জাফরের সাথে প্রেম আর রাশিমের সাথে বন্ধুত্ব

ঠিকানাকে এক্সক্লূসিভ সাক্ষাতকারে নায়িকা ববিতা

সাঈদ-উর-রব : যদিও পিতা- মাতার ভালবেসে দেয়া একটা নাম আছে। তবে তার চেয়েও জনপ্রিয় কোটি ভক্ত- অনুরাগীর মুখে মুখে উচ্চারিত এবং মনে মনে জপিত নামটি ’ববিতা’। বাংলা ছায়া ছবির এক সময়ের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী ছিলেন ববিতা। এখনো দেশে- প্রবাসে সকলের মুখে সশ্রদ্ধায় উচ্চারিত নাম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ববিতাই প্রথম যিনি দেশের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি বয়ে আনেন। বিশ্বের অন্যতম এক খ্যাতিমান চলচ্চিত্র স্রষ্টা অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেতে অভিনয় করে তিনি এই আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জনে হ্যাট্রিক করেন। ষাটের দশক থেকেই তিনি সিনেমা জগতের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নানা পর্যায়ে। অভিনয়, প্রযোজনা, সেন্সর ও জুড়ি বোর্ডের সদস্য। সিনেমার মান, পরিবেশ উন্নয়নে ববিতার ভাবনার অন্ত নেই। সিনেমা জগতের সম্ভাবনা নিয়ে যখন কথা হয় তখন তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েন, হতাশার কথা শুনলে কষ্ট পান। সম্প্রতি তিনি নিউইয়র্কে ঢালিউড মিউজিকের লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট এওয়ার্ড গ্রহণ করতে এসেছিলেন। সে সময়েই ঠিকানার আমন্ত্রণে এসে তিনি এ দীর্ঘ সাক্ষাতকারটি দেন, যাতে রয়েছে তার সিনেমা জগৎ, তার প্রেম- ভালবাসা, বিবাহ- বিচ্ছেদ, জহীর রায়হানের অন্তর্ধান, মুক্তিযুদ্ধ, সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্য, বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে বিচরণ, বাংলাদেশের সিনেমার একাল- সেকাল, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের অনেক না বলা কথা, আনন্দ- বেদনার অনুভূতি, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তিনি তার এই সাক্ষাতকারে সকল কথাই বলেছেন কোন রাখডাক না করেই। বলেছেন নায়ক জাফর ইকবালের সাথে প্রেমের কথা, বলেছেন এফডিসির কথা। এফডিসির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন- আমাদের চোখের সমানে এফডিসি কি থেকে কি হয়ে গেল, এফডিসিতে ঢুকলে এখন কান্না পায়। বাংলাদেশের বর্তমান চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেছেন- অতীতের ছবি আর বর্তমানের ছবির মধ্যে আকাশ- পাতাল ব্যবধান। বলেছেন, আজারবাইজনের নায়ক রাশিমের সাথে বন্ধুত্বের কথা। যা তিনি এর আগে কখনো বলেননি। নায়ক রাশিমের সাথে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে কী কী সমস্যায় পড়েছেন, তাও উল্লেখ করেছেন। ববিতা এখন কী করছেন, কী করতে ভাল লাগে, তার শখ কী, তার স্বপ্ন কী, বিদেশে গিয়ে কোন ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন- তা অবলীলায় উল্লেখ করেছেন। তার দীর্ঘ নায়িকা জীবন ও সংসার জীবন ও ছেলের জন্য সারা জীবনের সেক্রিফাইসের কথা, পাখির সাথে সময় কাটানোর কথাসহ সব কিছুই বলেছেন। যা আগে কখনো বলেননি। তার এই সাক্ষাতকারে পাওয়া যাবে- অনেক অজানা কথা। ঠিকানার পাঠকদের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নায়িকা ববিতার এ সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো।
ঠিকানা: চলচ্চিত্র জগতে আসলেন কিভাবে? জীবনের প্রথম ছবির নাম কী? নায়ক- পরিচালক কারা ছিলেন?
ববিতা: আমার প্রথম ছবি ছিলো শ্রদ্ধেয় জহির রায়হান সাহেবের সংসার ছবিটি। আমি তখন টিনএজ মেয়ে। আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। সুচন্দা আপার সাথে শ্যুটিং এ যেতাম দেখতে। শুটিং দেখে আমার কাছে মনে হতো এটা খুব কষ্টের কাজ। আমি কখনো সিনেমায় অভিনয় করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না। আমার মা বেগম জাহানারা ছিলেন পেশায় ডাক্তার। আমার ডাক্তার হবার খুব ইচ্ছে ছিলো। আমি মার সাথে থেকে থেকে হাল্কা- পাতলা কাজ করেছি এ্যাসিসটেন্ট হিসাবে। মা পাড়া- প্রতিবেশীদের বিনা পয়সায় দেখতেন এবং ওষুধও দিতেন। মার ডাক্তার হবার পিছনে ঘটনা আছে। আমার এক বোন, নাম ছিলো ঝিলি। বয়স ছিলো মাত্র চার বছর। আমরা গ্রামে থাকতাম, গ্রামে তখন ডাক্তার ছিলো না। আমার বোনটি মারা যাবার পরে মায়ের মধ্যে একটা জিদ চাপে। তিনি কলকাতার লেডি ব্রামণ কলেজে পড়েছেন। আর বাবা ইসলামিয়া কলেজে পড়েছেন। মা যখন কলাকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসতেন তখন গ্রামের লোকজন দেখতে আসতেন। কারণ একটি মুসলিম পরিবারের মেয়ে কলাকাতায় গিয়ে লেখাপড়া করছে এটাতো বিরাট বিষয়। শেষ পর্যন্ত মা জিদ ধরে পড়াশুনা করলেন, পরীক্ষা দিলেন, পাশ করলেন, ডাক্তার হলেন। আমার মা সারা জীবন সংস্কৃতি মনা ছিলেন। যশোরের আয়শা সর্দারসহ অন্যান্যদের সাথে অনুষ্ঠানে যেতেন, তাদের সাহায্য- সহযোগিতা করতেন। আমার ইচ্ছে ছিলো আমি মায়ের মত ডাক্তার হবো। কিন্তু জহির ভাই-এর কারণে হয়নি। এরিমধ্যে জহির ভাই সুচন্দা আপাকে বিয়ে করলেন, আমাদের দুলা ভাই হয়ে গেলেন। তিনিই আমাকে বললেন- তুমি আমার সিনেমায় অভিনয় কর। আমার সিনেমায় একটি টিনএজ মেয়ের চরিত্র আছে, তোমাকে অভিনয় করতে হবে। আমি তাকে বলেছিলাম- আমি সিনেমা- টিনেমা করবো না, আমি ডাক্তার হবো। তিনি আমাকে বললেন, ঠিক আছে, তুমি একটা সিনেমা কর, তারপর আর করো না। যে কারণে আমি ছবিটি করি। ঐ ছবিতে রাজ্জাক ভাই ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার বাবার চরিত্রে আর সুচন্দা আপা হয়েছিলেন মা চরিত্রে। আমি জহির ভাইকে বলেছিলাম এটাই আমার প্রথম, এটাই আমার শেষ। ছবিটি করা হলো কিন্তু তেমন ব্যবসা হলো না, গল্পটায় মনে হয় প্রবলেম ছিলো। আবার বছর দুয়েক পরে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন আরেকটি সিনেমা বানাবেন। ঐ ছবির জন্য অভিনেত্রী ঠিক করেছিলেন পাকিস্তানের শবনম আপাকে। শবনম আপা সিডিউল দিতে পারছিলেন না। তিনি ছিলেন খুবই ব্যস্ত। নায়ক ছিলেন পাকিস্তানের নাদিম। ছবির নাম ছিলো জ্বলতে সুরজকে নিচে। উর্দু ছবি। আর এই ছবির প্রোডিউসার ছিলেন বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আফজাল চৌধুরী। সিদ্ধান্ত ছিলো জহির ভাই এই ছবির শ্যুটিং করবেন তৎকালীন ওয়েস্ট পাকিস্তানে গিয়ে। সাবিহা, সন্তোষ, রোজিরা- এই সব নামকরা শিল্পীরা অভিনয় করবেন। শবনম আপা কিছুতেই সিডিউল দিতে পারছিলেন না। তখন একদিন আফজাল চৌধুরী জহির ভাইকে বললেন- তুমি নায়িকা শবনবকে কেন নিতে চাচ্ছ, তোমার ঘরেই তো নায়িকা আছে। জহির ভাই প্রশ্ন করলেন- কী রকম? আফজাল চৌধুরী বললেন- তোমার শালিকা। ওতো ভেরী ফটোজেনিক। ওতো টেলিভিশনের একটা নাটক করেছিলো ’একটি কলম’ নামে। ঐ নাটকটি দেখার পর অনেকেই আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন। আফজাল চৌধুরী বললেন- আমি নাটকটি দেখেছি, আমার কাছে ওকে ফটোজেনিক মনে হয়েছে। তুমি ওকে একবার ট্রাই কর নায়িকার জন্য। জহির ভাই বললেন, আমিতো বিষয়টা ভেবে দেখেনি। তারপর আমার ক্যামেরা টেস্ট, ফটো, ভয়েস টেস্ট হলো। তখন কালারে ছবি তোলা হলো। ফটো দেখে তারা বললেন চেহারাতো খুবই ভাল, ভেরী সুইট। তারা আমাকে নায়িকা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন থেকেই নায়িকা হিসাবে আমার যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যোর বিষয় হলো ছবিটির কাজ শেষ হলো না, যে কারণে ছবিটি মুক্তি পেল না। এরমধ্যে জহির ভাই একটি বাংলা ছবি নির্মাণের কাজ শুরু করলেন। ছবিটির নাম ছিলো ’শেষ পর্যন্ত’। এই ছবির নায়ক হিসাবে নেয়া হলো রাজ্জাক ভাইকে এবং নায়িকা হিসাবে আমাকে। সেই ছবিটি সুপার-ডুপার হিট হয়ে গেল। এরপর থেকে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখনও আমি বলেছিলাম এটাই আমার প্রথম, এটাই আমার শেষ। কিন্তু ছবিটি রিলিজ হয়েছিলো ১৪ আগস্ট ১৯৬৯ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে। এই ছবিটি একদিকে মুক্তি পেল অন্যদিকে আমি আমার মাকে হারালাম। ঘটনাটি আমি বলতে চাই- ছবিটি যেদিন রিলিজ হচ্ছে তার আগে আমি ১২ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছি। তা দিয়ে আমি একটি নতুন টয়োটা গাড়ি কিনেছি। আমি গাড়িটি আমার মাকে দেখাবো এবং বলবো- মা দেখ, এটা আমার প্রথম ইনকাম। তুমি আমার গাড়িটা দেখ। আমার মা ছিলেন হাসপাতালে। মার হার্টের সমস্যা ছিলো। আমার ইচ্ছে ছিলো হাসপাতালের জানালা দিয়ে মাকে গাড়িটা দেখাবো। ১৪ আগষ্ট ছবি মুক্তির দিন আমি, সুচন্দা আপা, জহির ভাই, রাজ্জাকভাইসহ আমরা হাসপাতালে যাবো। রাজ্জাক ভাই ছিলেন আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মত। যেহেতু জহির রায়হান তাকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে এসেছেন। আমাদের সুখে- দু:খে উনিও আমাদের সঙ্গে থাকেন। কথা ছিলো মাকে দেখতে সাবাই হাসপাতালে যাবো এবং সেখান থেকে সবাই আমার গাড়িতে করে বেড়াতে যাবো। আমি হাসপাতালে এসে দরজাটা খুলে শুধু একটা পা রেখেছি- এরমধ্যেই হাসপাতালের একটি ছেলে দৌড় দিয়ে এসে আমাকে বললেন- তাড়াতাড়ি আসেন, তাড়াতাড়ি আসেন, আপনার আম্মা এক্ষুনি মরে গেছেন। এ কথা শুনার পর আমি সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। এই একটা দু:খের ব্যাপার আমার জীবনে যা আমি কখনো ভুলতে পারি না। আমার মা গাড়িটা দেখে যেতে পারেন নি, আমিও তাকে পাইনি। এই ছবি রিলিজ হবার পর সারা দেশে ববিতা ক্রেজ হয়ে গেল। সব টিনএজ ছেলেমেয়েদের পছন্দের নায়িকা হয়ে গেলাম আমি। আমি যে বলেছিলাম এটাই আমার প্রথম এটাই আমার শেষ- এই কথাটি আর টিকলো না।
ঠিকানা: প্রথম ক্যামেরার সামনে দঁড়ানোর অনুভূতি কী? প্রথম ছবির স্মরণীয় কোন ঘটনা যা এখনো আপনার স্মৃতিতে নড়াচড়া করে?
ববিতা: অনুভূতিটা হলো- এর আগে যখন অভিনয় করেছি তখন রাজ্জাক ভাই তো আমার বাবার চরিত্রে ছিলেন। আর এখন আমি কাজ করছি ছবিতে বাচ্চা একটা মেয়ে সে তার প্রেমিককে চিন্তা করছে, চিন্তা করে সে নিজে নিজে পাখায় বাতাস করছে, নিজে নিজে কল্পনা করছে, চিঠি লিখছে, নায়ক তাকে এমব্রেস করছে- যে মুহূর্তে রাজ্জাক ভাই আমাকে এমব্রেস করছে সেই মুহূর্তে আমি চিন্তা করছি- ও মাই গড। কয়েক দিন আগে শ্যুটিং করেছি তাকে বাবা ডেকেছি, এখন তিনি আমার প্রেমিক- হাউ ইট ইজ পসিবল? এখন এইগুলো মনে হলে প্রচন্ড হাসি পায়। তখন মনে করতাম সিনেমায় মনে হয় সব কিছু সম্ভব। এক ছবিতে যাকে আমি বাবা ডাকলাম- এখন সে আমার প্রেমিক! আমি একটু আনইজি ফিল করছিলাম। কেমন যেন শর্ট দিতে পারছিলাম না। এই অবস্থায় জহির ভাই আমাকে খুব ধমক দিলেন এবং বললেন- বোকা মেয়ে এটা কী সত্যি নাকি, এটাতো অভিনয়। অভিনয় করো। তুমি তোমার অভিনয় যত সুন্দর করে ফোটাবে, সবাই তোমার অভিনয়ের প্রশংসা করবে। মিষ্টি করে হাসতে হাসতে বললেন, জহির ভাই- এর বকাটকা খেয়ে ঠিক হলাম।
ঠিকানা: এ পর্যন্ত কতটা ছবি করেছেন? সবশেষ ছবি নায়িকা হিসাবে কোনটা এবং চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে কোনটা?
ববিতা: প্রায় পৌণে তিন শ’র মত হবে। এর মধ্যে আড়াই শ’ হবে একক নায়িকা হিসাবে। আর অন্য ছবিগুলোর মধ্যে আমি ছিলাম গল্পের নায়িকা। এমনকি আমি যদি আরো ১৫-২০ বছর বেচে থাকি, আমি যদি বুড়ি চরিত্রেও অভিনয় করি- তাহলেও বলবো আমি নায়িকা। যদি গল্পটা আমাকে কেন্দ্র করে হয়। আমি বরাবরই বাছাই করে ছবি করতাম, এখনো বাছাই করে ছবি করি। আমি সব ছবি করতাম না, যে ছবিতে অভিনয় করে আমার কিছু করার থাকতো, ভাল অভিনয় করতে পারবো, হাত তালি পাবো, বিদেশে ফেস্টিভলে যেতে পারবো- সেই সব ছবিতে অভিনয় করতাম। আমি যে আমার অভিনয় জীবনে ভাল ভাল চরিত্রগুলো পেয়েছি- এর জন্য আমার অবদান ছিলো। হয়ত এই চরিত্র অন্য কারো কাছে গিয়েছে, তারা বড় পারিশ্রমিক চেয়েছে কিন্তু আমি যাচাই করেছি চরিত্রটি বা পরিচালককে। যেমন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক শেখ নেয়ামত আলী। তিনি সামাজিক ছবি তৈরী করেন। তার কাছ থেকে হয়ত আমি আমার পরিশ্রমিক চাইনি। আমি হয়ত তাকে বলে দিয়েছি আমি আপনার ছবিটি বিনা পারিশ্রমিকে করে দেবো। কারণ আমি জানি, এই ছবিটি করতে পারলে আমার অনেক সুনাম হবে। কার্ললোভ ফেস্টিভলে গিয়ে ছবিটি পুরস্কার পেয়েছে। আমি অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। সুভাষ দত্ত ভাল ছবি বানাবেন। যেমন বসুন্ধরা, ২৩ নম্বর তৈল চিত্র, ডমুরের ফুল। আমি জানি তিনি আমাকে পারিশ্রমিক দিতে পারবেন না। আমি তাকে বলেছি- দাদা আমাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে না। বরং আমি উল্টো শুভেচ্ছাস্বরূপ একটি নেগেটিভ উপহার দিতাম। এই জিনিসগুলো আমার মধ্যে ছিলো বলে আমি ভাল ছবিগুলো করতে পেরেছিলাম। এটা আমার জন্য বিরাট ব্যাপার। টাকা তো যে কোন সময় ফুরিয়ে যায় কিন্তু আমি যে সুনাম অর্জন করেছি তাতো হারিয়ে যাবে না। যে কারণে আজকে আমার ঘরে দেশী ও আন্তর্জাতিকভাবে সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০টি এওয়ার্ড রয়েছে।
ঠিকানা: জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন কি?
ববিতা: দেশ স্বাধীনের পর থেকে পর পর তিন বার। আমি হ্যাট্রিক করেছি জাতীয় পুরস্কারের ক্ষেত্রে। এর পর আরো তিন বার পেয়েছি।
ঠিকানা: আপনারা তিন বোনই সিনেমা জগতে এবং তিন জনই দর্শকদের ভালাবাসায় ধন্য হয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। কী করে এলেন তিন বোন সিনেমায় এবং এমন সাফল্য অর্জনের পেছরে রহস্য কী? আপনার অভিনয়ে অন্য কোন নায়িকার প্রভাব আছে কি?
ববিতা: সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- সুচন্দা আপার সময়ে তিনি ছিলেন সবার শীর্ষে। আমার সময়ে আমি শীর্ষে। চম্পার সময়েও সে ভাল করেছে। গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝি, ঢাকায়ও ভাল ছবি করেছে। আমি নিশান, লাইলী মজনু, নাগনাগিনীসহ বহু বাণিজ্যিক ছবিও করেছি। তবে সেই সময় প্রচলিত ছিলো ভাল ছবি মানেই ববিতা। আমাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা ছিলো না। যে দেখে সেই বলে একই বৃন্তে তিন ফুল। তিন বোনের মধ্যে এত মিল কী করে সম্ভব? আমার একটা কথা মনে হয় বাবা- মার শিক্ষাই সব চেয়ে বড় শিক্ষা। বাবা-মা একটা জিনিস বলে দিয়েছেন- দেখ তোমরা ভাই- বোন মিলে মিশে থাকবে। কেউ কারো প্রতি জেলাস হবে না। একজনের বিপদে সবাই এগিয়ে আসবে, তাকে সব ধরনের সাহায্য করবে। বাবা- মা অল্প বয়স থেকেই এই বিষয়গুলো মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যার জন্য আমরা একজন আরেক জনকে সহযোগিতা করেছি। সুচন্দা আপা সব সময় আমাকে বলতেন আমি কী পারবো, কীভাবে অভিনয় করবো। আপা আমাকে শিখিয়ে দিতেন। চম্পার সময় সে আমার কাছ থেকে বুদ্ধি নিতো। আমি তাকে বলতাম কোন চরিত্র ভাল হবে, কোন চরিত্র ভাল হবে না। আমি কোন নায়িকার দ্বারা প্রভাবিত হইনি। ছোট বেলা থেকে আমার যে জিনিসটি হতো সেটি হলো অহরহ মানুষের সাথে আমার পরিচয় হতো। আমি হয়ত রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি একটা মেথরাণী সকাল বেলায় রাস্তায় ঝাড়ণ্ড দিচ্ছে। আমি তখন ভাবতাম কোন সিনেমায় যদি আমি মেথরাণীর চরিত্র পাই, তাহলে ও যেভাবে ঝাড়ণ্ড দিচ্ছে সেইভাবে ঝাড়ণ্ড দিবো, তাকে আমি দেখে রাখতাম সে কীভাবে কোন ভঙ্গিতে ঝাড়ণ্ড দিচ্ছে। সে মাথায় একটা ফুল দিয়েছে, একটা বিড়ি টানছে, বড় বড় বালি পড়া, শাড়িটা উপরের দিকে টেনে পড়েছে, সে কীভাবে কথা বলছে- গাড়ির মধ্যে বসে বসে ফলো করতাম। অনেক মানুষের সাথে আমি পরিচিত হতাম। এর মধ্যে যাদের আচার- আচরণ একটু ভিন্ন হতো তা আমি ভালভাবে ফলো করতাম। যেমন এক শিক্ষকের অভিব্যক্তিটা কী রকম, একজন প্রফেসার কি রকম পার্সোনালিটি নিয়ে কথা বলেন, একজন ডাক্তার কীভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন- এইগুলো আমি দেখতাম এবং মাথায় রেখে দিতাম। তারপর যখন ঐ চরত্রিগুলো পেতাম, তখন ঠিক সেইভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। এটা আমার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হতো এবং খুব ভাল লাগতো। আমি মনে করি এটা আমাকে খুবই সাহায্য করেছে অভিনয় জগতে। আমাদের তো কোন অভিনয় শিখার মতো প্রতিষ্ঠান নেই। যা ভারতসহ অনেক দেশে আছে। আমার যা তা ছিলো সম্পূর্ণ আল্লাহ প্রদত্ত। তা ছাড়া আমিতো বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যেতাম এবং অসংখ্য ছবি দেখতাম। কারণ দেখতে দেখতে তো মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারে। সেটা আমার অনেক উপকারে এসেছে।
ঠিকানা: আপনি আপনার সময়ে প্রায় সব পরিচালক এবং সব নায়কের সঙ্গেই কাজ করেছেন। আপনাকে একজন পুরিপূর্ণ এবং সফল নায়িকা করে তোলার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন? কোন নায়কের সঙ্গে কাজ করে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন?
ববিতা: আমাদের সবাই কিন্তু গুণী। আমি বলতে পারবো না রাজ্জাক ভাই গুণী। বুলবুল আহমেদ, মাসুদ পারভেজ, গ্রামের ছবির জন্য ফারুক, রোমান্টিক ছবির জাফর ইকবাল, ভারতের সৌমিত্র দা- সবার সাথেই আমি কাজ করেছি এবং তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। সেই জন্য বলবো সবাই ভাল। কেউ হয়ত এ্যাকশন হিরো, কেউ হয়ত গ্রামের চরিত্রে, কেউ শহুরে চরিত্রে। আমি এক সময় জাফর ইকবালের সাথে রোমান্টিক ছবিতে আমি অভিনয় করেছি। দর্শকরা আমাদের জুটিকে ভিশন লাইক করতো।
ঠিকানা: অনেকেতো বলেতেন জাফর ইকবাল এবং আপনার মধ্যে প্রেম ছিলো।
ববিতা: (কোন রাখডাক না করেই হাসতে হাসতে বললেন)- প্রেম একটু হয়েছিলো বৈকি। এটা মিথ্যা না এবং না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আমরাতো সবাই হিউম্যান বিং কেন হবে না। এক সাথে কাজ করেছি। হি ওয়াজ ভেরী হ্যান্ডসাম। গুড লুকিং। এ রকম হিরো আর বাংলাদেশে হয়নি- এটা সত্য। তার উপরে সে সুন্দর গান গাইতো। আমার মনে আছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন বেঁচে ছিলেন তখন আমাদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। অনুষ্ঠানের সময় গানবাজনা হতো। জাফর ইকবাল ইংরেজিতে গান করতেন। আমাকে আবার শ্যুটিং- এর অবসরে গানটান শিখিয়ে দিতেন। আমিও শিখতাম। অনুষ্ঠানের সময় অনুরোধ আসতো- ববিতা- জাফর গান গাও। তখন আমরা একত্রে গান গাইতাম। সবাই খুব প্রশংসা করতো।
ঠিকানা: অভিনয় করতে গিয়ে কোন প্রেম হয়নি?
ববিতা: আমার জীবনে প্রেম হয়েছে। এখন তো বয়স হয়েছে তাই বলতে তেমন খারাপ লাগে না। জাফর ইকবালের সাথে ভাল একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো। ইকবাল দেখতে ভাল কিন্তু সে কখনো তার জীবন নিয়ে সিরিয়াস ছিলো না। এটাই ছিলো তার একমাত্র সমস্যা। সে মারা গেছে- এইগুলো এভাবে না বলে আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। সে যদি তার জীবন নিয়ে সিরিয়াস হতো তাহলে সে অনেক উপরে উঠে যেত। তার এই জিনিসটি আমার পছন্দ ছিলো না। এর জন্য আমি আমার বাবার কাছে বকাঝকা খেতাম। আমার বাবা বলতেন- দেখ যে ছেলেটি তার প্রফেশনে সিরিয়াস নয়, সে তোমার স্বামী হতে পারে না। সে কখনো একজন ভাল পিতা হতে পারবে না। বন্ধুত্ব বলতে জাফর ইকবালের সাথেই আমার ছিলো। তারপরেতো আমার বিয়ে হয়ে গেল, ইকবালেরও বিয়ে হয়েছিলো সোনিয়ার সাথে। সে আমার অনেক আগেই বিয়ে করেছে।
ঠিকানা: আপনাকে বলা হয় আন্তর্জাতিকখ্যাতি সম্পন্ন অভিনেত্রী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আপনার স্বীকৃতি এবং অর্জনও রয়েছে। আপনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বও করেছেন। সে সব নিয়ে কিছু বলবেন কি?
ববিতা: বিশ্ব বরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে, অশনি সংকেত ছবিতে অভিনয় করে- যারা চলচ্চিত্রপ্রেমি, যারা চলচ্চিত্র বানায় বা পরিচালনা করেন তাদের কাছে আমি বেশ একটা পরিচিতি লাভ করলাম। তাও আবার অল্প বয়সে। এটা আমার জন্য বিরাট ব্যাপার। ঐ চরিত্রটি ছিলো অনঙ্গ বউ-এর। ঐ ছবি করে ভারতে বিজ্ঞান ভবন, বাংলাদেশ প্রচার সমিতি, বেঙ্গল ফিল্ম সাংবাদিক এসোসিয়েশন থেকে পুরস্কার পেলাম। সে বছর ভারতে আমি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলাম আর সঞ্জিব কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছিলেন। সেখান থেকেই আমার শুরু। তাছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমার একটা পরিচিতি হয়ে গেল। সবাই বলতে লাগলো আমি সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়িকা। এর ফলে নেপলস, এ্যাভিলিনো, তাসখান্দ, যুগোশ্লাভিয়া, নিউরিয়েলিজম আন্তর্জাতিক ফেস্টিভলগুলো থেকে আমার আমন্ত্রণ আসা শুরু হলো। মস্কোতে আমি যখনই গিয়েছি সবাই আমাকে বলতো- এই হলো সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা। আমার খুব সুনাম করতো। বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা আমার কাছে আসতেন ইন্টারভিউ নিতে, আর ভক্তরা অটোগ্রাফ নিতেন, সাথে ছবি তুলতেন। এখানে সোভিয়েট ইউনিয়নের কথা বলতে চাই- আর সেটি হলো- আমার অসংখ্য ছবি সেখানে মুক্তি পেয়েছে। আমি সিনেমা হলে ঢুকে দেখতাম- ববিতা কি সুন্দর রাশিয়ান ভাষায় কথা বলছেন। ছবিগুলো সিনেমা হলে চলতে চলতে- সেখানে আমার একটা পরিচিতি হয়ে গেল। সেখানে ভারতের রাজকাপুর দারুণভাবে বিখ্যাত। তার নামে পরিষদও ছিলো। সেখানে আমি বার বার যাচ্ছি- আমাকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে- আমি নাকি সব চেয়ে ইয়ং অভিনেত্রী। আমাকে খেতাব দেয়া হয়েছিলো- সি ইজ দি ডার্লিং অব আওয়ার ফেস্টিভল। প্রত্যেক ফেস্টিভলে আমাকে খুব সম্মান দেয়া হতো এবং নিয়ম অনুযায়ী সরকারিভাবে দাওয়াতনামা না পাঠিয়ে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নিমন্ত্রণ পাঠানো হতো। সবচেয়ে বড় কথা- আমাকে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জুরি বোর্ডের মেম্বারও করা হয়েছিলো। যদিও আমি পারিবারিক ঝামেলার কারণে সেই সময় যেতে পারিনি। এইগুলো আমার জীবনের সব চেয়ে বড় পাওয়া। তাসখন্দে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মরহুম শ্রদ্ধেয় আলমগীর কবির একবার গিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন- ওরে বাবা আমাদের ববিতা এখানে এত পপুলার? রাজকাপুরের মত ববিতা নামে নয়টা ব্লক রয়েছে। যেখানে রয়েছে তার ছবি। তখন আমার মনে হতো আমি কি বাংলাদেশে বেশি পপুলার, না সোভিয়েট ইউনিয়নে বেশি পপুলার? এছাড়াও আমি কালুভারবারীতে গিয়েছি, সত্যজিং রায়ের সাথে বার্লিন ফেস্টিভলে, যুগো াভিয়া, কায়রো, দিল্লিসহ বিভিন্ন ফেস্টিভলে গিয়েছি।
ঠিকানা: সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে আপনার মূল্যায়নটা কি?
ববিতা: ওরে বাবা! উনি একজন বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক। উনার সাথে আমি যখন কাজ করেছি, তখনতো আমার বয়স খুবই কম ছিলো। আমি তখন বুঝে উঠতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে আমি উনাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং উনার যে কাজের স্টাইল- এগুলো ভাবাই যায় না, অকল্পনীয়। উনিতো সব কিছু নিজে করতেন। ক্যামেরা নিজে চালাতেন, এডিটিং নিজে করতেন, মিউজিক নিজে করতেন, কোন শর্ট কীভাবে হবে সব কিছুই তার স্ক্রিপ্টের মধ্যে লিখে রাখতেন। উনি খুব সুন্দরভাবে কাজ আদায় করতেন। বাংলাদেশেতো রোদ দেখলে শ্যুটিং শুরু হোত আর উনি অপেক্ষা করতেন কখন মেঘের ভিতরে সূর্যটা ঢুকবে সে জন্য। উনার কাজ ছিলো অন্য সবার চেয়ে উল্টো। ছবি শেষ হবার পর উনার সাথে বার্লিন ফেস্টিভলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে একটা সংঘাতিক ইমোশনাল ঘটনা ঘটলো। সেটা হলো- ছবিটি শেষ হয়ে যাবার পর সত্যজিৎ রায় আমাকে ফোন করলেন এবং বললেন- ববিতা তুমি কি বার্লিন ফেস্টিভলে যেতে চাও? আমি উনাকে সাথে সাথেই বললাম- দাদা এটাতো আমার ভাগ্য, আপনার সাথে ফেস্টিভলে যাওয়া। তার সাথে আমি গেলাম। সাথে ছিলেন সৌমিত্র রায়, সন্ধ্যা রায়। আমরা সবাই এক সাথে গেলাম। তখনও জামার্নি বিভক্ত হয়নি। আমরা প্রথমে ফ্রাঙ্কফুট এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট দেখে বললেন- আমাকে এন্ট্রি পারমিট দেয়া যাবে না। সত্যজিৎ রায় বললেন কেন? তার উত্তরে অফিসার বললেন- সে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ক্যারি করছে, আমরা এখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিইনি। ঘটনাটা দেশ স্বাধীনের পরপরই। তারপরে আমি তো হাউ মাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। সত্যজিৎ রায়ের মত এত বড় ব্যক্তির সাথে আমি ফেস্টিভলে যেতে পারবো না? এর পর সত্যজিৎ রায় আমাকে বললেন- তুমি কেঁদ না, দেখি আমি কি করতে পারি। উনি জার্মান ভাষায় আয়োজকদের সাথে কী কী কথা বললেন, আমি সব বুঝি নি। তবে যেটুকু বুঝেছি সেটি হলে সে আমার ছবির নায়িকা, তাছাড়া শিল্পীর কোন দেশ কাল পাত্র থাকতে পারে না। অনেক কথাবার্তা বলার পরে তারা আমাকে ঢুকতে দিলো। তা এক মাত্র সম্ভব হয়েছিলো সত্যজিৎ রায়ের কারণেই। বার্লিন ফেস্টিভলে আমরা গোল্ডেনবিয়ার পুরস্কার পেলাম।
ঠিকানা: অভিনয় ক্ষেত্রে কোন গুণটিকে আপনি প্রধান এবং এক নম্বর বলে মনে করেন? এবং অভিনয়ের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু জরুরী বলে আপনি মনে করেন?
ববিতা: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সবারই থাকা উচিত। শিক্ষা ছাড়া কোন দিন চলে না। তবে সেই সাথে তাকে ফটোজেনিক হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় সামনা সামনি অনেক ভাল লাগে কিন্তু ক্যামেরায় ফটোজেনিক না, তাহলে হবে না। ফটোজেনিক ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হয় গডগিফটেড। তারপরে সবার শিখার আগ্রহ থাকা উচিত। তবে প্রাউডনেস থাকা উচিত নয়। এটা ভাল জিনিস নয়, ফালতু জিনিস। শিল্পী হতে হলে বিনয়ী হতে হবে এবং আমি সব জান্তা, শিখে গেছি- এই মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। মানুষের শিখারতো কোন শেষ নেই। শিখার সাথে বয়সের কোন সম্পর্ক নেই। সব বয়সেই সবার কিছু না কিছু শিখার আছে।
ঠিকানা: বাংলাদেশে অভিনয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য তেমন মানসম্পন্ন কোন প্রতিষ্ঠান আছে কি?
ববিতা: না, বাংলাদেশে অভিনয় শিখার কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
ঠিকানা: আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে, অনন্তপ্রেম, পিচ ঢালা পথ, সুর্যদীঘল বাড়ি, নয়নমনি ছবির অভিজ্ঞতা একটু বলবেন কি?
ববিতা: এই ছবিগুলোতো মিরাকল। অনন্তপ্রেম ছবিটি এত সুন্দর যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন রাজ্জাক ভাই। এটা ছিলো খুব ফ্যান্টাস্টিক। ছবিটি করতে গিয়ে আমার খুব ভাল লেগেছে এবং বাংলাদেশে যে এত সুন্দর সুন্দর লোকেশন আছে তা এই ছবি করতে গিয়ে আমি জেনেছি। এই ছবিটির শ্যুটিং করতে আমরা কাপ্তাই এবং বান্দরবন যাই। তখন আর্মিরা আমাদের বলেছিলো আপনারা বেশি ভিতরে যেতে পারবেন না। কারণ এটা বিপদজনক। বেশি ভিতরে গেলে আমরা আপনাদের সিকিউরিটি দিতে পারবো না। রাজ্জাক ভাই লোকেশন দেখে খুবই পছন্দ করলেন আর ক্যামেরাম্যানরা বলতে লাগলেন এর আগে এত সুন্দর লোকেশনে আর কোন ছবি হয়নি। রাজ্জাক ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন এখানে শ্যুটিং করতেই হবে। জায়গাটি ছিলো অনেক ভিতরে। পাহাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে শ্যুটিং স্পট। প্রতিদিন ড্রেসট্রেস পরে হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে আমি টায়ার্ড হয়ে যেতাম, টায়ার্ড হয়ে যাবার পরে শ্যুটিং করার মত মানসিকতা থাকতো না। তখন রাজ্জাক ভাই প্রোডাকশন হাউজকে বলেছিলো আমার জন্য ছোট্ট একটি পালকি বানাতে। আমি সেই পালকিতে করে শ্যুটিং স্পটে গিয়ে শ্যুটিং করতাম। আমার পালকি চড়া নিয়ে সবাই মজা করতো। এত সুন্দর লোকেশন এর আগে আমি কোথাও দেখিনি।
ঠিকানা: আপনার নামতো পপি। কিন্তু ববিতা হল কী করে?
ববিতা: পপি হচ্ছে আমার বাসার নিক নেম। এই নামে সবাই আমাকে ডাকতো। আর ববিতা নামটি দিয়েছেন জহির ভাই এবং আফজাল চৌধুরী। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো সুবর্ণা নামে। সংসার ছবিতে আমার নাম দেয়া হয়েছিলো সুবর্ণা। ছবিটি অবশ্য চলেনি। তাই নতুন নাম হলো ববিতা।
ঠিকানা: জহির রায়হান, খান আতা, সালাউদ্দিন, আমজাদ হোসেন, আলমগীর কবির, সুভাষ দত্ত, কবির আনোয়ার, চাষী নজরুলসহ আরো অনেক পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। সেই সঙ্গে রাজ্জাক, ফারুক, জাফর ইকবাল, আলমগীর, শওকত আকবর, বুলবুল, আনোয়ার হোসেন, গোলাম মোস্তফাসহ অসংখ্য নায়ক ও অভিনেতার সাথে অভিনয় করেছেন। পরিচালক এবং নায়ক হিসাবে কাকে আপনি বেশি নম্বর দিবেন?
ববিতা: আমি আগেই বলেছি। কাউকে আমি নম্বর দিতে পারবো না। যেমন আমার কাছে মনে হতো রাজ্জাক ভাই এক ধরনের, গ্রামের ছবি মানেই ফারুক, রোমান্টিক হিরো মানেই জাফর ইকবাল, সোহেল রানা একশন ছবির নায়ক, আলমগীর ড্রামাটাইপ ছবির নায়ক- একেক জন একেক দিকে গুণি। আর পরিচালকের ক্ষেত্রেও একই কথা। তারা আমার প্রিয় পরিচালক ছিলেন। জহির রায়হানের তো তুলনাই হয় না। তিনি যে কী তার বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ স্বয়ং সত্যজিৎ রায় তার প্রসংশা করতেন। উনার স্টপ জেনোসাইট প্রমাণ্য চিত্রগুলো দেখে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- কে এই জহির রায়হান। যে মারাত্মক ছবি বানাতে পারে। তার জীবন থেকে নেয়া ছবিটি তো অসাধারণ। একটা চাবির গোছার মধ্যে পুরো রাজনীতিটা- ঐ ছবিটি দেখে সত্যজিৎ দা বলেছিলেন- এত বড় পরিচালক বাংলাদেশে আছে? সেই জহির রায়হানের কথা কী বলবো! আজকে তো তিনি বেঁচে নেই। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন আমাদের চলচ্চিত্র জগত অন্য দিকে মোড় নিতো।
ঠিকানা: আপনি তাকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন কেন?
ববিতা: উনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন বলেই তাকে শ্রেষ্ঠ মনে করি। আমি যতদূর দেখেছি তাকে আমার শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। আমি তখন হয়ত ছোট ছিলাম কিন্তু পরবর্তীতেতো আমি তার ছবিগুলো দেখেছি। কাঁচের দেয়ালসহ অন্যান্য ছবিগুলো।
ঠিকানা: উনাকে মেরে ফেলার মধ্যে কি কোন রহস্য আছে?
ববিতা: এটা বলা খুব মুশকিল। তবে আমার যেটা মনে হয়- উনার দুই একটা বক্তব্য অন্য রকম ছিলো। উনার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার যখন হারিয়ে গেলেন তখন বিভিন্ন জন তাকে বলেছিলেন তোমার বড় ভাই বেঁচে আছে। তিনি মিরপুর এগার নম্বর সেকশনে আছেন। জহির ভাই তখন পাগলের মত একবার আজমির শরিফে দৌড়াচ্ছেন, আরেকবার অন্য জায়গায় দৌড়াচ্ছেন। এক সময় তাকে তার বড় ভাই এর কথা বলে নিয়ে যাওয়া হলো। নিয়ে যাওয়ার সময় বলা হলো- এ কথাটি তুমি কাউকে বলবে না। এমন কি তোমার মা- বউকেও বলবে না। যদি বল তাহলে তোমার ভাইকে ফেরৎ পাবে না। যে কারণে কাউকে তিনি কিছু বলেননি তার ভাই সম্পর্কে- শুধু বলেছিলেন আজকে তোমাদেরকে একটি সারপ্রাইজ দেবো রাতে। দোয়া কর, নামাজ পড়। নিয়ে যাবার সময় সঙ্গে একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। ঐ দিন রাতে ঐ ব্রিগেডিয়ারের আমাদের বাসায় ডিনারও খাবার কথা ছিলো। তারপরে ঐ ভদ্রলোক আমাদের ফোন করে জানালেন- সরি, আমি জহিরকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা এক সাথেই গিয়েছি। তিনি গাড়িটি রেখে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের দিকে গিয়েছেন।
ঠিকানা: আপনার সময় নায়িকাদের মধ্যে কার অভিনয় ভাল লাগতো?
ববিতা: আমাদের সময়ে নায়িকাদের মধ্যে সবাই ভাল ছিলেন। শাবানা আপা বাণিজ্যিক ছবি ভাল করতেন। কবরী আপা, সুচন্দা আপা আমাদের আগে ছিলেন। কবরী আপাতো পারিবারিক কারণে এক সময় দূরে সরে গেলেন। আমরা পরে এসেছি। আমি আর শাবানা আপা এক সঙ্গেই ছিলাম। উনি বাণিজ্যিক ছবি করতেন। আমিও বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি আর্ট ফিল্মগুলো করতাম। আমি ভাল ভাল চরিত্রগুলো পয়সা হোক বিনা পয়সায় হোক হাতছাড়া করতে চাইতাম না।
ঠিকানা: অভিনেত্রী হিসাবে শাবানাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ববিতা: কমার্শিয়ালী তিনি খুব ভাল শিল্পী। তারও জনপ্রিয়তা ছিলো, আমারও জনপ্রিয়তা ছিলো। উনি সাধারণ দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিলেন। সুভাস দত্ত আমার খুব প্রিয় পরিচালক। তার ডমুরের ফুল, বসুন্ধরাসহ অনেক ছবিতে আমি অভিনয় করিছি। খান আতাউর রহমানও ভাল, কাজী জহিরের ছবিতে অভিনয় করেছি। তার ধ্যান- ধারণাই ছিলো চলচ্চিত্র জগত কে নিয়ে। তার ছবি মানেই বিরাট ব্যাপার। মারাত্মক ছবি করেছেন, আর আমজাদ হোসেনের ছবিগুলোতো মাইল স্টোন। যার মধ্যে গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়ন মনি। বিশেষ করে গোলাপী এখন ট্রেনে ছবিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফেস্টিভলে প্রদর্শিত হয়েছে। এই ছবিটি মুক্তি পাবার পর সর্বত্রতো একটা কথা চালু হয়েগিয়েছিলো- ’গোলাপী একটা কিছু কও, গোলাপী একটা কিছু কও।’
ঠিকানা: গোলাপী এখন লন্ডন ছবিটির কি অবস্থা?
ববিতা: সেটা আমি জানি না। আমজাদ ভাই বহু বছর পর এটা হাতে নিয়েছিলেন। এই ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীসহ অন্যান্য শিল্পীদের নিয়েছেন। আমি অবশ্য নেই। ছবিটি অনেক বছর ধরে ঝুলে আছে। এখানো মুক্তি পাচ্ছে না, কবে পাবে তাও জানি না। তবে একটা সময়ে আমজাদ ভাইকে আমার মনে হয়েছে- উনি যেটাই করতেন ভাল কিছু করতেন। তার গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়ন মনি, কসাই, সুন্দরী- এই সব ছবিতে আমার চরিত্র ভাল ছিলো। উনি গল্পটাও ভাল করতে পারতেন।
ঠিকানা: বর্তমান চলচ্চিত্র ও অতীত চলচ্চিত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পান কি?
ববিতা: অবশ্যই খুঁজে পাই। ব্যবধানটা আকাশ- পাতাল। তখনকার ছবি, গল্প, গান সব কিছুই অন্যরকম ছিলো। এখনতো আমার অবাক লাগে পুরানো ছবিগুলো যখন টিভিতে দেখায়- তখন সব দর্শকই বলে আগে এত সুন্দর ছবি হতো? এখনকার ছবিতে কোন গল্প নেই। একটু পরে পরে নাচ হচ্ছে, ফাইট হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের পোশাকের বাহার দেখানো যাচ্ছে। গল্পতো সেরকম দেখি না।
ঠিকানা: আগেতো আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ হলে যেতেন ছবি দেখার জন্য, এখন দেখা যায় না। এর কারণ কী?
ববিতা: এর জন্য আমি কাউকে এককভাবে দোষ দেব না। অনেকগুলো ব্যাপারের পাশাপাশি সিকিউরিটির ব্যাপারটি আছে। আগে মা- বোনেরা রিক্সায় করে ছবি দেখতে যেতেন, হলে বসে দেখতেন- এখন সেই পরিবেশ নেই। তার উপরে বড় কথা হলো- আগে যে সব নামী দামী পরিচালক ছবির বানাতেন, তারা তো এখন নেই। আগের মত সুন্দর ছবিও হয় না। তারমাঝেও দু’চারটা ভাল ছবি কেউ কেউ বানাচ্ছেন। তার মধ্যে রয়েছেন তারেক মাসুদসহ কয়েকজন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে রিয়েল সিনেমা যাকে বলে- অর্থ দিয়ে সমস্ত ক্লাসের দর্শকদের ভাল ছবি বানিয়ে হলে নেবে, সেই ছবি কই? সেই সব পরিচালক কই। তাছাড়া সিনেমা হলের পরিবেশও নেই। হলের মধ্যে প্রচন্ড গরম, ছারপোকার উপদ্রপ। পাশাপাশি আপনি দেখেন বসুন্ধরায় ভাল সিনেমা হল তৈরী হয়েছে সেখানে কিন্তু মানুষ ছবি দেখতে যাচ্ছে। পরিবেশও আমাদের দেখতে হবে। হলে গিয়ে একটি ভাল ও ভদ্র পরিবারের লোকজন বসে সিনেমা দেখছে, পিছন থেকে লুঙ্গীপরা কেউ চেয়ারের উপরে পা তুলে বসে রয়েছে বা সিটি মারছে- তাহলে হবে কী করে? রাতের বেলায় সিনেমা দেখে বাসায় যাবে সেই নিরাপত্তা কই? সবার উপরে কথা হলো- যারা সিনেমা বানাচ্ছেন তারা কী বানাচ্ছেন, পয়সা খরচ করে ভাল ছবি না হলে মানুষ কেন হলে দেখতে যাবে?
ঠিকানা: অনেকেই অভিযোগ করেন ভারতীয় ছবিগুলো হলিউডের নকল করে ছবি বানাচ্ছে, আর আমাদের দেশের ফিল্ম মেকাররা বলিউডের ছবি নকল করে বানাচ্ছেন- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
ববিতা: এটা করে থাকে। বোম্বের অনেক ফিল্মমেকার ইংরেজী বা অন্য দেশের ছবি নকল করে ভেঙ্গেটেঙ্গে নিজেদের মত করে বানাচ্ছেন। যারা বিদেশী ছবি দেখেন তারা এটা ধরতে পারেন। আবার আমাদের ফিল্মমেকাররা বোম্বের নকল করে নিজেদের মত করে সাজিয়ে ছবি বানাচ্ছেন। আমি মনে করি প্রত্যেকেরই নিজস্বতা থাকা উচিত। তবে বাণিজ্যিক ছবিতে হয়ত কিছু গল্প মিলে যায়। পৃথিবীর সব গল্পতো হাতের মুঠোয়। সুতরাং মিলে যেতেই পারে। সেটা যদি দেখে সুন্দর করে তৈরী করতে পারে কেউ, তা খারাপ নয়। তারাতো নকলও ঠিক মত করতে পারে না। নকল করতে পারাটাও একটা বড় ব্যাপার।
ঠিকানা: অনেকেই মনে করেন আন্তর্জাতিক মান থেকে আমাদের সিনেমা অনেক পিছনে। সেক্ষেত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ টালিউডের সঙ্গে ঢালিউডের তুলনা করলে আমাদের অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়?
ববিতা: পশ্চিমবঙ্গেতো এক সময় ভাল ছবি হয়েছে। যেমন সুচিত্রা সেনা, উত্তর কুমারের সময়টা ছিলো গোল্ডেন টাইম। তখনতো ভাল ভাল ছবি হয়েছে। ওরাও ইদানিং বোম্বে মার্কা সিনেমা তৈরী করছে। তাদের ছবিতেও অশীৗল পোশাক ব্যবহার করা হচ্ছে। পুরো ভারত বর্ষ যেটা করেছে- তারা বিশ্বব্যাপী বাজার সৃষ্টি করতে পেরেছে। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বলিউডের নায়ক- নায়িকাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই সব কারণে তাদের ছবির মানও বৃদ্ধি পেয়েছে, মেকিং অনেক উন্নত। কিন্তু আমরা পৌঁছাতে পারছি না। কারণটা হলো ওদের বাজেট অনেক বেশি, আমাদের বাজেট অনেক কম। তাদের একটি গানে যে বাজেট থাকে, সেই বাজেট দিয়ে বাংলাদেশের একটি পুরো ছবি তৈরী করা যায়। সেইভাবে ছোট্ট একটি দেশ, ছোট্ট একটি মার্কেট নিয়ে তা করতে পারি না। সুতরাং ব্যবসাটা করবো কী করে? আমাদের ভাষাও লোকজন বুঝে না। আমি মনে করি ভাল ছবিগুলো বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং করা এবং বিভিন্ন ফেস্টিভলে পাঠানো উচিত।
ঠিকানা: আপনি কি বর্তমান কোন নায়িকার মধ্যে ববিতার ছায়া খুঁজে পান?
ববিতা: আমি বলবো যে এখনকার যেসব ছেলেমেয়েরা আছে তারা সবাই ট্যালেন্টেড। তারা ভাল অভিনয় করতে জানে। তবে তাদের কিছু কিছু জিনিস আমি অপছন্দ করি। সেটা হলো- আমার চেষ্টা থাকতে হবে- আমি অভিনয় করে বিরাট বা ভাল অভিনেতা হবো। সেটার চেয়ে তাদের কাছে মুখ্য হচ্ছে যেন অর্থ। অর্থটা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে অর্থ সব কিছু নয়- এই কথাটি মনে রাখা উচিত। আমি চলচ্চিত্র জগতে এসেই মনে করি- আমার বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স দরকার, তাহলেতো কেউ ভাল অভিনেতা হতে পারবে না বা বেশি দূর এগুতে পারবে না। আমাকে আগে অর্জন করতে হবে, একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে- তারপরে যেটা পাওয়ার সেটা অটোমেটিকলি আসবে। আরেকটা জিনিস যেটা ভাল লাগে না, সেটা হলো- দে আর নেভার সিরিয়াস। এখনো আমরা ক্যামেরার সামনে যাবার আগে চিন্তা করি কীভাবে আমি চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলবো। নিজে নিজে কয়েকবার স্ক্রিপ্ট পড়বো, কীভাবে অভিনয় করবো- চিন্তা করবো। কিন্তু এখন মনে হয়- উই আর সুপার স্টার, উই ডোন্ট বদার, উই ডোন্ট কেয়ার। হোয়াট এভার উই আর ডুয়িং, উই আর ডুয়িং দি বেস্ট। পরিচালক যদি আবার শর্ট নিতে বলেন তখন তারা বলেন, শর্ট ঠিক আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিচালককে তারা ডিকটেট করে। সবাই না। এর মধ্যে দু’চার জন ভাল আছেন। আমি সবাইকে বলবো না। তারপরেও আমি বলবো- দে আর ট্যালেন্টটেড। আমি যে রকম ভাল চরিত্রের জন্য ভাল ছবিগুলো করেছি বিনা পয়সায় বা অল্প পারিশ্রমিকে, তারা একটা ছবি করুক না বিনা পয়সায় তাহলেই আমি খুশি হবো। ওদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমরা যেরকম বড় বড় ও ভাল পরিচালকদের হাত ধরে এসেছি তারা সেই সুযোগ পায়নি।
ঠিকানা: বাণিজ্যিক এবং শর্ট ফিল্মের মধ্যে, আমাদের সমাজ বিচারে, সম্পর্কটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? এবং আপনি কি মনে করেন সমাজকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের সিনেমার চেয়ে নাটক বেশি আবদান রাখছে?
ববিতা: নাটক সবাই বাড়ি বসে দেখছে, মানুষ সিনেমা হলে কম যাচ্ছে- এটা ঠিক আছে, কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে- যে যাই বলুক সিনেমা একটা বিশাল ব্যাপার। বাড়িতে যেহেতু কিছু করার নেই, তাই সবাই বসে নাটক দেখছে, টিভি দেখেছে। সিনেমা সারা পৃথিবীর ভাষা বলছে, সারা পৃথিবীর পরিবেশ তুলে ধরছে- এটা বিশাল ব্যাপার। সিনেমা একেবারেই অন্যরকম। সিনেমার সাথে নাটকের তুলনা হয় না। মনের মত করে একটি সিনেমা বানাতে পারলে সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগানো বা আলোড়ন সৃষ্টি করা সম্ভব। নাটক দিয়ে তা সম্ভব নয়। সিনেমার মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক ব্যাপার আছে।
ঠিকানা: আপনি নাটক দেখেন?
ববিতা: আমি নাটক দেখি। আমার কাছে ভাল লাগে।
ঠিকানা: আপনারা ৩ বোন একটা ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেই ছবিটি ছিলো আপনার বড় বোন অভিনেত্রী সুচন্দার। এ সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন?
ববিতা: ঐ ছবিটির নাম ছিলো তিন কণ্যা। এই ছবিটি করা হয় সুচন্দা আপা যখন প্রডিউসার হলেন। আমার বাবার একটা ইচ্ছা ছিলো। তিনি বলতেন, তোমরা দুই বোন চলচ্চিত্র জগতে গিয়েছ, তোমাদের ছোট চম্পা বাদ থাকবে কেন? তোমরা তিন বোন মিলে একটা সিনেমা কর এবং সেই ছবিটি আমি দেখে যেতে চাই, সুচন্দা আপা আমাদের তিনি বোনকে নিয়ে গল্পটি সাজালেন। ছবিটি সুপার- ডুপার হিট হয়ে গেল।
ঠিকানা: একটি সমাজ গঠনে, তাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একজন অভিনেত্রী এবং একজন অভিনেতার ভূমিকা কতটুকু এবং কীভাবে তারা সেই ভূমিকা রাখতে পারেন?
ববিতা: সমাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে শিল্পীদের অনেক কিছু করণীয় আছে। আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখি দিলীপ কুমার, রাজ্জাক- এ ধরনের যেসব শিল্পী আছেন তারা যদি কোন কথা বলেন বা কো কাজ করেন তাহলে তা সমাজে এ্যাফেক্ট করে। তারা যদি এইডস সম্পর্কে, পলিও টিকা সম্পর্কে, এসিড সম্পর্কে বা যে কোন বিষয়ে কথা বলেন- তা তাদের ভক্তরা সাংঘাতিকভাবে লুফে নেন এবং তা করার কথা চিন্তা করেন। ভক্তরা শুধু তাদের পছন্দের শিল্পীদের পোশাক বা চুলের স্টাইল ফলো করে তা নয়। তারা তাদের শিল্পীদের কাজগুলোও আন্তরিকাতার সাথে করার চেষ্টা করেন।
ঠিকানা: আপনি কি কোন সামাজিক কাজের সাথে জড়িত আছেন?
ববিতা: আমি অনেক কিছু করেছি। বিশেষ করে এসিড নিক্ষেপ নিয়ে আমি কাজ করেছি। এ ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের কাজের সাথেও জড়িত আছি। আমার যতটুকু সময় আছে তা দিয়ে আমি কিছু করার চেষ্টা করছি।
ঠিকানা: আপনিতো সিনেমার সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড কি তার যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারে? যদি না পারে, তবে তার অন্তরায় কী?
ববিতা: আমি শুধু সেন্সর বোর্ডে নয়, আমি জুরি বোর্ডে ছিলাম, আমি ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ডে ছিলাম এবং আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডেও ছিলাম। আমি যখন ছিলাম তখন চেষ্টা করেছি ঐখানে বসে থেকে যতটুকু করা সম্ভব তা করার। অশ্লীল ছবিগুলো আমরা ব্যান্ড করেছি। ব্যান্ড করার কারণ ছিলো যাতে করে সে আগামীতে এই ধরনের ছবি বানাতে সাহস না পায়। ছবি মুক্তি না পেলেতো তার অর্থ ফেরত আসবে না। এর ফলে যারা ভাল ছবিতে আসেন বা চিন্তা করেন তারা আগ্রহ পান। এই সব করতে গিয়ে দেখা গেল আমি অনেকের শত্রু হয়ে গেলাম। আসাধু লোকজন আমাকে গালমন্দ করেছে, তিরস্কার করেছে। আমি মনে করেছি একটা ভাল কাজ করতে গিয়ে যদি গালমন্দ বা তিরস্কার সহ্য করি তাতে মন্দ কি? আমার কোন অসুবিধা নেই। কারণ আমিতো ভাল চাই। এখন এফডিসিতে গেলে আমার চোখ দিয়ে পানি আসে। আমাদের চোখের সামনে এফডিসি কি হয়ে গিয়েছে? আস্তে আস্তে সবাই আন্দোলন করে করে পুরো ব্যাপারটাকে আমরা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। বন্ধ হওয়াতে দুষ্টুু লোক যারা নোংরা ছবি বানাতেন তারা অনেক দূরে সরে গেছে এবং দর্শকরাও তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিছু দর্শক দেখতো বলেইতো তারা নোংরা ছবি বানাতো, দর্শকরা না দেখলেতো তারা বানাতো না।
ঠিকানা: এখনো অভিযোগ রয়েছে সেন্সর বোর্ড যেসব সিন ব্যান্ড করেছে কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের হলগুলোতে তারা সেই সব সিন আবার লাগিয়ে দিচ্ছে- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
ববিতা: সেন্সর বোর্ডের কাজ হলো ব্যান্ড করা। সেই কাজটি তারা করছে। তবে আগের মত ব্যান্ড করা কোন সিন এখন লাগাতে কেউ সাহস করেন না। দেখা গেল প্রয়াত মান্না এবং নায়িকা মৌসুমীর রোমান্টিক সিনটা কেটে দিয়ে সেখানে একটা নোংরা সিন ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটা কী সাংঘাতিক ব্যাপার? এখন তো আইন হয়েছে- যে হলে এই সব চালানো হচ্ছে সেই হলের মালিককে গ্রেফতার করা হবে। এখন সব কিছু মোটামুটি কন্ট্রোলের মধ্যে এসে গেছে। যে কারণে এখন ভাল ছবি হচ্ছে। আবার দর্শকরা হলে যাচ্ছে। যেমন দেখুন মনপুরা নামে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে- এই ছবিটি দেখার জন্য দর্শকরা হলে গিয়েছে এবং ছবিটিও ভাল চলেছে, অথচ এই ছবিতে তেমন কোন বিগ স্টারও নেই। নায়ক শাকিব খান সে যে ছবিতে থাকে সেই ছবি চলছে। তাকে এখন বোম্বের যে কোন সুপারস্টারের সাথে তুলনা করা যায়। বিকজ হি ইজ সো হ্যান্ডসাম, হি ইজ ডুয়িং ভেরী ওয়েল, ভেরী গুড এ্যাক্টিং। সে এখন একটি ছবির জন্য ৩০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক পায়- যেটা অতীতে রাজ্জাক ভাইও পাননি।
ঠিকানা: ভাল নায়িকা আপনার চোখে?
ববিতা: হাসতে হাসতে বললেন- এখন নায়কদের যুগ যাচ্ছে। এক সময় নায়িকাদের যুগও আসবে।
ঠিকানা: আপনার খ্যাতির পিছনে মিডিয়ার কি কোন ভূমিকা আছে?
ববিতা: অবশ্যই। আগেতো মিডিয়াতে সুন্দর করে চলচ্চিত্র জগতের খবর আসতো, সুন্দর সুন্দর ইন্টারভিউ ছাপা হতো। এমনও হয়েছে- দেখা গেলো হাই ভাই আমার উপরে একটা সুন্দর আর্টিকেল লিখেছেন, আমি সারা রাত জেগে জেগে সেটা পড়েছি। এখন কিন্তু অন্যরকম হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র নিয়ে পত্রিকাও কমে গিয়েছে এবং এখন গসিপটাই প্রাধান্য দেয়া হয়। আগেও গসিপ ছিলো কিন্তু সেই গসিপেরও একটা সৌন্দর্য ছিলো। লোকে পড়ে মজা পেল। জাফর ইকবাল ও ববিতাকে নিয়ে একটা সুন্দর আর্টিকেল লিখা হলো- ’ওরা দুজন আজকে হারিয়ে গেছে,’- মিষ্টি একটা গল্প তৈরী করা হতো। আমরাও কিছু মনে করতাম না, দর্শকরাও পড়ে মজা পেত, আনন্দ পেত, আমরাও আনন্দ পেতাম। রাজ্জাক- কবরিকে নিয়ে লিখা হয়েছে। সেইগুলোতো কোন ক্ষতি হয়নি। এখন তো যেটা দেখা যায়- একেবারে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে, এই পরিবর্তনটি আমার কাছে ভাল লাগেনি। আবার কোন ক্ষেত্রে দেখা গেল, যে শিল্পী ভাল করছে, তার বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে, আবার যাকে পছন্দ তার সম্পর্কে কলমের এক খোঁচায় লিখে দেয়া হলো সে বোম্বের শ্রীদেবী। এটাতো ঠিক না। আগে তাকে শিখতে দাও, তার অনেক শিখার আছে কিন্তু তা না করে উল্টোটা করা হচ্ছে। প্রথমে তাকে টাইম দিতে হবে। ঠিকানা: আপনি এবার নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত অষ্টম ঢালিউড ফিল্ম এন্ড মিউজিক এওয়ার্ডে লাইফ টাইম এচিভমেন্ট পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আপনার অনুভূতি কী? আর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়, সরকারি এবং বেসরকারি কী কী পুরস্কার অর্জন করেছেন? ববিতা: বাংলাদেশেও আমি বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছি। এখানে আমার খুব ভাল লেগেছে যে বিদেশের মাটিতে পুরস্কার পেয়েছি। আগে যখন আসতাম তখন নিউইয়র্কসহ অন্যান্য সিটিতে বাঙালি খুব কম দেখতাম, এখনতো জীবনের তাগিদে আটিলান্টিকের এপাড়ে বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে। আমরা দেশে থাকলেও তাদের কে আমি একান্তভাবে অনুভব করি। আমার খুব ভাল লাগে। আমি নেমেই ভাবি যেসব বাঙালির এখনো কাগজপত্র হয়নি কবে তাদের কাগজপত্র হবে, দেশে যেতে পারবে। এই চিন্তা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। শুনা যাচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা নাকি এবার বিষয়টির সুরাহা করবেন- যদি সুরাহা হয় তাহলে আমার মত খুশি কেউ হবে না। এর আগের বার যখন আমি এসেছিলাম তখন কংগ্রেসম্যান যোসেফ ক্রাউলির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার কাছে আরো ভাল লেগেছে যারা বাংলাদেশ থেকে এখানে চলে এসেছেন, তারা আমাকে ভুলে যাননি।
ঠিকানা: আপনি কি পরিচালনায় আসছেন?
ববিতা: আমি পরিচালনায় এখনো আসিনি, তবে ছবি প্রযোজনা করেছি। সাত আটটা ছবি করেছি। ছবিগুলো মোটামুটি ভালই চলেছে। শেষ ছবিটি ছিলো পোকা মাকড়ের ঘর বসতি। এই ছবিটি ১০/১২ টার মত ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছে। সেরা ছবি হিসাবেও আমি ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছিলাম। এই ছবিটিতে তেমন ব্যবসা হয়নি। ফলে আর্থিকভাবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হই। তার উপরে দেখলাম চলচ্চিত্র জগতে যে নোংরা ছবি ঢুকে গেছে, আমিসহ অনেকেই ভয় পেয়ে সিনেমা করা বন্ধ করে দিই। এমন কি অভিনয় করাও বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকতাম। এফডিসির ধারেকাছেও যেতাম না। ভয় লাগতো।
ঠিকানা: আপনার ছেলের কি এই জগতে আসার কোন সম্ভাবনা আছে?
ববিতা: আমার ছেলে অনিক ইসলামের অভিনয় জগতে আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ আমার ছেলেটা লেখাপড়ার দিকে সাংঘাতিক মনোযোগী। সে এখন কানাডায় লেখাপড়া করছে। নিউইয়র্ক থেকে আমি তার কাছেই যাচ্ছি। সেখানে চার মাস থাকবো।
ঠিকানা: আপনার অভিনয় জীবনে কোন চরিত্রটি করে আপনি সবচেয়ে বেশি সফল মনে করেছেন এবং আনন্দ পেয়েছেন?
ববিতা: যে কোন চ্যালেঞ্জিং চরিত্র আমার ভাল লাগতো। তবে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ হচ্ছে- কমেডি। কমেডি কেন আমার ভাল লাগে তা আমি জানি না। অধিকাংশ ছবিতে দেখা যায় কমিডিয়ান রা কমিডি করছেন- আমার প্রশ্ন হোয়াই নট হিরো অর হিরোইন? তারাও কমেডি করতে পারে। আমি মনে করি ইমোশনালী দর্শকদের ডায়লগ বলে বা অভিনয় করে কাঁদানো খুব সহজ কিন্তু মন থেকে হাসানো ( কাতুকুতু দিয়ে নয়) ভেরী টাফ। আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেকের জীবনটা কষ্টে জর্জরিত। হাসিটা আমাদের জীবনে পাওয়া যায় না। তাছাড়া আমি তো সব ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করেছি।
ঠিকানা: আপনি ঢালিউড এওয়ার্ডে বলেছেন আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু নেবার আছে, এখনো ফুরিয়ে যান নি- আমৃত্যু দিয়ে যাবেন- বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
ববিতা: আমার কথা ছিলো, লাইফটাইমের বিষয়টা দাঁড়ায় যে ববিতা জীবনে অনেক কিছু করেছে, আর করার কিছু নেই। সেই জন্যই আমি বলেছিলাম- এটা আমার শেষ নয়, এখান থেকে আমার আবার শুরু হলো। দর্শকরা যদি আমার অভিনয় দেখতে চায়, তাহলে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অভিনয় করে যাবো।
ঠিকানা: লাইফ টাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড গ্রহণ করার সময় রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার অংশ বিশেষ পাঠ করেছেন যার অর্থ ছিলো ’নিন্দ্রায় যাবার আগে আপনাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।’ এই অনেকটা পথ পাড়ি দেয়ার ভাবনা কি আপনার সিনেমা নিয়ে, না কি দেশ নিয়ে?
ববিতা: এটা সব কিছু নিয়ে(- বলেই হাসতে থাকলেন)।
ঠিকানা: মুক্তিযুদ্ধে আপনার বিশেষ কোন স্মৃতি বলবেন কি যা আজো আপনাকে বেদনার্ত বা উদ্বেলিত করে?
ববিতা: মুক্তিযুদ্ধের উপরে আমি একটা সিনেমা করেছিলাম অরুণোদয়ের অগ্নি সাক্ষী। ঐ ছবিতে শ্যুটিং করতে আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হবার পর পরই এই ছবিটি করা হয়। এই ছবিটিতে অভিনয় করে আমি প্রথম জাতীয় ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমার চরিত্র ছিলো একটি গ্রামের মেয়ের। আনোয়ার হোসেন এসেছেন শ্যুটিং করতে, আমি দেখতে গিয়েছি। পরবর্তীতে পাকিস্তানী আর্মিরা আমার চোখের সামনে আমার বাবা, মা, ভাই- বোনকে গুলি মেরে ফেললো। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে টর্চার করলো। তখন আমার পেটে অবৈধ সন্তান। সেসময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। উনি আমাদের হেলিকপ্টারসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। আমরা যেখানেই শ্যুটিং করতে গিয়েছি সেখানেই বিভিন্ন দেয়ালে ে াগান দেখেছি, কঙ্কাল দেখেছি। দেয়াল লিখনগুলোর মধ্যে ছিলো- একটু পরেই ওরা আমাকে নিয়ে টর্চার করবে, আমি চুল দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছি কিন্তু আল্লাহ আমাকে আত্মহত্যা করতে দিচ্ছে না- এই ধরনের অসংখ্য লেখা। এখানে শ্যুটিং করতে নিয়ে একটা ঘটনা ঘটালো আমাকে বলা হলো, তুমি অভিনয় করতে করতে অজ্ঞান হবার ভান করবে। কিন্তু ইমোশনালি অভিনয় করতে করতে আমি সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাই। সুভাষ দত্ত এবং ক্যামেরাম্যান অভিনয়ের আমার খুব প্রশংসা করছিলেন। সবাই হাত তালি দিচ্ছে। সবাই আমাকে ওঠার জন্য ডাকছে কিন্তু আমি তো উঠছি না। পরে তারা দেখলো আমি সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। আসলে প্রতিটি শর্ট দেয়ার সময় মনে হয়েছে যে এটা আমারই ঘটনা।
ঠিকানা: বাংলাদেশে সিনেমার বিকাশে সরকারি নীতি কতটা সহায়ক? সরকারি অনুদান নীতি কি নিরপেক্ষ? সিনেমার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন?
ববিতা: পৃথিবীর সব দেশেই ভাল ছবির জন্য সবাই সহযোগিতা করে। কিন্তু আমাদের দেশে কি হয়, যে সরকারই আসেন তারা চলচ্চিত্র থেকে বিরাট অংকের ট্যাক্স পেয়ে থাকেন কিন্তু সেই হিসাবে সরকারগুলোর নজর কম চলচ্চিত্রের দিকে। সব সময় আশ্বাস দেয়া হয় কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা ভুলে যান। ছবি করার জন্য সরকারি যে অনুদান দেয়া হয় তাও একবারে কম। আমি মনে করি এই অনুদান দেয়ার চেয়ে না দেয়াই ভাল। ঐ অর্থ দিয়ে সিনেমা হয় না। আমরা যদি এয়ারপোর্টে শ্যুটিং করতে চাই, জাহাজে শ্যুটিং করতে চাই, হেলিকপ্টারের শর্ট নিতে চাই, কেউ আমাদের সহযোগিতা করেন না। এমন কি পারমিশনও পাই না। আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই- সরকারসহ সবাই সগযোগিতা করছেন। বিশ্বের কাছে আমাদের চলচ্চিত্র তুলে ধরতে হলে তো আমি একা ফাইট করে পারবো না, সবাইকে মিলেঝুলে ফাইট করতে হবে। সুন্দর ছবি তৈরী করার জন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।
ঠিকানা: রাজনীতি সম্পর্কে কিছু বলুন? আপনি কোন রাজনৈতিক আদর্শ লালন করেন কি?
ববিতা: আমি সরাসরি রাজনীতি করি না। তবে ব্যক্তিগত পছন্দ আছে।
ঠিকানা: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ববিতা: দেশ দেশের মতই চলছে- এ সম্পর্কে কিছু নাই বা বললাম।
ঠিকানা: বাংলাদেশের সিনেমায় স্বদেশ চিত্র, দেশের মানুষের প্রকৃত অবস্থা, শাসক গোষ্ঠি বা রাজনীতি সত্যিকার অর্থে কতটা খুঁজে পাওয়া যায়?
ববিতা: আমাদের সিনেমায় তো অনেক কিছু তুলে ধরা হয়। কাজী হায়াত তো তার ছবিতে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যাগুলো বোল্ডলি বলে থাকেন। অনেক সত্যি কথা বলা হচ্ছে এবং দর্শকরাও দেখছেন।
ঠিকানা: আপনার অবসর সময় কাটে কীভাবে?
ববিতা: অবসর সময়ে আমি বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ, সাবজি এবং বাগান করা পছন্দ করি। আমি বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের বীজ নিয়ে যাই এবং বাসার ছাদে চাষ ও পরিচর্যা করি। আমার বাসায় সে সব সবজি বা ফুল পাওয়া যাবে তা সাধারণত ঢাকায় নাও পাওয়া যেতে পারে।
ঠিকানা: কোন ফুল বেশি পছন্দ করেন?
ববিতা: সব ধরনের ফুল পছন্দ করি। আমার ছেলের একটা জমি আছে সেখানেও আমি ফুলের, ফলের ও সবজির চাষ করি নিজের মত করে। তাছাড়া রান্নার প্রতি আমি আগ্রহী হয়েছি। এই রান্নার উপরে আমার একটা কথা বলা প্রয়োজন। আর সেটি হলো- যেহেতু আমি চলচ্চিত্র জগতে এত ব্যস্ত থেকেছি রান্না- টান্না শিখার সুযোগ হয়নি। আমি ১৩ বছর বয়স থেকে চলচ্চিত্র জগতে। মা- খালাদের থেকে যে সময়ে আমার রান্না শিখার কথা সেই সময়তো আমি পাইনি, চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সুতরাং রান্নাটা শিখতে পারিনি। এক দিন আমার ছেলে এসে আমাকে বললো- মা, আমার বন্ধুর মা এত সুন্দর রান্না করেছে, খেতে খুবই মজা। আমি তখন চিন্তা করলাম হতে পারি আমি বড় সেলিব্রেটি, বড় নায়িকা কিন্তু মা হিসাবে আমি ছেলের মুখ থেকে প্রশংসাটা পেলাম না। তখন আমি সিদ্দিকা কবীরস রেসিপির বইটি ক্রয় করি। সেই সাথে টিভিতে ভাল ভাল রান্নার যত আইটেম দেখাতো আমি তা লিখে রাখতাম এবং ভাল কিছু করার চেষ্টা করতাম। ঐ সব খাবার খেয়ে ছেলে আমার খুব প্রশংসা করতে লাগলো- মা তুমি খুব সুন্দর পাকিয়েছ, খুব মজা হয়েছে। সেটা আমার কাছে খুব ভাল লাগেতো। বিশেষ করে ছেলের মুখ থেকে প্রশংসা শুনতে।
ঠিকানা: কী খেতে ভালবাসেন?
ববিতা: (হাসতে হাসতে) আমি ছোট বেলায় যেটা খেতে ভালবাসতাম সেটি ছিলো পান্তা ভাত। আমি পান্তা ভাত খেতে খুব পছন্দ করতাম। তাছাড়া সকল বাঙালি খাবারই আমার পছন্দের। অনেকের মত আমার ছেলেও যেমন বিদেশী খাবার খেতে পছন্দ করে আমি সেই রকম না। আমি আসলে ভেতো বাঙালি। ভালই ভেতো বাঙালি।
ঠিকানা: কি পড়তে পছন্দ করেন?
ববিতা: বাঙালি শাড়ি। শাড়ির মত গ্রেসফুল ড্রেস তো হতেই পারে না। আমি আর্ন্তজাতিক যেসব ফেস্টিভলে গিয়েছি সেখানেই আমি শাড়ি পড়েছি। ফেস্টিভলে ফেমাস হবার আরেকটি কারণ হলো আমার শাড়ি পড়া। আমি বাঙালি জামদানি শাড়ি, মাথায় ফুল, কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল পড়ে যেতাম। অনেকের মধ্যে সবাই আমাকে আলাদা করে চিনতে পারতেন, আমার দিকে তাকাতেন। ক্যামেরা আমার দিকে থাকতো।
ঠিকানা: কী ভাবতে বা করতে ভাল লাগে?
ববিতা: চলচ্চিত্র পরিচালনায় আমি হয়ত আসবো। চলচ্চিত্র নিয়ে আরো কিছু করার আছে। ইদানিং আমাদের দেশে একটা হাওয়া বাইছে, আর সেটি হলো সব নায়িকারা পরিচালক হয়ে যাচ্ছেন। আমার কথা হলো যে, পরিচালনা এত সহজ নয়। পরিচালক হতে হলে সব দিক জানতে হবে, তাকে জ্ঞানী হতে হবে। নামকোওয়াস্তে পরিচালক হয়ে তো কোন লাভ নেই। এডিটিং একজন করে দিলো, ক্যামেরার শর্ট কি হবে তা আরেকজন করে দিলো, ডান্স ডিরেক্টর ডান্স করে দিচ্ছে- তাহলে আমি কেমন পরিচালক হলাম? সে জন্য আমি বাসায় থাকলে প্রচুর ছবি দেখি। এর মধ্যে অন্য দেশের ছবিও আছে। আমি হয়ত ভাষা বুঝতে পারবো না কিন্তু ক্যামেরার ভাষাতো বুঝবো। তাছাড়া আমি হালকাভাবে ছবি দেখি না। খুব সিরিয়াসলি দেখি। এখানে ক্যামেরাটা জুম করলো কেন? শর্ট টি কাটা হলো কেন? এটা কি একই শর্ট নিলো? পরিচালক কি মনে করে এই শর্টটি নিলেন? যেদিন আমি বুঝবো আমি মোটামুটি একটু শিখতে পেরেছি, সেই দিনই ছবি পরিচালনায় আসবো। অনেকেই অফার দিচ্ছেন। তারা হয়ত ব্যবহার করার চেষ্টা করবে ’ববিতা পরিচালিত’। কিন্তু আমি যে দিন নিজে সেটিসফাইড হবো সেইদিন পরিচালনায় আসবো।
ঠিকানা: আপনার শখ কি?
ববিতা: আমি পাখি পালি, আমি মাছ পালি। ছোট ছোট মাছ এ্যাকুরিয়ামে। তাদের খাবার দিই, পাখিদের খাবার দিই। এগুলোই আমার শখ। অনেকের পছন্দ শপিং করা। কিন্তু আমি শপিং হেইট করি। প্রয়োজন ছাড়া আমি শপিং এ যাই না।
ঠিকানা: আপনি কি বেড়াতে পছন্দ করেন?
ববিতা: বিদেশে ভ্রমন আমি খুব পছন্দ করি। কিন্তু দেশেতো ভ্রমণ করতে পারি না। দেশে আমাকে বোরখা পরে চলতে হয়। আমাদের জীবনতো এক ধরনের বন্দী জীবন।
ঠিকানা: কতটা দেশ ভ্রমণ করেছেন?
ববিতা: অনেক দেশেই ভ্রমণ করেছি, ফেস্টিভলে গিয়েছি। তাসখন্দেই তো আমি ১৫ থেকে ২০ বার গেছি। মোটামুটি অনেক দেশেই গিয়েছি। এখন আমার সাত নম্বর পাসপোর্ট চলছে। আমি ওমরা হজ্ব করেছি। আগে প্রতিটি শুক্রবারে বোরখা পরে আমার যেসব মাজার যেতে ইচ্ছে করতো আমি চলে যেতাম। এর মধ্যে হাইকোর্টের মাজার, সচিবালয়ের মাজার, পীরবাগ মাজার, সিলেট, চট্টগ্রাম, পাকিস্তান ও তাসখান্দসহ বিভিন্ন দেশের মাজারে গিয়েছি। ওমরা হজ্বটা করার পরে আমার মনে হয়েছে যে আরো আগে আমার হজ্ব করা উচিত ছিলো। এখন চেষ্টা করি নামাজটা পড়ার। নামাজ পড়লে মনটা বেশ ভাল লাগে। সামনে হজ্ব করারও চিন্তা- ভাবনা আছে। দেখি আগামীতে যেতে পারি কি না।
ঠিকানা: প্রবাসীদের সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
ববিতা: প্রবাসীরা খুবই ভাল করছেন। আমরা তাদের জন্য গর্ব করি। উনারা প্রবাসে থেকে দেশের জন্য অনেক কিছু করছেন। সত্যি কথা বলতে কি- আমরাতো গরীব দেশ। প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতিকে স্বচ্ছল রাখছেন, নিজের আত্মীয়- স্বজনকে সাহায্য করছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করছেন। এটাতো আমাদের দেশের জন্য বিরাট পাওয়া। আশা করি তারা ভাল থাকবেন। যত প্রবাসী আসবেন ততই দেশের জন্য ভাল হবে। তবে সত্যি সত্যি খুশি হবো যাদের কাগজপত্র নেই তাদের কাগজপত্র হয়ে গেলে। কাগজ না থাকার কারণে অনেকেই আশা নিয়ে দাঁতে কামড় দিয়ে বসে আছেন। দোয়া করি উনাদের আশা পূরণ হবে।
ঠিকানা: আপনি তো একজন আন্তর্জাতিক শিল্পী। বাংলাদেশে দেখা যায় সরকার পরিবর্তনের সময় কোন কোন শিল্পীকে কলো তালিকাভুক্ত করা হয়- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
ববিতা: সিনেমার ক্ষেত্রে এই সব হয় না। তাছাড়া করলেও কোন লাভ হয় না। দর্শকরা যদি রাজ্জাককে দেখতে চায় তাহলে তারা রাজ্জাকের অভিনীতি ছবিই দেখবে, শাবানা আপার ক্ষেত্রেও তাই। ববিতা ভাল অভিনয় করেছে- এটা বলতে কার্পণ্য করবে না। গানের শিল্পীদের ক্ষেত্রে এসব হয় বলে শুনেছি। আমি মনে করি এই সব করা উচিত নয়। শিল্পী শিল্পীর জায়গায় থাকবেন। শিল্পী সবার। শিল্পী কোন দল বা গোষ্ঠির হতে পারে না।
ঠিকানা: আপনি কি কোন ব্যবসা – বাণিজ্য করেন?
ববিতা: আমার ব্যবসা- বাণিজ্য বলতে প্রোডাকশন হাউজ। সিনেমা বানিয়েছি। আগে আমি বড় বাড়িতে ছিলাম। এখন আর একা একা সাহস পাই না। তাই গুলশানে একটি এ্যাপার্টমেন্ট কিনে নিয়েছি। সেখানে একা একা থাকি।
ঠিকানা: আপনার কি মনে হয়- এই বিশাল অভিনয় জীবনে আপনি মনের মত একটি চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছেন?
