জাগরণে ও আরোহণে একুশের ঠিকানা

ফেরদৌস সাজেদীন
আমরা জানি, মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার তার ভাষা। আর ভাষা আবিষ্কৃত না হলে, ব্যক্তি মানস থেকে অন্য আর কিছুই যুগ মানস পর্যন্ত এগুতে পারতো না। না পাওয়া যেতো কোনো দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি। আমরা যেমন আমাদের আদি জানতাম না, তেমনি বর্তমানের স্বরূপ ও ভবিষ্যতের উত্তরাধিকার বর্তমানের দিকে যে চেয়ে আছে, তার কোনো হদিস থাকতো না। মোটকথা, ভাষা একের সঙ্গে অপরের ভাব বিনিময়ের প্রধান, কার্যকর ও বাস্তবসম্মত একমাত্র মাধ্যম। আকার ইঙ্গিতে, ঊহ্য ও উপযোগী ইশারায় মানুষ তার চাওয়া পাওয়ার লেনদেনে সক্ষম হলেও, ভাষাহীনতার অসহায়ত্বে যে দিনে দিনে কেবল-ই জড় হবে, এই-ই তার নিয়তি। ভাষাহীন মানুষের পৃথিবী নীরব-নির্জন-নিঃসঙ্গ ও চৈতন্যহীন হবে, এটা নিশ্চিত করেই আমাদের ভাবনায় স্থির করে নিতে পারি। নিজের প্রাণের মতো মানুষের মুখের ভাষা তার একান্তভাবেই নিজস্ব। নিজস্ব বলেই এক প্রাণের ওপর অন্য প্রাণের শাসন-আগ্রাসন যেমন অনাকাক্সিক্ষত, তেমনি এক ভাষার ওপর অন্য ভাষার শাসনও অনভিপ্রেত।
আর এই অনভিপ্রেত শাসনই করতে চেয়েছিল তদানিন্তন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের আপামর মানুষের মুখের ভাষার ওপর। তাদের এক অহংকারী, চিতানো দম্ভ ও নিষ্ঠুর আচরণ লাগামছাড়া হয়ে উঠেছিল; পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরপরেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ববাংলার মানুষের নিত্যদিনের ব্যক্তিক, সামষ্টিক, গেরস্থালি ও সামাজিক মোটকথা সামগ্রিক অনুসঙ্গে ধীরে ধীরে এমনই সাব্যস্ত করতে উদ্যোগী হয়ে উঠে যে, ডাক বিভাগের পোস্টকার্ড, টাকার নোট ইত্যাদি থেকে বাংলা ভাষা অনুপস্থিত রেখে, পরিবর্তে উর্দু আর ইংরেজিকে স্থান করে দিতে লোভী ও সাহসী হয়ে ওঠে।
বিপ্লবের স্পৃহা ও ডাক কখনই সহসা আসে না। এর একটা প্রস্তুতি থাকে। আমরা জানি, মানুষ ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা বা খড়ার মতো যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, আপাততভাবে তা হঠাৎ করে সব তছনচ করে দিচ্ছে বলে মনে হলেও আসলে এসব তাণ্ডবলীলার প্রেক্ষাপট শুরু হয় আগেই, অন্যকোথাও অদৃশ্যে। ঝড়ে ঘরের চাল বা বৃক্ষ ভূলুণ্ঠিত হলে আমরা তখন টের পাই, বলি, হঠাৎ করে একী প্রলয়! বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাত তেমনি শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি এক দিনের নয়, এই রক্তপাতের ধারার সূত্রপাত ঘটেছিল আরও আগে, এ ঘটনা আমরা সবাই জানি। শুধু বলি, ১৯৪৮-এর মার্চে জিন্নাহ কার্জন হলে এসে যখন বললেন, ‘উর্দু, উর্দু-ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, এই উচ্চারণ তার আকস্মিক কোনো ভাষণের অংশ ছিল না, এই দম্ভ ও অসম্ভব আকাক্সক্ষার বীজ বপিত হয়েছিল অনেক আগেই। আর এইপথেই প্রায় চার বছরের মাথায় পূর্ববাংলার মানুষ তাঁদের সম্ভ্রম ও বাঁচার আঁশটিকে পশ্চিমাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা ও চলিষ্ণু করতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। এসব আমাদের জানা। আর এও জানা যে, একুশের পথেই, এই চলিষ্ণুতার পথেই এসেছে আমাদের সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ।
