জবাবদিহি আদর্শ সমাজের বৈশিষ্ট্য

এস এম মোজাম্মল হক :

আদর্শ সমাজব্যবস্থার জন্য জবাবদিহির বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যে সমাজে জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেটিই উত্তম সমাজ আর ব্যক্তিগত কৈফিয়তের প্রচলন থাকলে সেটি অধিকতর উত্তম। কৈফিয়তের বিষয়টি তৃতীয় বিশ্বের লোকদের নিকট ঊর্ধ্বতন কর্তৃক অধস্তনের ভুল বা অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কারণ, সেখানকার সংস্কৃতি এমনভাবে গড়ে ওঠে যে ধরেই নেওয়া হয়, ভুল সব সময় অধস্তনেরাই করে থাকে এবং তার জবাবদিহি চাওয়া ঊর্ধ্বতনের একচেটিয়া অধিকার এবং এ-ও মনে করা হয়, ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা সব সময় ভুলের ঊর্ধ্বে।

যদিও কালেভদ্রে ঊর্ধ্বতনরা ভুলত্রুটি করলেও তার জন্য জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। এর অন্যতম কারণ, কৈফিয়ত বলতে সাদামাটাভাবে এসব ভূখণ্ডের লোকজন অধস্তন কর্তৃক ঊর্ধ্বতনের নিকট জবাবদিহি করাকেই বুঝে থাকে। দীর্ঘদিন পরাধীনতার কবলে থাকার ফলে মন-মগজে এমন ধারণাই পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে বসে। স্বাধীনতা লাভ করলেও বারবার বিভিন্ন কারণে তার অব্যাহত চর্চা ব্যাহত হওয়ার ফলে এবং বহু ঔপনিবেশিক আইন অদ্যাবধি বহাল থাকার কারণে তা শুধু শাসক ও শাসিত নয়, বরং শোষক ও শোষিত সমাজব্যবস্থার সহায়ক। ফলে ওইসব সমাজব্যবস্থায় সাধারণ লোকেরা সেভাবেই অভ্যস্ত। নিজ থেকে ভুল স্বীকার করে মার্জনা প্রার্থনা করা যে সমাজে বিরল ঘটনা, যদি সেখানে কেউ তেমনটি করে, তবে তাকে উদার না ভেবে বরং অপরাধী ভাবা হয়। অথচ এমন সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়ে সুন্দর সমাজব্যবস্থা কায়েম হতে পারে। কৈফিয়তের বাংলা আভিধানিক অর্থ সমর্থন, সমাধান, ব্যাখ্যা, জবাবদিহি ইত্যাদি হলেও যেখানে শুধু শেষেরটিই গ্রহণ করা হয় এবং তাও অধস্তন কর্তৃক ঊর্ধ্বতনের নিকট। কারণ, সেখানে সাধারণ লোকের মধ্যে এমন ধরণা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে ঊর্ধ্বতনেরা সব সময় দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে। এই মনোভাবের পরিবর্তন ব্যতীত উত্তম ও আদর্শ সমাজ গঠন দুরূহ।

একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য মূল্যবোধের লালন অপরিহার্য আর তা শুরু হয় শৈশবে। যে কারণে শুরুটা পারিবারিক পরিমণ্ডলেই হয়ে থাকে। তবে প্রশ্ন হলো যে পরিবারে মূল্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, সে পরিবারের সন্তানদের আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ খুব কম। তবে তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সঙ্গী-সাথিরা আদর্শবান ও মূল্যবোধসম্পন্ন হলে তাদের সংস্পর্শের কারণে আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়। অবশ্য তা সানন্দচিত্তে মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। ধর্ম মূল্যবোধ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। প্রতিটা ধর্মেরই মূল শিক্ষা সত্য, ন্যায় ও পরমতসহিষ্ণুতা। যে কারণে প্রতিটা ধর্মের যারা প্রকৃত অনুসারী, তারা সাধারণত অধিকতর মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে থাকেন, যদি ধর্মকে হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহারের মানসিকতা না থাকে।

