্রহে থাকার পর যখন প্রিয়তমার চিঠি হাতে পেতাম, মনে হতো কী অমূল্য রতন পেলাম। মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। একাগ্রচিত্তে চিঠির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কী সুন্দর নতুন খাম! কড়কড় করছে। চিঠির একটা গন্ধও নাকে আসত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠিটা খুলে পড়েছি ছাদের উপরে গিয়ে একা নিরালয়ে বসে। একবার পড়া শেষ হয়ে গেলে আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করেছি। কী সুন্দর চিঠির ভাষা! কত সুন্দর হাতের লেখা, কিছু ভালোবাসা, অভিমান চিঠিতে থাকত ভরা। কিছু আদেশ, কিছু উপদেশ। সুন্দর সুন্দর ডায়ালগ।
প্রিয়তমার চিঠির উত্তর দিতাম অনেক ভেবেচিন্তে। সে কী বলছে চিঠির প্রতিটা লাইন বাই লাইন পড়তাম। কীভাবে শুরু করব, কী লিখলে সে খুশি হবে, কিছু রোমান্টিক ভাষায়, বলপেন কলম দিয়ে সুন্দর কাগজে রাত জেগে জেগে একা একা বসে লিখতাম। ভালো না হলে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে লিখতাম। একটা চিঠির উত্তর দিতে অনেক সময় লেগে যেত। চিঠিটা লেখা হলে পুরোটা পড়তাম। যদি মনে হতো কোথায় আরও কিছু সংযোজন করলে ভালো হবে, তাহলে আবার লেখা শুরু করতাম। একাধিকবার একটা চিঠি লেখতে একটুও বিরক্তবোধ করতাম না। সুন্দর করে লেখা হলে চিঠিটা খামের ভেতর ভরে প্রিয়তমার ঠিকানায় পোস্ট করে দিতাম। চিঠির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতাম। চিঠি পেতে দেরি হলে আরেকটা চিঠি লিখতাম।