এই ভাষার দেশের মানুষ পৃথিবীতে আজ বাংলাদেশি নামে পরিচিত। বাংলা যার ভাষা, শিরে তার ভাষার মুকুট। পৃথিবীর সব জাতি-ই তার ভাষার পূজারী। কিন্তু আমি অনুমান করি বাঙালি-ই একমাত্র জাতি যে জাতি তার ভাষায় বাঁচে, ভাষায় মরে। বাংলায় যে কথা বলে হৃদয়ে সে ধারণ করে তেজী এক কুসুম। তেজী, কেননা, একুশ তার উৎস আর জাগরণ, আর বাংলা তার একুশে পাওয়া কুসুম পেলব সাহস।
সাহস বলেই, বাংলাদেশি যখন দেশান্তরী হয় সে তার ভাষাকেও বহন করে। সব জাতি-ই করে, কিন্তু বাংলাদেশির এই ভাষার ওপর তার আলাদা মমতা তাকে অন্যান্য জাতি থেকে অনন্য করে তোলে। বিশ্বপ্রীতির তরঙ্গ যেমন তাকে ডাকে আর ঘরছাড়া করে, তেমনি ‘বাংলা’র সাহস বলি, স্পন্দন বলি, অহংকার বলি, সে ডায়াসপোরার সুবাস ও স্বভাবে বিযুক্ত না হয়েও তার পরিচয় হয় বিশ্ববাঙালি, বাংলাদেশের বাইরে থেকেও সারাজীবন রয়ে যায় বাংলাদেশের; ফুল যেমন ফোটে, সেও ফোটে মিলিয়ে মিশিয়ে তার বাংলা, বিশ্বের সকল মানুষ ও সংস্কৃতির শামিয়ানার নিচে- ‘অন্য বাংলা বোধের’ জন্ম দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি বিশ্বময় হয়ে উঠে যাদুকরী কুশীলব, জীবনের জয়গানের, জীবন-সম্বৃদ্ধির আবশ্যিক সম্প্রদায় হয়ে।
এই পথেই উত্তর আমেরিকায়
এখন বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা সকলের নজর কাড়ছে। বাংলাদেশি অভিবাসীর দল সম্প্রসারিত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব, সম্প্রীতি, লালিত্য ও জীবন মাধুর্যের উদ্ভাস ও সম্ভার নিয়ে তাদের বৃত্ত উর্বর ও আলোকিত। পৃথিবীর এই গোলার্ধে এখন পর্যাপ্ত রশ্মি এই অভিবাসী গোষ্ঠীর। আগেই বলেছি আশা আর জাগরণ বংলাদেশির জীবন-অভ্যাস, সেই অভ্যাসের লেনদেনও স্বার্থপর নয় মোটেই। নিজেদের এরা যেমন সম্মানিত করছে, ভিন্ন অভিবাসী বা মূলস্রোতের সঙ্গেও এদের বসবাস আদরণীয় হয়ে উঠছে। শ্রমের মর্যাদায় আজ বাংলাদেশিরা অভিষিক্ত হচ্ছে। সততার স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশি আজ জায়গা করে নিচ্ছে বিশ্বাসে ও আশ্বাসে।
এই অভিবাসী দলের একজন হয়ে আমার জীবনভরের যাপিত জীবনে দেখি কতই না সুকৃতির ফসল! যে পথে আমি একদিন হেঁটে দেখেছি, কয়েকটি ভারতীয় দোকানপাটই আমাদের দেশজ জিনিসের একমাত্র সহায়, আজ সেই পথেই দেখি, অনেক অনেক বাংলাদেশির পশরা ও তেজারতি। এমন কোনো জিনিষ নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। সব বিচিত্রতায় ঠাঁসা। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এসব মনে হয়, ঐশী কিছু পাওয়া! মাত্র কয়েক দশকে আমার দেশ এই বিদেশ বিভুঁইয়ে ফুটে উঠেছে এবং ফুটে ওঠা অব্যাহত রেখেছে, এই দেখে ও অনুভব করে আমি অপার প্রশান্তি লাভ করি। রঞ্জনে রঞ্জনে রত্নে রত্নে আমরা আজ লক্ষনীয়, এই পাওয়া বড় পাওয়া। বুক স্ফীত হয়, শ্বাসে আঁশ আসে, যখন শুনি, দেখি, এই অভিবাসীর দল আর তাদের সন্তানেরা, বৈরী পরিবেশ ও পরিস্থিতিতেও তাদের পায়ের নিচের মাটি থেকে পা আলগা হতে দেয় না, শ্রেয়তা থেকে দূরে সরে যায় না; জাগরণ আর জয়ের কাছেই নিজেদের সমর্পণ করে।
