চোখ

কামরুল হোসেন লিটু :

প্রাণ থাকলে প্রাণী। চোখ-মুখ, হাত-পা, নাক-কান-এসব অঙ্গ না থাকলেও প্রাণী হওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো মুখ না থাকা। মুখ না থাকলে খাওয়ার প্রয়োজন নেই আর না খেলে মলত্যাগের ব্যাপারটাই থাকল না। বোবার শত্রু নাইÑএ বাস্তবতা আমরা কে না জানি!

বাঘও খায় মানুষও খায়। বাঘ মাংসাশী (Carnivorous)। তাই তারা শুধু মাংসজাতীয় খাদ্য খায় এবং পেট ভরে গেলে আর খায় না। মানুষ সব খায়, মাছ-মাংস, হাড্ডি-কাঁটা, শাক-সবজি, দুধ-মুত, মদ-ঘুষ। লক্ষণীয় বিষয়, মানুষের পেট ভরলেও খাওয়া বন্ধ হয় না।

প্রাণীর জন্য চোখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছের যদি চোখ থাকত, তাহলে যখন-তখন গাছ বা তার ডাল আমরা কাটতে পারতাম না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের এ এক অনন্য ও অসাধারণ সৃষ্টি। যারা জন্মান্ধ, তাদের মানসপটে গোলাপি আর সবুজ রঙের কোনো উপলব্ধি ফুটে ওঠা কি সম্ভব? হাতি বা তিমি সম্পর্কে তাকে কীভাবে বর্ণনা করা যাবে? শুয়ো পোকা রূপান্তরিত হয়ে প্রজাপতি হওয়া এবং প্রজাপতির যে বহু বর্ণিল রং-বেরঙের ডানা আছে সেটা বোঝা, উপলব্ধি করা একমাত্র চোখের মাধ্যমেই সম্ভব।

চোখ দেখে মনোভাব বোঝা যায়। জনপ্রিয় একটা গান আছে, চোখ যে মনের কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ চোখ নিয়ে লিখেছেন, চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। আর নজরুলের লেখা, চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে চোখ গেল পাখিরে, তোর চোখে কাহারও চোখ পড়েছে নাকিরে…। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় চোখ নিয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা গান গেয়েছেন, মনে আগুন জ্বলে চোখে কেন জ্বলে না? চোখেতে সাগর আছে আগুন যে সই ধরে না। এই গানটা আমার মামা-চাচাদের কিশোর বয়সের, এখনো অনেক শ্রোতাপ্রিয়। ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে? মান্না দে’র এই গান বাংলাভাষী কে না জানে!

চোখ নিয়ে এন্ড্রু কিশোরের দুটো খুবই জনপ্রিয় গান আমার কৈশোরে রেডিও-টিভিতে বহুল প্রচারিত হতো। ১. চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি, পথের দেখায় আমি পথে নেমেছি, ২. চোখ বুজিলে দুনিয়া আন্ধার, হায়রে চোখ বুজিলে দুনিয়া আন্ধার, কিসের বাড়ি কিসের ঘর কিসের সংসার? আব্দুল হাদী গেয়েছেনÑচোখের নজর এমনি কইরা একদিন ক্ষইয়া যাবে, জোয়ার-ভাটায় পইড়া দুই চোখ নদী হইয়া যাবে। আমজাদ হোসেনের গোলাপী ট্রেনে গেয়েছিল, হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ। এ গানের মাঝের অংশেÑআমি ফুল কদম ডালে ফুটেছি বর্ষাকালে, সারাটা জীবন গেল চোখেরই জলে। এই কথা দুনিয়ার সব গরিব মানুষের।

চোখের দৃষ্টির শিকারে পরিণত হয় আরেকটা ভালো লাগা চোখ। তেমনি এই দুটো গান : ১. চোখে চোখ রেখো না ভয়ে কাঁপে হৃদয়, ভালোবেসে সজনী মরে যেতে স্বাদ হয়, ২. ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই, তুমি হলে মনের রানি। পৃথিবীর সকল ভালোবাসা-ভালোলাগার প্রধান মাধ্যমই চোখ। চোখের ভালোলাগার ভাষা পড়েই দুনিয়ার সবাই ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়েছে, এটা প্রায় নিশ্চিত।

মানুষের আবেগীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে হাসি-কান্না। মানুষের মনও কাঁদে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লেই কান্না দৃশ্যমান হয়। কারা বেশি কাঁদেÑনারী নাকি পুরুষ? ইংল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম শে বলেন, নারীরা গড়ে মাসে পাঁচবারের বেশি কাঁদে আর পুরুষেরা গড়ে দুবারও কাঁদে না। মেয়েরা গড়ে ৫ থেকে ৬ মিনিট ধরে কাঁদে, ছেলেরা এ ক্ষেত্রে কাঁদে দুই বা তিন মিনিট। নেদারল্যান্ডসের টিলবার্গ ইউনিভার্সিটির গবেষক এড ফিঙ্গার ওয়েট তার একাধিক গবেষণায় দেখিয়েছেন, জন্মের পর ছেলেমেয়ে সব ধরনের শিশু সমান পরিমাণে কাঁদে। তবে ছেলেশিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠলে তাদের কান্নার পরিমাণ কমে যায়। গবেষকেরা বলছেন, এতে সামাজিকীকরণের একটা প্রভাব রয়েছে। সাধারণত যেসব দেশে কান্নাকে যত সহজভাবে গ্রহণ করা হয়, সেসব দেশে মানুষ কাঁদে বেশি। এই ব্যাপারটা কোনো সমাজ এবং পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরন নামে হরমোনের মাত্রা বেশি থাকে বলে তারা কাঁদেও কম।

মানুষের মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম সুখ-দুঃখের আবেগীয় অনুভূতির প্রভাবে অশ্রু উৎপাদনকারী ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত পানিই কান্না বা অশ্রুজল। লন্ডনের চিকিৎসক ড. নিক নাইট, যিনি হিউম্যান পারফরম্যান্সের গবেষক। তার মতে, তিন ধরনের অশ্রু হয়ে থাকে : ১. বেসাল টিয়ারÑএই অশ্রু সব সময়ই চোখে থাকে। এর কাজ চোখকে ভেজা রাখা। ২. রিফ্লেকস টিয়ারস বা কোনো কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে অশ্রু উৎপন্ন হয়। যেমন পেঁয়াজ কাটার সময় আমাদের চোখে যে পানি আসে, সেটা রিফ্লেকস টিয়ার। ৩. সাইকিক টিয়ার বা আবেগীয় অশ্রু, দুঃখ-কষ্ট-আনন্দে এই অশ্রু উৎপাদিত হয়।

কান্না দেহের প্যারা-সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে সক্রিয় করে। এটা হার্টরেট কমিয়ে শরীরকে শান্ত করে, বিশ্রাম নিতে সহায়তা করে। আর এ কারণেই আরামবোধ হয়। ব্রিটিশ চিকিৎসক ড. নিক নাইট বলেছেন, সাইকিক টিয়ারে বা আবেগীয় অশ্রুতে ‘লুসিন এনকোফালে’ নামক একধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। একে প্রাকৃতিক ব্যথানাশক বা ন্যাচারাল পেইন কিলারও বলা হয়। যার কারণে কান্নার পর মানুষ ভালো অনুভব করে। সে জন্য কান্না এলে অঝোরে কেঁদে ফেলুন।

-লম্বার্ড স্ট্রিট, বাফেলো।