সলিমুল্লাহ খান :
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান
তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’-খান!
-কাজী নজরুল ইসলাম, ‘জাতের বজ্জাতি’
কাজী নজরুল ইসলাম এখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র বলিয়া গণ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুইয়া আছেন। তাঁহার নামের আগে ‘জাতীয় কবি’ উপাধিটিও সেখানে- তাঁহার সমাধিসৌধের গায়েÑ উৎকীর্ণ আছে। এক্ষণে প্রশ্ন হইতেছে, জাতীয় কবি বলিতে কী বোঝায়? কবি তিনি জাতীয়- এ সত্যে সন্দেহ নাই। কিন্তু জিজ্ঞাসা করিতে দোষ কোথায়, কোন জাতীয় কবি তিনি! আরও বাংলা করিয়া বলিতে, নজরুল ইসলাম কোন জাতির কবি? ১৯৪৭ সালের পর হইতে কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয়তা লইয়া যে তর্কবিতর্ক চলিয়া আসিতেছে, ১৯৭১ সালের পর আমরা আবারও কি সেই দিকেই ফিরিয়া আসিতেছি? না নতুন কোন জাতীয় বিতর্কের সূচনা হইয়াছে? আজিকার নিবন্ধে সেই কথাটি তুলিবার ইচ্ছা রাখি।
১.
বর্তমান বাংলাদেশ যে চারি সীমানার মধ্যে গঠিত হইয়াছে সেই সীমা ধরিয়া কোন রাষ্ট্র গঠিবার চিন্তা নজরুল ইসলাম কখনো করেন নাই। যে যুগে তিনি জন্মিয়াছেন সে যুগে আর কেহও বা এমন চিন্তা করিয়া থাকিবেন কি না বলিতে পারিব না। তবে আমাদের যুগের একজন চিন্তাশীল লেখক একটা হক কথা লিখিয়াছেন। লেখকের নাম সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন। ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক পদ হইতে ইনি অপসৃত হইয়াছিলেন। ১৯৮৬ সালের ২ এপ্রিল ঢাকায় আকস্মিকভাবে মারা যাইবার কয়েক মাস পর ‘বাংলার কথা’ নামে তাঁহার একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের বহি বাহির হয়। সেই বহির এক জায়গায় ‘নজরুল প্রসঙ্গ’ নামক নিবন্ধে ইনি লিখিতেছেন, ‘তিনি [নজরুল ইসলাম] যে বাংলায় চারণ করেছেন সে আজকের এই বাংলা নয়, সে বাংলা ছিল ব্রিটিশশাসিত অখণ্ড ভারতের অখণ্ড বাংলা, যার ঐতিহাসিক পরিসমাপ্তি ঘটেছে ১৯৪৭ সনের ১৫ই আগস্ট।’
কাজী নজরুলের সক্রিয় জীবনÑ সংক্ষেপে বলিতে গেলেÑ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। তারপর আরও ৩৪ বছর তিনি নিষ্ক্রিয় প্রাণধারণ করিয়া ছিলেন, এ কথা অসত্য নহে। তবে সেই সময়ে ভারতে, পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে অনেক রক্ত গড়াইয়া গিয়াছে। দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে, দাঙ্গায় আর যুদ্ধে অনেক প্রাণ ঝরিয়াছে। ধরিয়া লইতে হইবে, ‘এ সব কিছু ঘটনা ঘটেছে জীবিত নজরুলের অজ্ঞানে।’ তার পরও অস্বীকার করা যাইবে না, নজরুল ইসলামকে কেন্দ্র ধরিয়া নতুন নতুন জাতীয় বিতর্কের সূচনা হইয়াছে। পাকিস্তান কায়েমের পর কবি গোলাম মোস্তফা প্রচার করিয়াছিলেন, ‘নজরুলের কাব্যাদর্শ যদি বাঙালি মুসলমানেরা গ্রহণ করিত তবে ভারত স্বাধীন হইত; কিন্তু মুসলমানেরা পাকিস্তান অর্জন করিতে পারিত না।’ গোলাম মোস্তফার প্রস্তাবটি আমি এখানে কবি জসীমউদ্দীনের জবানি অনুসারে লিখিলাম। জসীমউদ্দীন সাক্ষ্য দিয়াছেন, পাকিস্তান হাসেল হইবার পর গোলাম মোস্তফা দেশের রাষ্ট্রভাষা হিশাবে উর্দুকেই সমর্থন করিয়াছিলেন। তাঁহার অনেক কারণ। সকল কথা এক নিবন্ধে বলা যাইবে না।
গোলাম মোস্তফার প্রস্তাব ছিল, নজরুল ইসলাম পাকিস্তানের কবি নহেন। তাঁহার ভাষায়, ‘পাকিস্তানের কবি হওয়া তো দূরের কথা, নজরুল ছিলেন ঘোর পাকিস্তানবিরোধী।’ এই প্রস্তাব বিক্রয় করা কালক্রমে কঠিন প্রমাণিত হইল। অন্য দিকে আবুল মনসুর আহমদ দাবি করিয়াছিলেন, নজরুল ইসলামই পাকিস্তানের আসল প্রেরণাদাতা। তাঁহার কথায়, ‘পাকিস্তান হাসিল একটা গণ-বিপ্লব। আর সব গণ-বিপ্লবের মতোই পাকিস্তান-বিপ্লবের শক্তির উৎস ছিল গণ-মনের প্রস্তুতি। মুসলিম-বাংলার গণ-মনে এই প্রস্তুতি এনেছিল নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা।’ মানুষ অলংকার-পছন্দ প্রাণী। আবুল মনসুর আহমদ তাই আরও অলংকার দিয়া লিখিলেন : ‘নজরুল ইসলাম এক দিন বিনা নোটিশে ‘আল্লাহু আকবর’ তকবিরের হায়দারী হাঁক মেরে ঝড়ের বেগে এসে বাংলা-সাহিত্যের দুর্গ জয় ক’রে বসলেন। মুসলিম-বাংলার ভাঙা কিল্লায় নিশান উড়িয়ে দিলেন। এক দিনে দূর ক’রে দিলেন মুসলিম-বাংলার ভাষা ও ভাবের হীনম্মন্যতা। মনের দিক থেকে জাতীয় জীবনে এ একটা বিপ্লব। এ বিপ্লবের একমাত্র ইমাম নজরুল ইসলাম।’ এই জাতীয় যুক্তির কাছে মাথা নত করিয়া পাকিস্তান বিপ্লবের নেতারা নজরুল ইসলামকে ভালোবাসিবার নীতি গ্রহণ করিলেন। তাহারা নজরুল ইসলামের ‘সত্যিকার কল্যাণ’ কামনা করিলেন। তাঁহাকে পাকিস্তানি বলিয়া গ্রহণ করিলেন। তবে এই বাবদ মূল্যও আদায় করিলেন একটা।
এই ‘সত্যিকার কল্যাণ’ কামনার অংশস্বরূপ তাঁহারা নজরুল ইসলামের কবিতার বিশাল ‘অবাঞ্ছিত অংশ’ বাদ দিয়া তাঁহাকে ‘কেবলমাত্র ইসলাম ও মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ বলিয়া গ্রহণ করিলেন। কবি ফররুখ আহমদ গোলাম মোস্তফা পথের পথিক ছিলেন না। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।’ ফররুখ আহমদ ‘অনেক সংকোচের পরও’ কবুল করিলেন, ‘পলাশী যুদ্ধের পর নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানের জাগরণের প্রথম কবি।’ তবে এ কথা স্মরণও করাইয়া দিলেন যে ভারতের পশ্চিম প্রান্তের মহাকবি ইকবালের ‘দেশকালজয়ী প্রতিভার সঙ্গে নজরুলের তুলনা করতে যাওয়া বাতুলতা’ বৈ নহে।
২.
আমরা জানি, নজরুল ইসলাম শুদ্ধ কবিতা লিখিয়াই কর্তব্য শেষ করেন নাই। সরাসরি রাজনীতিতেও যোগ দিয়াছিলেন তিনি। সে যুগের মূল রাজনীতি ছিল পরাধীনতার কবল হইতে দেশকে স্বাধীন করিবার রাজনীতি। পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম তো শেষ বিচারে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠারই সংগ্রাম। জাতির চারি সীমানার মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আর পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম। সেই কারণে একই সুতায় গাঁথা। নজরুল ইসলাম এই জন্যই এক দিকে শ্রমিক ও কৃষকের সহিত একাত্ম হইয়াছিলেন, অন্য দিকে হিন্দু ও মুসলমান প্রভৃতি ধর্মীয় ক্ষেত্রের ব্যবধান কমাইয়া জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কর্তব্যও পালন করিয়াছিলেন।
বলা বাহুল্য, নজরুল ইসলামের এই সাধনায় অনেকেই সন্তুষ্ট হন নাই। জাতি বলিতে যাঁহারা শুধু মুসলমান ‘নিছক বাঙালি মুসলমানও নয়’ বুঝিতেন তাঁহারা নজরুল ইসলাম প্রণীত এই হিন্দু-মুসলমান মিলনের দাবি দেখিয়া বড় সুখী হন নাই। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কোনো একদিন ফররুখ আহমদ লিখিয়াছিলেন, ‘খিলাফৎ আন্দোলন-কালে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব একাধিক কারণে স্মরণীয়। আত্মবিস্মৃত জাতি বহুদিন পরে শুনল তার আশা-আকাক্সক্ষার কথা। নতুন করে পেল সে তার ঐতিহ্যের পরিচয়।’ তবে ফররুখ আহমদের ধারণাÑ নজরুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান সমাজের দাবি মিটাইতে পারেন নাই। তাঁহার ভাষায়, ‘কিন্তু নজরুলের সহজ স্বীকৃতি ও অবহেলা বাঙালি মুসলমান সমাজের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে, কারণ তারা আরও চেয়েছিল নজরুলের কাছে, তারা তাদের নিজের দর্শন, জীবনবোধ ও ইতিহাসের অভিব্যক্তি চেয়েছিল কবি নজরুলের কবিতায়।’
ফররুখ আহমদ যাহা ভদ্রজনোচিত, শোভন ভাষায় লিখিয়াছেন তাহার সুলভ সংস্করণ পাওয়া যাইতেছে গোলাম মোস্তফার লেখায়। তিনি লিখিয়াছিলেন,
নজরুলকে পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলিয়া অনেকে মনে করেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় অপবাদÑ যদি কিছু থাকে, তবে [তা] এই। নজরুল যা নন, তাঁর উপর তাই আরোপ করিলে তাঁকে হেয় করা হয়। পাকিস্তানের কবি হওয়া তো দূরের কথা, নজরুল ছিলেন ঘোর পাকিস্তানবিরোধী। তিনি গাহিয়াছিলেন ‘অখণ্ড ভারতের’ গান, তিনি দেখিয়াছিলেন হিন্দু-মুসলমান কৃষ্টির ‘হরগৌরীরূপ’। ভারত জুড়িয়া হিন্দু স্বাধীনতার যে সাধনা চলিতেছিল, নজরুল আসিয়া সেই সুরেই তাঁহার কণ্ঠ মিশাইয়া গান গাহিয়াছিলেন। সে-যুগের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকেই তিনি তাঁহার রাজনৈতিক আদর্শ রূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। মুসলিম জাতির জন্য তিনি নূতন করিয়া কিছু ভাবেন নাই।
গোলাম মোস্তফা দুঃখ করিলেন : ‘ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিলেন এমন যুগেÑ যখন ভারতের মুসলমানদের কোনো বলিষ্ঠ আত্মচেতনাই ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, নজরুল ইসলাম সেই ইকবাল-যুগে জন্মগ্রহণ করিয়াও পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখিতে পারিলেন না! তিনি দেখিলেন কি না ভারত-লক্ষ্মীর স্বপ্ন! নজরুল ইসলামের পক্ষে এ এক মস্তবড় দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে।’ এই কথাগুলি গোলাম মোস্তফা লিখিয়াছিলেন ইংরেজি ১৯৫০ সালে। একই বছরে তিনি প্রস্তাব দিয়াছিলেন, নজরুল ইসলামকে কলিকাতা হইতে লইয়া আসিতে হইবে। গোলাম মোস্তফার ইচ্ছা পূরণ হইয়াছিল, তবে অনেকদিন পরে, স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হইবারও পর।
গোলাম মোস্তফা নজরুল ইসলামের কবিতার একটি পাকিস্তানি সংস্করণ প্রকাশের প্রস্তাবও দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ঐ সংস্করণে নজরুল কাব্যের ‘অবাঞ্ছিত অংশগুলি’ থাকিবে না। আমাদের ভাগ্য, বাংলাদেশে তো বটেই ‘তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানেও এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটি পুরাপুরি আমল করা হয় নাই। গোলাম মোস্তফা এইরকম লিখিয়াছিলেন : ‘নজরুলের সত্যিকার কল্যাণ আমরা কামনা করি এবং সেই জন্য তাঁহাকে পাকিস্তানে লইয়া আসিয়া অথবা বিদেশে পাঠাইয়া তাঁহার সুচিকিৎসার প্রস্তাব আমরা দিয়াছি; সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাব্যের একটা পাকিস্তানি সংস্করণ প্রকাশ করার প্রস্তাবও আমরা করিয়াছি।’
গোলাম মোস্তফা নজরুল ইসলামের কবিতায় যে ‘অবাঞ্ছিত অংশ’ খুঁজিয়া খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন তাহার পরিমাণ অল্প নহে। তাঁহার আট বছর আগে এক দিন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন একই কারণে সপ্তদশ শতকের কবি সৈয়দ আলাওলকেও বাতিল ঘোষণা করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন,
ঐতিহাসিক বিচারে, বাংলায় মুসলিম সাহিত্যের সূচনা আলাওল থেকেই হওয়া উচিত। কিন্তু আলাওলের সাহিত্যে মুসলিম সমাজের প্রতিচ্ছবি নেই। তিনি একান্তভাবে হিন্দুভাবাপন্ন। তাই সহধর্মী হলেও তিনি আমাদের সগোত্র নন। তাঁর স্থান আমাদের থেকে একটু দূরে। তাঁর সাহিত্য নিয়ে আমাদের গর্ব করা সাজে, কিন্তু তাঁর নিকট হতে অনুপ্রেরণা প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। আমাদের প্রয়োজন যে জাতীয় সাহিত্যের, যার উদ্ভব আমাদের সামাজিক জীবন থেকে, আলাওল সেইরূপ কোন সাহিত্য আমাদের প্রদান করেননি। তিনি সম্মানার্হ; কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করা চলে না।
অনেকে জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন, সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা কি বস্তু? আমি তাঁহাদিগকে সবিনয়ে বলিব, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের এই আহ্বান পাঠ করিবেন। সাম্প্রদায়িকতা কাহাকে বলে হাতেনাতে চিনিতে পারিবেন। বলা বাহুল্য নহে, এই আহ্বান ১৯৪৩ সালের। আপনারা লক্ষ্য করিবেন, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি মহোদয় ‘সভাপতির আহ্বান’ নামক এই ভাষণে কাজী নজরুল ইসলামের নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করেন নাই।
নজরুল ইসলাম ছিলেন কায়মনোবাক্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সৈনিক। সেই অর্থে তাঁহাকে ‘জাতীয়তাবাদী’ আখ্যা দেওয়াটা নিতান্ত অসংগত নয়। যুগের ধর্ম অনুসারে তিনি যদিও ছিলেন সর্বভারতীয়Ñ কিংবা কমসে কম অখণ্ড বাংলারÑ জাতীয়তাবাদী তথাপি অখণ্ড বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের দুর্দশার কথাও তিনি কখনো ভোলেন নাই। নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানের উন্নতি চাহিয়াছেন; কিন্তু মুসলমান জাতীয়তাবাদীর ভেক তিনি কদাচ ধারণ করেন নাই। সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের দাবি সহি। তাঁহার কথায় : ‘অখণ্ড ভারতের অখণ্ড বাংলার জাতীয় চেতনাই ছিল নজরুলের জাতীয়তাবোধের মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই স্বাভাবিকভাবেই নজরুলের জাতীয়তাবাদ ছিল অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ।’
৩.
সত্য বটে, ১৯২৯ সালেও একবার বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ- ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগেÑ অখণ্ড বাংলার রাজধানী শহর কলিকাতায় জনাকীর্ণ জনসভা ডাকিয়া কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ উপাধি দিয়াছিলেন। তাই বলিতে দোষ নাই, ‘জাতীয় কবি’ উপাধিটির সহিত কাজী নজরুল ইসলামের বিলক্ষণ পূর্ব-পরিচয় ছিল। শুদ্ধ প্রশ্ন করিতে হয়, এই ‘জাতীয় কবি’ আর সেই ‘জাতীয় কবি’র মধ্যে মিল কতটুকু? ভাবের ঘরে চুরি কথাটা এখানে সত্য সত্যই সার্থক হইয়াছে।
নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণার কাহিনিটা আহমদ ছফাও খানিক বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন,
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতার সি.আই.টি. রোডের আড়াই কক্ষের ফ্ল্যাট থেকে ঢাকা নিয়ে এসে ধানমন্ডির একটি আলোবাতাসযুক্ত খোলামেলা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। শেখ সাহেবের সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁকে বঙ্গভবনে মাথায় কিস্তিটুপি পরিয়ে গলায় মেডেল-ফেডেল কী সব দুলিয়ে দিয়ে মুসলমান বানিয়ে ছাড়লেন। কবির দুর্ভাগ্য, ছিয়াত্তর বছর বয়সে সজ্ঞানে ইসলাম ধর্মটি তিনি গ্রহণ করতে পারলেন না। তখন তো নজরুল ইসলাম সার্কাসের অবলা জন্তু হয়ে উঠেছেন। তাঁকে দিয়ে খেলা দেখাতে বাধা কোথায়! এত অত্যাচার বুড়ো হাড়ে সইবে কেন! এক দিন তিনি মারাই গেলেন।
আহমদ ছফা আরও যোগ করিয়াছেন, ‘আমরা তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে দাফন করলাম। নজরুল ঈমানদার বান্দা ছিলেন। তাঁর ঈমানের তেজ এত প্রখর ছিল যে তা তাঁকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকা শরীর নিয়ে জিয়া সাহেবের হাতে বয়েত হয়েÑ মাথায় কিস্তিটুপি পরেÑ ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। এইভাবে কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকার মাটিতে দেহরক্ষা করে নিজেকে পাক্কা মুসলমান প্রমাণ করলেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে চিহ্নিত হলেন।’
আহমদ ছফার ভাষা হইতেই ভাবটা খানিক নির্ণয় করা যায়। তাঁহার মতে, বাংলাদেশেÑ বিশেষ জিয়াউর রহমানের জমানায়- যাহা করা হইল তাহা এক ধরনের অনধিকারচর্চা। আহমদ ছফা বলিয়াছেন, ‘কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে চিহ্নিত করে আমরা কবির মান বৃদ্ধি করলাম, নাকি জাতিকেই সম্মানিত করলামÑ সে বিচার করার সময় এখনও আসেনি।’ এই কথাটি ইংরেজি ১৯৮৮ সালের।
আহমদ ছফার এই উপমার কারণ পরিষ্কার। তিনি মনে করেন ‘জাতীয় কবি’ উপাধির আড়ালে খোদ নজরুল ইসলামের জীবনব্যাপী সাধনাকেই প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হইয়াছে। আহমদ ছফার কথা আহমদ ছফার জবানিতেই শোনা ভালো। তিনি লিখিয়াছেন,
আমরা আমাদের মাটিতে তাঁকে দাফন করেছি। আর মাটিচাপা দিয়েছি [তাঁর] সত্যিকার শিল্পীসত্তাকে। জীবনের অকিঞ্চিৎকর ভগ্নাংশে চৈতন্যহীন কবিকে বড়সড় একটা বাড়িতে থাকতে দিয়ে আজ আমরা মৃত [কবির] কাছ থেকে যে মূল্য আদায় করতে চাইছি তার কাছে শাইলকের আধ পাউন্ড মাংসের দাবিকেও তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমরা তাঁকে বৃহত্তর বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে টেনে এনে সাম্প্রদায়িক ফ্রেমে আটকাতে চাইছি। তাঁর বৃহত্তর পরিচয় ঢেকে রেখে ক্ষুদ্রতর পরিচয়টা জাহির করতে চেষ্টা করছি। সভাসমিতিতে শোভন জবানে আমরা যা বলি, তার চাইতে যা বলি না তা এতদিনে মুখ্য হয়ে উঠছে।
আহমদ ছফার এই বিচারের সহিত বিস্ময়কর সামঞ্জস্য দেখা যায় আরেকটি বিচারের। ‘বাংলার কথা’ নামক বইয়ের এক জায়গায় সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন লিখিয়াছেন,
এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে নজরুল [ইসলাম] কোনদিন ধর্মভিত্তিক বিভাজ্য জাতীয়তায় বিশ্বাস করেননি এবং ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার তিনি পূর্বাপর বিরোধী ছিলেন। এই একই কারণে চল্লিশের দশকের প্রারম্ভে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পৃথক মুসলিম আবাসভূমি পাকিস্তান গঠনের রাজনৈতিক প্রস্তাবনা যখন উত্থাপিত হয় ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে সেদিন তার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিলেন নজরুল। ১৯৪১-৪২ সালে শেরেবাংলা ফজলুল হক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক পত্রিকা নবযুগে স্বনামে লিখিত বিভিন্ন সম্পাদকীয়ের মারফত সে সময় নজরুল [ইসলাম] তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করেছিলেন।
সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন আরও লিখিয়াছেন, ‘যে ঐতিহাসিক সময়ে ব্রিটিশ ভারতে অবিভক্ত বাংলায় নজরুল সজ্ঞানে জীবিত ছিলেন সেই সময়ের সমসাময়িক জাতীয় চেতনা ও বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা রূপগত ও গুণগতভাবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাই কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সেই অধিক্ষেত্রে তাঁকে সীমিত করা এক বিরাট ঐতিহাসিক ভ্রম হবে।’
৪.