করে বলেই দেখি ‘অন্যবাংলা’ বা ‘বিশ্ববাংলার’ অন্য অন্য অনন্য রূপ। আমি অনুভব করি, আমাদের শহর এখন শিল্পকলার শহর। কেননা, চারপাশে চপল হয়ে আছে আমাদের ‘বাংলা’, বাংলা ভাষা। এই চাপল্যের ঝংকৃত বুননে, সম্বৃদ্ধ ও ঐশর্য্যমণ্ডিত হচ্ছে বছরের প্রায় প্রতিটি দিন। সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রমের পর, শিল্প সাহিত্যের জন্যে সময় বের করে সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় অবিরাম ব্রতী হয়ে সৃষ্টিশীলতার স্তবকে স্তবকে নিবিড়-নিবিষ্ট থাকা, এযে কত উঁচু চুড়ায় ওঠে তিলক-পরা, আমি অভিজ্ঞানে ধারণ করে, যারা এসব করছেন তাঁদের প্রতি প্রণত হই।
কী না আছে। গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে, আবৃত্তি হচ্ছে, নাটক হচ্ছে, চিত্রশিল্প হচ্ছে, সাহিত্য আড্ডা হচ্ছে, কারণে-অকারণে আড্ডা হচ্ছে। রেস্তোরাঁ রেস্তোরাঁয় আনন্দ-বেদনা চায়ের কাপে শানিত ও তাপিত হচ্ছে; স্কুলে স্কুলে আমাদের ছেলে মেয়েরা শিষ্টতায় ও মেধায় অভিষিক্ত হচ্ছে। মূলধারায় ‘অথার’ হয়ে, রাজনিতিবিদ হয়ে, ফিল্ম মেকার হয়ে আমাদের উত্তরসূরিরা বিহ্বলতার সুর দিচ্ছে। হচ্ছে আরও কত কী! আর এসব কীর্তির মালা গাঁথছেন, অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে, একগুচ্ছ সংবাদকর্মী, কী প্রিন্ট মিডিয়ায় বা কী ইলেক্ট্রনিক/ডিজিটাল মিডিয়ায়। আমাদের এখানে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপে আর বিচ্ছিন্ন হয়ে নেই। এসব সংবাদকর্মী দিনরাত পরিশ্রম করে সংবাদ পৌঁছে দিয়ে সকলকে সমবেত করছেন একই অবহিতির শামিয়ানার নিচে। আমি এঁদের অভিবাদন জানাই।
এই রচনা যে পত্রিকায় পত্রস্থ হচ্ছে, আমি মনে করি, এই যে একের সঙ্গে অন্যের যোগাযোগ করে দেয়ার, উত্তর আমেরিকার সকল অভিবাসীর ভালোমন্দের খোঁজখবর দেয়ার নিবেদক হিসেবে ‘ঠিকানা’ এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে শুরু থেকে, আমাদের সমবেত করেছে বাংলাদেশি অভিবাসীর পরিচয়ে। আমি অনুমান করি, কেবল এই একটি কর্মযোগের জন্যেই ‘ঠিকানা’ উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে চলৎশক্তির ও চলিষ্ণুতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। ঘরে ঘরে ‘ঠিকানা’র যাত্রা বরাবরই হয়েছে বড়ই প্রত্যাশার, খবরের জন্যে, আমরা কে কেমন আছি, কোথায় আছি, দেশ থেকে কে বা কারা আসছেন, কবে কোথায় কী হবে, ইমিগ্রান্টদের স্ট্যাটাস, আগামীতে দেশ ও দশের অবস্থান কেমন হবে, এক কথায় কমিউনিটির যতসব প্রয়োজনীয় বার্তা, ‘ঠিকানা’র মাধ্যমে আমরা সবসময় পেয়ে আসছি।
জন্মক্ষণের শিহরণ চিরকাল ঝলমল। দেশকে প্রতি সপ্তাহে অল্পক্ষণের জন্যে হলেও বাংলাদেশি অভিবাসীর চৈতন্যের পাশে রাখার যে অভিপ্রায় কয়েকজন যুবক তেত্রিশ বছর আগে ধারণ করেছিলেন, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
‘ঠিকানা’র জন্মসৌরভ বায়ান্নর একুশ। চৌত্রিশ বছরে পদার্পণ করে, একুশের ‘ঠিকানা’য় বায়ান্নর অর্জন বরাবরের মতো সারাৎসার হয়ে থাকবে, আমাদের এই প্রত্যাশা।
‘ঠিকানা’র বর্ষপূর্তিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক