জাপা-জামায়াতের সঙ্গে বিশাল অঙ্কের ডিল

স্যাংশনদাতাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনের ফুঁ : বিএনপির সামনে ‘জনমের শিক্ষা’

বিশেষ প্রতিনিধি : মাঠে এবং ভোটে দুভাবেই বিরোধী দলকে মোকাবিলা ছাড়া উপায় নেই শেখ হাসিনা সরকারের। এর একটা বাদ দিয়ে আরেকটা করার উপায় নেই। মাঠে মেরে ফেলার মতো অবস্থা এখন আর নেই। আবার কেবল ভোট ম্যানিপুলেশনেও কাভার দেওয়ার একতরফা সুযোগও সংকীর্ণ। তাই মাঠ-ভোট, আন্দোলন-নির্বাচন সব পথ না ধরলে তা হবে সরকারের জন্য সুইসাইডাল। জেনে-শুনে-বুঝে সেই পথে না গিয়ে সরকার ধরছে চীনা পথ। দমন-পীড়নসহ ব্যাপক অ্যাকশনে চীনের বিভিন্ন শহরে চলা বিক্ষোভ অনেকটাই দমে এসেছে। সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত চীনা নাগরিকেরা সংহতি জানালেও এতে কেয়ার করছে না শি জিনপিং সরকার। বিবিসির সাংবাদিক নির্যাতনে লন্ডন-বেইজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ফাটল ধরলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার সরকারের।
কঠোর কোভিডনীতি, সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ ও প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের পদত্যাগের দাবিতে দেশটিতে চলা বিক্ষোভকে সরকারের বিরুদ্ধে চীনে এ-যাবৎকালের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ বলেছে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো। সরকারের আজ্ঞাবহ চীনা সংবাদমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে একদম চুপ। যদিও চীনের আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন ও তাদের ওপর দমনের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিক্ষোভকারীদের মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ নজর দিতে বেইজিংকে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহকালে বিবিসির সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এসবে কেয়ার না করে দমন আরো তেজি করে সুফল পাচ্ছে শি জিনপিং সরকার। বাংলাদেশ সরকারকেও তা ফলো করার পরামর্শ দিচ্ছে হিতাকাক্সক্ষীরা। কেবল দমনেই না থেকে নির্বাচনী কারসাজির আয়োজনেও ত্রুটি না করার তাগিদ আছে দলের ভেতর থেকে। কিন্তু গত মাস কয়েকে রাজনীতির সঙ্গে কূটনীতি-অর্থনীতির যে সংযোগ ঘটেছে, সেখানে আগের মতো একতরফা সুযোগ আর নেই এখন। এর পরও আশাবাদী সরকার।
রাজনৈতিকভাবে উতরানোর পাশাপাশি একরোখা কূটনীতির রসায়নে এক্সট্রিম চলে যাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কথার ঝাঁজেও সেই ছাপ স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা আমাদের ওপর স্যাংশন দেয়, মানবাধিকারের কথা বলে, তারাই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দেয়।’ বঙ্গবন্ধুর এক খুনিকে আমেরিকা ‘লালন-পালন’ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকার কারবারই এ রকম। যুক্তরাষ্ট্র তার দেশ থেকে রাশিয়ার অনেক কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে মনে করিয়ে দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সময় হলে বাংলাদেশও তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করা বিদেশি কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবে।
বিএনপির সঙ্গে সরকারকে সংলাপ-সমঝোতায় যাওয়ার তাগিদ দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে চরম ক্ষুব্ধ সরকার। প্রকাশ্য সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, ‘অনেকে বলেন ডায়ালগ করতে হবে। আলোচনা করতে হবে। কাদের সঙ্গে? ওই বিএনপি, খালেদা জিয়া-তারেক জিয়ার সঙ্গে?’ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সরকারের এক্সট্রিম মানসিকতা আরো পরিষ্কার।