জন্মসূত্রে নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী হলেও এবং ধর্মের আশ্রয়ে থেকে ফায়দা লাভ করা সত্ত্বেও ধর্মের মৌলিক বিধিবিধান সম্বন্ধে সম্যক ধারণা না থাকায় এবং কিছু ধারণা থাকলেও তা জাগতিক স্বার্থের কারণে উপেক্ষা করার বহু নজির লক্ষ করা যায়। এমনকি ধর্মের বহু বৈধ বিষয়ের বিরোধিতা করে নিজেদের নাস্তিক হিসেবে উপস্থাপন করতেও তারা লজ্জিত না হয়ে উৎসাহবোধ করে, যা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ক্ষেত্রে নয় বরং সকল ধর্মেই এরূপ লোকের দেখা মেলে। ধর্মের মৌলিক বিধিবিধানকে মৌলিকত্বের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে দ্বিধা থাকলেও ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান যারা মনেপ্রাণে লালন করেন এবং নিজেদের মানবিক কল্যাণে নিয়োজিত রাখতে সদা তৎপর, তাদের মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের আমল-আকিদার বিরোধিতা করাকে কর্তব্য হিসেবে মনে করা নৈতিক শিক্ষায় দুর্বল ও বাহ্যিক দৃষ্টিতে স্বার্থপরতাই এর অন্যতম কারণ কি না, তা অনেকেরই ভাবনার বিষয়।

উন্নয়ন একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যার বিস্তৃতি ব্যাপক। উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবকাঠামোগত সমৃদ্ধিকেই বোঝায় না, বরং এর তাৎপর্য অনেক। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদিও উন্নয়নকে একটি আপেক্ষিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে সামাজিক পরিমণ্ডলে অনেকেই নিজ নিজ সুবিধামতো উন্নয়নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেভাবেই কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে থাকেন। উন্নয়নের জন্য কর্ম ও পরিকল্পনা অতি মূল্যবান অনুষঙ্গ, যা উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মূল চালিকাশক্তি, যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

মানুষের বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নততর অবস্থায় উন্নীত হওয়ার বাসনা নিরন্তর। তাই উন্নয়নের কোনো নির্ধারিত সীমারেখা নেই, বরং মানুষের যত উন্নতি হয় চাহিদা তত বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তথা অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই উন্নতি ও উন্নয়নের মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে মনে করা ঠিক নয়, এটি উন্নয়নের একটি অংশ মাত্র। ব্যক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক পরিমণ্ডলেও বাহ্যিক উন্নয়নের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু তা হতে হয় যুক্তিসংগত ও প্রতিযোগিতামূলক ন্যূনতম ব্যয়ে মানসম্পন্ন টেকসই নির্মাণকাজ। উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে যার সাথে থাকা দরকার সততা ও মানবিকতার সম্পর্ক। এর ঘাটতি থাকলে সে উন্নয়ন যতই ঝকঝকে-চকচকে হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে সে উন্নয়ন ঠুনকো।

নৈতিক ও মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত বাহ্যিক উন্নয়নই বস্তুত টেকসই উন্নয়ন, যা সব সময় ব্যক্তির পরিবর্তে সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনায় গৃহীত হয়ে থাকে এবং তার প্রাক্কলন তৈরি হয় প্রকৃত চাহিদার ভিত্তিতে এবং প্রকল্পের বাস্তবায়ন সঠিক ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ার ফলে অবকাঠামো হয় মজবুত ও টেকসই। উন্নয়নের প্রভাব ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে হওয়া উচিত ইতিবাচক। তাই সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রকৃত চাহিদার পরিবর্তে ব্যক্তিগত ও পছন্দের লোকদের সুবিধার জন্য যত্রতত্র ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ অযৌক্তিক, যা ভবিষ্যৎ পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য অনেক সময় নির্মিত অবকাঠামো অপসারণের প্রয়োজন হয়। ফলে নির্মাণ ও অপসারণজনিত ব্যয় উভয়ই অপচয় বা ক্ষতির পর্যায়ভুক্ত। অথচ সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মোতাবেক প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে এমন অপচয় থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি, যা আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক।