জনগণের নিস্পৃহতায় বেকায়দায় বিএনপি

মোস্তফা ফিরোজ

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবার সত্যি সত্যি একটা জটিল সমীকরণের দিকে যাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে এটা স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে। খালেদা জিয়ার কারাবাস এটা দীর্ঘায়িত হবে, এটি শুধু আইনগত প্রক্রিয়া না, এটা একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আইনগত প্রক্রিয়া যদি সত্যি সত্যি অনুসরণ করা হতো তাহলে খালেদা জিয়ার যে দ- বা মামলা, এটা এত দীর্ঘায়িত হওয়ার কথা নয়। অনেক আইন বিশেষজ্ঞই একমত যে এ ধরনের দ-িত ব্যক্তির জামিন খুবই সহজ ব্যাপার। এর জন্য হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্ট এত আদালত থেকে আদালত ঘোরা এটা নিয়ে যে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া, সেটি কোনোভাবেই হওয়ার কথা নয়। যেটি খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত করার পেছনে শুধু আইনগত না, একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। কী সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ বা প্রধান কারণ বা একমাত্র কারণই হচ্ছে আগামী নির্বাচন। যে নির্বাচন পাঁচ বছর পরে হওয়ার কথা। এ সরকারের ৫ বছর মেয়াদটি পূর্ণ হওয়ার পর।
আরেক দফায় ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের জন্য যে নির্বাচন হবে, সেটি হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সাংঘাতিকভাবে উদগ্রীব যে তারা আরেকবার ক্ষমতায় আসতে চায়। সে আসার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে বিএনপি। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল। যদিও তারা বর্তমানে সংসদে নেই। সংসদে না থাকার পরও তাদের যে জনপ্রিয়তা পাবলিক পারসেপশন সবকিছু মিলিয়ে সরকার জানে যে যদি একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে কোনোভাবে ক্ষমতাসীনরা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। যেহেতু ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। সেই কারণেই আইনি প্রক্রিয়াগুলো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আইনগতভাবে বিষয়টি এমন একটি পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে বিএনপি সম্পূর্ণ কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে।
শুধু খালেদা জিয়া নন, সিনিয়র অনেক নেতার বিরুদ্ধেই মামলা আছে, যেগুলো একের পর এক কার্যকর করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মামলাগুলো সচল হবে। এভাবে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে নির্বাচনি ফায়দা তোলার চেষ্টা করা হবে। সেই ফায়দা তোলার লক্ষ্যের কারণে বিএনপি অনেকটা দিশাহারা দ্বিধাগ্রস্ত। বিএনপি কী করবে তার সামনে এ মুহূর্তে আর তেমন কোনো অপশন নেই। বিএনপির একটি ধারণা ছিল খালেদা জিয়ার কারাদ-ের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে একটি প্রতিবাদমুখর অবস্থার সৃষ্টি হবে। কিন্তু একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষ সেই ডাকে সাড়া দেয়নি। মানসিকভাবে তারা যেন প্রস্তুত যে খালেদা জিয়ার দ- হবে, আর তিনি কারাগারে থাকবেন। এগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একটা ধারণা তৈরি হওয়ার কারণে মানুষ খুব বেশি অবাক হয়েছে যে খালেদা জিয়ার যে কারাদ- হয়েছে তার কারণে যে তারা বিক্ষুব্ধ হবে সে রকম পরিস্থিতি নেই। জনগণের এই নিস্পৃহতার কারণে বিএনপি আরও বেকায়দায় পড়েছে। শুধু কর্মী-সমর্থকদের দিয়ে একটা সরকারের বিরুদ্ধে সত্যিকার কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। আন্দোলন তখনই সফল হয় যখন সে আন্দোলনের জনগণের সম্পৃক্ততা ঘটে। কিন্তু বিএনপির জন্য দুর্ভাগ্য, খালেদা জিয়ার কারাদ-ের প্রতিবাদে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়নি। তারা কৌশলগতভাবে রাস্তায় থাকার জন্য যে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শুরু করেছিল সে কর্মসূচিও কিন্তু কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেননা তা-ও বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির অবস্থান এমন ছিল যে যতই বাধা আসুক তারা কোনোভাবেই কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যাবেন না। কারণ ওইসব কর্মসূচিতে গেলে তাদের শক্তি ক্ষয় হবে। এর জন্য আগামী নির্বাচনে তারা আরও খারাপ অবস্থায় পড়বে। এখন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। মানুষ প্রশংসা করেছে। এই প্রশংসা বা দৃষ্টি কাড়ার মধ্য দিয়ে মানুষের আন্দোলনটা বেগবান হয়েছে, সেই পরিস্থিতিও সরকার তৈরি হতে দেয়নি। দেখা গেছে এ কর্মসূচিতে দফায় দফায় সরকার নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করেছে।
ভীতসন্ত্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন ঘরছাড়া। ইতোমধ্যে ৪-৫ হাজার কারাবন্দি। এই পরিস্থিতির কারণে কীভাবে বিএনপি সংকটটা মোকাবিলা করবে, তা বিবেচ্য বিষয়। দিন যত যেতে থাকবে রাস্তার আন্দোলন বিএনপির কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কাই বেশি। যদি মুখ থুবড়ে পড়ে এবং এ পরিস্থিতি থেকে যদি উত্তরণ ঘটানো না যায় তাহলে দলের ভেতরে একটা সন্দেহ, অবিশ্বাস ও হতাশা তৈরি হবে, যে হতাশার সুযোগ নিয়ে হয়ত কোনো একটা অংশ সরকারের সঙ্গে একটা আপস করতে থাকবে। এ আপসের মধ্য দিয়ে কিছুসংখ্যক নেতা সংসদে আসতে চাইবেন। হয়ত সরকার সেই পরিস্থিতিই তৈরি করতে চাচ্ছে। যে কারণে সরকার বিএনপির যে নিয়মতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ সেটি হতে দিচ্ছে না। এ অবস্থাটা একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির জন্য বড় দুর্ভাগ্যজনক। এ মুহূর্তে একটি হতাশাজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই আমাদের সামনে চলে এসেছে। এভাবে যে সরকার তার প্রশাসনযন্ত্রকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করছে। যেখানে সরকারি দলের দল সঙ্গে নেই, জনগণ সঙ্গে নেই কেবল সরকারের আছে ক্ষমতা। ক্ষমতার কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট তার ব্যবহার করেছে প্রতিপক্ষকে দমনের ক্ষেত্রে। আবার বিপরীত দিক থেকে সরকারের এই দমন-পীড়ন প্রতিহত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও কাঠামো এখন বিএনপির নেই। সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছে পুরো রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে পুরো জাতীয় নির্বাচনই হবে একটি সাজানো নির্বাচন। একটি প্রতিদ্বন্দি¦তাবিহীন একটি নির্বাচন। যে নির্বাচন এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

লেখক : বার্তাপ্রধান, বাংলাভিশন।