জলবায়ু সম্মেলন থেকে কী পেল বিশ্ব

নূরুল ইসলাম : নতুন বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তির মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শেষ হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬। সম্মেলন শেষে কিছু বিষয়ে বিশ্বনেতারা ঐকমত্যে পৌঁছালেও তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই কারও মধ্যে। পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মীরা তো বটেই, অনেক দেশের রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, আশা অনুযায়ী অর্জন হয়নি। সম্মেলন শেষে বরাবরের মতোই একটি চুক্তি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট বা সংক্ষেপে গ্লাসগো চুক্তি। কিন্তু এই চুক্তি নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট নয়।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এখন নাকাল বললেও কম বলা হবে। দাবদাহ, খরা, বন্যা, দাবানল, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে ক্রমাগত। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন উদ্বাস্তু হচ্ছে। শুধু ২০২০ সালেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাড়ে ৫ কোটি লোক শরণার্থী হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে। কিন্তু এদিকে যেন কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পৃথিবীর জ্বর ক্রমাগত বাড়ছে। গত দশকটি ছিল বিশ্বের এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা উষ্ণতম দশক। এসব তথ্য নিয়মিত বিরতিতেই সামনে আসছে। কিন্তু তার ফল ঘরে উঠছে না। এবারের সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল বিশ্ব। এতে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। এবারের সম্মেলনে সবচেয়ে বড় যে অগ্রগতি হয়েছে, তা হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্মত হওয়া। এ লক্ষ্য অর্জনে এ দুই দেশ আগামী দশক একযোগে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংস বন্ধ এবং নতুন করে বনায়নের বিষয়ে সম্মত হয়েছেন শতাধিক দেশের নেতারা। এই দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্রাজিল, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর ‘ফুসফুস’খ্যাত আমাজন। এবারের সম্মেলনে কয়লা থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতিপত্রে সই করেছে ৪০টির বেশি দেশ। এর মধ্যে পোল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চিলির মতো দেশগুলোর থাকা যদি আশা জাগায়, তবে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের না থাকাটা নিশ্চয় হতাশাজনক।
সম্মেলনে ২০০টি দেশের প্রতি ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নিঃসরণ হ্রাসের বিষয়টি ২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতেই ছিল। তাহলে কপ ২৬ নতুন কী দিল? একটা পার্থক্য হলো প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশগুলো। এবারের সম্মেলনে এই লক্ষ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য আরও ব্যাপকভাবে নিঃসরণ হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোকে দেওয়া ধনী দেশগুলোর অর্থায়নের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
গ্লাসগো সম্মেলনে বায়ুমণ্ডলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেনের নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমানোকে চিহ্নিত করেছেন অনেক আগেই। ফলে এবারের সম্মেলনে এই গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একজোট হওয়াকে অনেক বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এ সম্পর্কিত ঘোষণায় বিশ্বের মোট মিথেন গ্যাস নিঃসরণের ৩০ শতাংশ ২০৩০ সালের মধ্যে কমিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছে শতাধিক দেশ। এটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই শতাধিক দেশের মধ্যে নেই চীন, ভারত ও রাশিয়া, যারা এই গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় তিন নিঃসরণকারী দেশ।
এবারের সম্মেলনে ক্লিন বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে অর্থায়নে সম্মত হয়েছে ৪৫০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১৩০ লাখ কোটি ডলার। এটি আশার সঙ্গে শঙ্কাও জাগাচ্ছে। কারণ, এর মাধ্যমে পৃথিবীর ভাগ্যটি অন্য অর্থে বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কিনা সাধারণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
সব মিলিয়ে পুরোনো কাসুন্দিই ঘুরেফিরে এল। কপ-২৬ নিয়ে যে হইচই হয়েছিল, তার তুলনায় অর্জন সামান্যই। এই অর্জনগুলোও আবার অনেকগুলো যদি-কিন্তুতে আটকে আছে। হয়তো কিছু তহবিল ছাড় পাওয়া যাবে ধনী দেশগুলো থেকে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এ নিয়ে একটা প্রচার করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন বা নদীগুলো বা মাটি ও হাওয়া যে ভালো থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনার মাঝখানে সেই একই অনিশ্চয়তাতেই থেকে যাচ্ছে পৃথিবী।