আহমদ ছফা ইহার অধিক বলিয়াছেন। সেকালের বাঙালি মুসলমান সমাজের গর্হিত সংকীর্ণতাদোষ হইতে নজরুল ইসলাম পুরাপুরি মুক্ত ছিলেন। তাঁহাকে আবার সেই সংকীর্ণ খোপে বন্ধ করার চেষ্টাও সেই কারণে অধিক গর্হিত। আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, ‘রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজ যতদিন পর্যন্ত তাদের প্রচারের ঢাকের কাঠি হিশাবে ব্যবহার করা না যায়, ততদিন নজরুল প্রতিভার বিশেষ আদর সমাদর করেনি। তৎকালীন প্রতিনিধিত্বশীল মুসলিম ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধিতার এমন একটি পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যে নজরুলের জীবন ফাঁদে পড়া পশুর মতো হয়ে পড়েছিল।’ নজরুল ইসলাম মুসলমান সমাজের দৈন্য দেখিয়া মুখ ফিরাইয়া লয়েন নাই। আহমদ ছফা বলেন, ‘সত্য বটে ইসলাম ধর্মের সাম্য, মৈত্রী এবং সৌভ্রাতৃত্ববোধ-এ সকল প্রতীতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। মুসলমানদের অধঃপতিত দশা দেখে তিনি দুঃখ পেতেন এবং প্রাণের গভীর থেকে তাঁদের মধ্যে একটা উত্থান কামনা করতেন।’
ইহার অর্থ এই নয় যে তিনি হিন্দু কিংবা অন্য কোন মুসলমানের সম্প্রদায়কে ছোট করিয়া দেখিবার পক্ষে ছিলেন। আহমদ ছফার কথায়, ‘সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কখনও তাঁর ধ্যানদৃষ্টিকে কলুষিত করতে পারেনি। নজরুল ইসলামের জীবন, তাঁর কাব্য, সাহিত্য, সংগীত সাম্প্রদায়িক সম্মিলনের সেতুবন্ধন। স্বভাবে, চরিত্রে, জীবনে, আচরণে এই কথাটিকে নজরুলের চাইতে কে বেশি সত্য প্রমাণ করতে পেরেছে?’ যাহাকে বলে তাঁহার জীবনের শেষ অভিভাষণ সেই ভাষণে নজরুল ইসলাম বলিয়াছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাবÑ অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তূপের মতো জমা হয়ে আছেÑ এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম।’
সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের কথায়ও আহমদ ছফার প্রতিধ্বনি আছে। তিনি লিখিয়াছেন, ‘নজরুলের এই অবিভাজ্য সর্বজনীন রূপকে কোন কৃত্রিম বিষুবরেখার মারফত বিভাজ্য করার কোন অবকাশ রাখে না। অতীতে পাকিস্তানি আমলে নজরুলের সাম্প্রদায়িককরণ প্রচেষ্টা এবং অধুনা বাংলাদেশে নজরুলকে জাতীয়করণের বেড়াজালে নিক্ষিপ্ত করার প্রয়াস সমভাবে দুষ্ট ও দূষণীয়।’ কারণ, ‘নজরুলের যে উদার সর্বজনীন মানবিক ভাবমূর্তি ও চিন্তাধারা তা কোন আংশিক বিকাশ ও আংশিক বিনাশের সুযোগ রাখে না।’ এই অবস্থায় আমরাও আরেক প্রস্ত নৈতিক সংকটের মুখামুখি হইতেছি। ১৯৪২ সালের পর হইতে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে যত সিদ্ধান্ত হইয়াছে তাহার কোনটার দায়ই তাঁহার ঘাড়ে চাপান যায় না। এই দায় আমাদেরই লইতে হইবে। কোন সংজ্ঞাহীন আত্মবিস্মৃত মানবসন্তানকে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা কতখানি শ্রেয়নীতিসম্মত সে প্রশ্নও তুলিতে হইবে। সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন সত্য কথাই বলিয়াছেন : ‘একজন কবির জীবদ্দশায় তাঁর মৌলিক ভাবমূর্তির বিনষ্টিসাধন ও চিন্তাধারা পরিবর্তন করার প্রয়াসÑ শুধুমাত্র সেই ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতার অবকাশেÑ এর তুলনা অন্য কোন দেশের ইতিহাসে ঘটেনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সীমাহীন নির্বুদ্ধিতার জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যে লজ্জা ও ক্ষোভের সঞ্চার হতে বাধ্য, যদিও বর্তমানে আমরা এই নির্বুদ্ধিতার সামনে সম্পূর্ণ নিরুপায় দর্শকমাত্র।’
কে জানে আমাদের এই নিরুপায় দর্শকদশার শেষ হইবে কখন? আদৌ হইবে কি? কোনোদিন?