ববিতা: একজন শিল্পী কিন্তু কোন দিন সন্তুষ্ট হন না। আবার যদি গোলাপীর বা অন্য ছবির ঐ চরিত্রটি পেতাম। এখন আমি আগের থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এখন চান্স পেলে আরো সুন্দর করে ফুটাতে পারতাম। একজন শিল্পীর চাওয়ার কোন শেষ নেই। আমি যে শ্রেষ্ঠ হয়েছি তা আমি মনে করি না। আমি এখনো মনে করি আরো ভাল কিছু করতে পারবো- যতই আমার বয়স বাড়ণ্ডক না কেন। অভিনয়ের জন্য শেষ বলে কিছু নেই।
ঠিকানা: কার অভিময় ভাল লাগে?
ববিতা: ছেলেদের মধ্যে ডাস্টিন হফম্যান, আলফাসিনো, রাবার্ট ডিনেরো, মেয়েদের মধ্যে সুচিত্রা সেন, সোফিয়া লরেন ও জুলিয়া রবার্টসের অভিনয় ভাল লাগে।
ঠিকানা: গান শুনেন?
ববিতা: মা খুব রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ করতেন। আমিও রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ করি। তাছাড়া একটু আধটু সব গানই শুনি।
ঠিকানা: আপনার বাবার নাম?
ববিতা: মরহুম এ এস এম নিজাম উদ্দিন আদাইয়ুব।
ঠিকানা: কয় ভাই বোন?
ববিতা: তিন ভাই তিন বোন। ভাই- বোনদের নাম হচ্ছে- কোহিনুর আক্তার (সুচন্দা), ডাক নাম চাটনি, সাইদুল ইসলাম, ডাক নাম চার্চিল, ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, ফরিদা আক্তার (ববিতা), ডাক নাম পপি, ইকবাল ইসলাম, ডাক নাম স্বপন, আমেরিকায় আছেন, গুলশানারা আক্তার চম্পা, ফেরদৌস ইসলাম, ডাক নাম লিটন, আমেরিকায় আছেন। ভাইদের মধ্যে সবাই বিদেশে থাকলেও আমরা তিন বোন সুখে- দু:খে দেশেই আছি। প্রতিদিন খবর নিই কার বাসায় কি রান্না হয়েছে। ভাল রান্না হলে বলি আমার জন্য এটা পাঠিয়ে দেয়। আবার তিন বোন মিলে বেড়াতে যাই। অস্ট্রেলিয়াতে ভাই -এর মেয়ের বিয়েতে আমরা তিন বোন বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমরা আবার এক সাথে পিকনিকে যাই। এ ছাড়া চম্পা এবং আমার একটা শখ আছে। সেটি হলো মাছ ধরা। যে কারণে আমরা মাঝে মধ্যেই গ্রামের কোন পুকুরে বা নদীতে মাছ ধরতে যাই। চম্পা পদ্মা নদীর পাড়ে একটি জায়গা কিনেছে। আমরা সেখানে মাঝে মধ্যে যাই- রান্না করি, আড্ডা দেই, নৌকায় চড়ি, গল্পগুজব করে সন্ধ্যায় ফিরে আসি।
ঠিকানা: আপনার জীবনে অপরিপূর্ণ কোন কিছু কি আছে?
ববিতা: সব মানুষেরই অপরিপূর্ণতা আছে। সব কিছু কি চাইবার আছে, আর চাইলেই বা কি পাওয়া যায়? অপূর্ণতা থেকেই যায়। সেগুলো নাইবা বললাম, আমার গোপন কিছু থাকুক। চলার পথে সব কিছু যে পেয়েছি তা আমি বলবো না। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া আদায় করি। আমি যতটুকু আমি আমার জগত থেকে পেয়েছি এবং দর্শকদের ভালবাসা পেয়েছি তার জন্য। দর্শকদের ভালবাসাই আজকে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এখনো দেখা যায় আমি গাড়ি দিয়ে যাচ্ছি- কোথাও থামলাম। তখন ছোট ছোট মেয়েরা এসে বলে আপা ফুল নেন। আমি যদি বলি ভাংতি নেই, ফুল নেব না। তখন তারা বলে- ববিতা আপা কালকে রাতে আপনার সিনেমা দেখেছি। প্রশ্ন করি কোথায় দেখলি? উত্তরে বলে- ক্যান আমাদের বাসায় ডিস আছে না? তারপরে হয়ত বলছে- আপনাকে পয়সা দিতে হবে না, আমি আপনাকে এমনিতেই ফুল দিলাম, আপনাকে ফুল দিতে পারলে আমি ধন্য। আমি হা হয়ে যাই- তার ভালবাসা দেখে। এই ভালবাসা আমি পৃথিবীর কোথায় পাবো?
ঠিকানা: আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
ববিতা: আমার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার বিজয় নগরের চোরামনকাঠি গ্রামে।
ঠিকানা: গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান?
ববিতা: মাঝে মধ্যে যাই। গ্রামবাসী আমাকে প্রচন্ড ভালবাসেন। যখন যাই তখন তারা চিড়ামুড়ি পোটলার মধ্যে বেঁধে দেখতে চলে আসে। আমার কাছে ভাললাগে।
ঠিকানা: এমন কোন ঘটনা আছে কি যা আজ পর্যন্ত আপনি কাউকে বলেননি?
ববিতা: সেটি হলো- আমি তাসখান্দ আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভলে প্রায় যেতাম। সবার সাথে পরিচিত হতাম। একবার হলো কি- সোভিয়েট ইউনিয়নের আজারবাইজানের ছবির নায়ক রাশিম। তার অভিনীতি কবির উপরে নির্মিত একটি ছবি আমি দেখলাম। আমি তার অভিনয় দেখে একেবারে পাগল হয়ে গেলাম। আমি তার ভক্ত হয়ে গেলাম। অদ্ভূত সুন্দর অভিনয় করেছে। আমার যে ইন্টারপ্রেটার আছে তাকে আমি বললাম- আমি তার সাথে দেখা করতে চাই এবং আমি তার অটোগ্রাফ নেব। আমার অবস্থা দেখে বিভিন্ন দেশের নায়ক- নায়িকারা বলাবলি শুরু করলো- ববিতা এই ছেলেটাকে খুব লাইক করেছে, সে তার খুব ভক্ত হয়ে গিয়েছে। তারপরে তার সাথে আমি পরিচিত হলাম, তাকে আমি বললাম আমি বাংলাদেশের নায়িকা। তার সাথে এক দিন ডিনার পার্টিতে গেলাম, দুজন এক সাথে ডান্স করলাম। এরপর থেকে যখন আমি তাসখান্দ ফেস্টিভলে যেতাম আমি আমার ইন্টাপ্রেটারকে বলতাম রাশিম কোথায়? আমি রাশিমকে দেখতে চাই। এক পর্যায়ে সবাই কনাঘুষা শুরু করলো- বাংলাদেশের নায়িকা ববিতা এবং আজারবাইজানের নায়ক রাশিম একজন আরেকজনকে লাইক করে, সবাই হাসিঠাট্টাও শুরু করলো। মজার বিষয় হলো- আমার যে ইন্টাপ্রেটার সে ছিলো আমার বয়সী। মেয়েটার নাম দিলবার। দিলবার আবার রাশিমেরও খুব ভক্ত। রাশিম ইংলিশ বলতে পারে না, আমিও রাশিয়ার ভাষা বলতে পারি না। সুতরাং যোগাযোগের একমাত্র উপায় হলো দিলবার। আমি দিলবারকে বললাম খোঁজ নাও রাশিম কোথায় থাকে, সে বিয়ে করেছে কিনা? তখন দিলবার আমাকে বলতো ববিতা- তুমি ওর জন্য এত পাগল কেন? ওতো বিয়ে করেছে, তার দুই তিনটি ছেলেমেয়েও আছে। আমি বললাম- তাই নাকি? তখন আমি তাকে বললাম- ঠিক আছে, রাশিমের বউকে ও ছেলেমেয়েদের আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দিও। পরবর্তীতে আমি একটি টার্কিস নায়িকা ফাতেমা গ্রীককে রাশিমের কথা বলতেই ফাতেমাগ্রীক আমাকে বললো- ববিতা তুমি নাকি নায়ক রাশিমের খুব ভক্ত। তুমি কি ওকে সত্যিই খুব লাইক কর? আমি বললাম- হ্যাঁ আমি তাকে খুব লাইক করি। লাইক করলেই লাভ কি? কারণ ওতো বিবাহিত, ওর ছেলেমেয়ে আছে। আমার কথা শুনে ফাতেমাগ্রীক বললো- কে বললো তোমাকে রাশিম বিবাহিত? তার ছেলেমেয়ে আছে? আমি বললাম- আমার ইন্টারপ্রেটার দিলবার বলেছে। আমার কথা শুনে তার তো আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। কারণ রাশিম বিবাহিত নয়। তারমানে আমার ইন্টাপ্রেটার দিলবারও রাশিমের ভক্ত। যে কারণে সে চায় না রাশিমের সাথে আমার বন্ধুত্ব হোক। এটা নিয়ে পুরা ফেস্টিভলে খুব মজা হয়েছিলো।
ঠিকানা: রাশিম কি জেনেছিলো আপনি তাকে পছন্দ করেন?
ববিতা: হ্যাঁ জেনিছিলো। এক সময় আমি আমার ইন্টাপ্রেটারকে বললাম চল আমরা রাশিমকে নিয়ে বেড়াতে যাবো। আমি তার জন্যে গিফট কিনলাম। বেড়াতে গেলাম। ফেস্টিভল থেকে গাড়ি নিলাম, শপিং করলাম। আমি তাকে এমন কিছু গিফট দিলাম সে যাতে আমাকে ভুলে না যায়। রাশিমও আমাকে গিফট দিলো। তারপরে আমি রাশিমকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা রাশিয়ান ও ইংরেজী ভাষায় বললাম- তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের আমার ভালবাসা দিও। তখন রাশিম বিস্মিত হয়ে বললো- আই এম নট ম্যারেড। হু টোল্ড ইউ? আমি দিলবারকে দেখিয়ে বললাম- সে বলেছে।
ঠিকানা: পরে কি যোগাযোগ ছিলো?
ববিতা: কিছু দিন ছিলো। এক সময় আমিও ব্যস্ত হয়ে গেলাম, আমারও বিয়ে সাদী হয়ে গেল। আর যোগোযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ঠিকানা: আপনার বিয়ে এবং অনিক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? ববিতা: আল্লাহ তালা আমাকে একটি সন্তান দিয়েছেন। তার নাম অনিক ইসলাম। তাকে আমি পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালবাসি। আমার বিয়ে হয়েছিলো। আমি সর্বসাকুল্যে পাঁচ বছর ঘর করেছি। তারপরে আমাদের দু’জনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছিলো না। তাই ছাড়ছাড়ি হয়ে গেল। পরবর্তীতে আর বিয়ে সাদীর কথা চিন্তা করিনি। কারণ আমার একটা ছেলে আছে। যাকে আমি রাজপুত্রই বলবো। আমি আমার সুখের জন্য যদি অন্য কাউকে বেছে নিই- তাহলে হয়ত আমার ছেলেটি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যেত। যেটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। আবার আমি যে সুখী হবো তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? বিয়ে না করে মনে হয় ভালই করেছি। কারণ আমার ছেলে বুঝতে পেরেছে- তার জন্য আমার স্যাক্রিফাইসটুকু। যে কারণে সে ভালভাবে লেখাপড়া করছে এবং আমাকে খুশি করার জন্য বা কিছু দেবার জন্যে উদগ্রীব থাকছে। একা থাকি তাই হয়ত খারাপ লাগে। কিন্তু সবশেষ কথা হলো- আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি।
ঠিকানা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ববিতা: ঠিকানা পরিবারের সবাইকে আমার ধন্যবাদ।