এদিকে কিছু দুষ্টলোকের কথায় বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি রাতের ভোট নিয়ে শিষ্টাচার-বহির্ভূত মন্তব্য করে কূটনৈতিক পাড়াকে আরেকটি নাড়া দিয়ে বসেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুষ্টলোকের কথায় নাচানাচি করা ব্যক্তি জাপান বা কোনো দেশেরই রাষ্ট্রদূত হতে পারেন কি না- এমন একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। যেখানে কূটনীতিকেরাই তাদের নিজ নিজ দেশের স্বার্থে অন্যদের নাচিয়ে বেড়ান, সেখানে এ ধরনের মন্তব্যের মধ্যেই শিষ্টাচারের প্রশ্ন এসে গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা ইথারে থাকতেই জাপানের রাষ্ট্রদূত আবার মুখ খুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। শুধু জাপান নয়, সমমনা অন্যরাও বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন আশা করে মর্মে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন অন্যান্য দেশের কূটনীতিকেরাও। তাই নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘শুধু আমিই নই, সমমনা সকলেই বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে।’ মোটকথা বাংলাদেশে আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনটি ২০১৪ বা ২০১৮ মডেলের হবে না। সেই মডেলটি কী বা কী ধরনের হবে, সে সম্পর্কে কোনো বার্তা নেই।
এরই মাঝে উপ-আঞ্চলিক পরিসরে ঘটে গেছে আরেকটি অতিকূটনীতি। ভারতকে বাদ রেখেই চীনে হয়ে গেছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাসহ ১৯ দেশকে নিয়ে ‘চায়না-ইন্ডিয়ান ওশেন রিজিয়ন ফোরাম অন ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের’ সভা। ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল, আফগানিস্তান, ইরান, ওমান, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, সিসিলি, মাদাগাস্কার পর্যন্ত ছিল সভাটিতে। ভারতকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, স্মরণ‌ও করা হয়নি। অথচ নামে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের সভা, যা ভারত মহাসাগর অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকে ঘিরে নতুন সমীকরণের লক্ষণ দেখছেন কূটনীতিকেরা। এ প্রশ্নে ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশেও বিরত। আর বাংলাদেশের অবস্থান এদিক-ওদিক সব দিকেই। এতে বাংলাদেশের স্থানিক রাজনীতিতে রহস্য আরো বাড়ছে।
দেশীয় রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে গত তিন মেয়াদের মতো বিএনপিকে গর্তে ফেলতে জাতীয় পার্টিকে ফ্যাক্টর করার বিশাল আয়োজন তুঙ্গে। ফান্ডও বিশাল। জিএম কাদের ও রওশন এরশাদকে নাটকীয়ভাবে মিলমিশ করে দেওয়ার পুরো রিমোট কন্ট্রোলই সরকারের হাতে। ব্যাংককে টানা পাঁচ মাস চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে জলদি ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছে রওশন এরশাদকে। তাকে দিয়ে পড়ে শোনানো হয়েছে তৈরি করে রাখা কয়েক লাইনের স্ক্রিপ্ট। তার জবানিতে জানানো হয়েছে : ‘সামনের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, জাপার ওপর অনেক অত্যাচার করেছে বিএনপি। মামলায় জেলে দিয়েছে এরশাদসহ অনেককে। জাপাকে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়নি।’
জাতীয় পার্টির বিভেদ তথা দেবর-ভাবির পুরো নাটকীয়তাই এগোচ্ছে সরকারের প্রযোজনা ও পরিচালনায়। নির্বাচন সামনে রেখে দলটিকে দিয়ে আরো খেলা ও খেলানোর স্লট-মাঠ সবই প্রস্তুত। রওশনকে দিয়ে শুধু এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সংগঠিত নয়, বিভিন্ন সময়ে এ পার্টি ছেড়ে যাওয়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান মঞ্জু, কাজী জাফর আহমদ বা ডা. মতিনের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী জাতীয় পার্টিগুলোকেও একত্র করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। জোর গুঞ্জন, বিশাল এই ফান্ড থেকে ‘কাউকে ফিরতে হবে না খালি হাতে’। মূল জাপা ছেড়ে চলে যাওয়াদেরও মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি ছাড়া বাকিরা বিএনপির সঙ্গে আছেন। তাদের নিয়ে আসার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত হলে বিএনপি বড় ধাক্কা খাবে বলে সরল হিসাব সরকারের। কাছাকাছি ধরনের সমীকরণ এবং আনলিমিটেড ডিল জামায়াতকে নিয়েও। তাদেরকে ভিন্ন নামে নিবন্ধন দিয়ে মূল স্রোতে নির্বাচনের মাঠে এনে তুরুপের তাস ছোড়ার অ্যাজেন্ডাও এগোচ্ছে সূক্ষ্ম ও দ্রুত কৌশলে।