জামায়াতসহ ৩৩ দলকে নিয়ে মাঠে নামছে বিএনপি

নূরুল ইসলাম : সরকারবিরোধী আন্দোলনে এবার আর বিএনপি একা নয়, পাশে পাচ্ছে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে। জামায়াতে ইসলামীসহ ৩৩ দলকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি। প্রায় দুই মাসব্যাপী বিভাগীয় গণসমাবেশ বাস্তবায়ন করে চাঙা হয়েছে দলটি। নির্বাচনের আরও এক বছর বাকি থাকলেও সরকার ও বিরোধী পক্ষ এখন মুখোমুখি। শক্তি প্রদর্শনের এই মহড়ায় আগামী বছরজুড়েই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
সরকারের নমনীয় মনোভাব কাজে লাগিয়ে বিএনপি গত জুলাই মাস থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দী থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। জেলায় জেলায় কর্মসূচি পালন শেষে একপর্যায়ে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে নিহত কর্মীদের জন্য সমাবেশ করে এখন অনেকটা উজ্জীবিত। দেশ-বিদেশের বড় শিরোনামে অবস্থান করছে। কূটনৈতিক মিশনে ভালো অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, এবার আর সরকারকে ছাড় দেওয়ার সময় নেই। সরকারের পতন না ঘটিয়ে তারা ঘরে ফিরবেন না। সিনিয়র নেতাদের এমন বক্তব্যে প্রাণ ফিরে পান মাঠের নেতাকর্মীরা। মামলা-হামলার ভয় উপেক্ষা করে তারা সরব থেকেছেন রাজপথে। রক্ত ঝরিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তাদের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোবল উজ্জীবিত করেছে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। এদিকে দলীয় সভা-সমাবেশে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি উদ্বেগ বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন সংঘাতময় পরিবেশের দিকে ধাবিত হওয়ায় দেশবাসী চরম উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগারে রেখে সমাবেশ বাস্তবায়ন করে ফেলা নজিরবিহীন সফলতা। অতীতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আটকের পর বিএনপি ঠান্ডা হলেও এবার সেই রূপ নেই। বিএনপি গরম হাওয়ার মধ্যে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে রাজপথ এখনো উত্তপ্ত রেখেছে।
দেশের রাজনীতিতে চোখ রাখা ব্যক্তিরাও বলছেন, গুলিতে দলের সাত কর্মী নিহত, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। বিএনপি আর অতীতের মতো শান্ত নীতিতে থাকছে না। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে এবার বিএনপি রাজপথকেই টার্গেট করেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। অতীতে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতির কিছুটা আভাস পেলেও এবার সেটির লক্ষণ নেই। তবে সংঘাতের দিকেই যেতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাদের মতে, বিএনপির টানা কর্মসূচিতে দলটির নেতাকর্মীরা যেভাবে উজ্জীবিত হয়েছেন, তাতে তাৎক্ষণিক না হলেও দীর্ঘমেয়াদি ফল মিলবে, যা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। গত কয়েক মাস ধরে অনেক কষ্ট করে রাজপথে থেকেছে তারা। কাঁধে কাঁধ রেখে একসঙ্গে সমবেত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, উজ্জীবিত হয়েছে-এটা কম প্রাপ্তি নয়। তবে আগামীতে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কৌশল সম্পর্কে সতর্ক হওয়া জরুরি।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দলটি দাবি বাস্তবায়নে এবার নরম কর্মসূচির মধ্যে থাকবে না। যদি প্রয়োজন হয় সংঘাতের পথ বেছে নেবে। রাজপথে নেমে সরকারকে সরাতে বাধ্য করা হবে। জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দলও সামনের সারিতে থাকবে।
১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগ, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তি, গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিসহ যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এই দফাগুলো নিয়ে সমমনা দলগুলোর মতামত ও সম্মতি নেওয়া হয়েছে বলে সমাবেশের বক্তব্যে দাবি করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ওইদিন রাতেই জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট ১০ দফার সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। এরপর ১২ ডিসেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চ একমত হয়।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছি। সে ক্ষেত্রে নৈতিক দিক থেকে আমাদের দলের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। সংখ্যায় কম হলেও এই পদত্যাগ অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ডিসেম্বর ১০ দফা দাবির পক্ষে প্রথম কর্মসূচি। আমরা আহ্বান জানিয়েছি যুগপৎ আন্দোলন করার। এখন যুগপৎ হবে কি না, সেটি ওই দিনই দেখা যাবে।
এদিকে বিএনপির এই যুগপৎ আন্দোলনে সাবেক ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বেশির ভাগ দলই থাকবে। এর বাইরে এবি পার্টি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলোও নতুন করে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বিএনপির জোট শরিক ও যুগপৎ সঙ্গীরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, তা বুঝতে বিলম্ব হয়েছে বিএনপির। তবে সংসদ থেকে পদত্যাগ আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি সঞ্চার করবে। বিএনপির জোট শরিক দলগুলোর ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে আগামী দিনে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে সংলাপে। দুই দফা চলা ওই সংলাপে আন্দোলনের দফাগুলো চূড়ান্ত ও যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন শরিক দলগুলোর নেতারা। আগামী দিনে যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়েও একমত হওয়ার কথা বলেন জোট শরিকরা।
বিএনপির ঘোষিত ১০ দফা ও ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিলের সঙ্গে মিল রেখে ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি স্থানীয় মিলনায়তন থেকে একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। একই দিন রাজধানীর পুরানা পল্টনে এক অনুষ্ঠানে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মন্জু বলেছেন, বিএনপির ১০ দফা গ্রহণযোগ্য। এই দাবি জাতীয় সমঝোতা দলিলের প্রাথমিক খসড়া ও দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদী মানুষের অধিকারের সনদ।
বিএনপির দীর্ঘদিনের আরেক জোটসঙ্গী কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের ঘটনা বর্তমান সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন দলটির চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব) অলি আহমদ। তিনি বলেন, গত ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্তমান সরকারের নিরাপদ প্রস্থানের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১০ তারিখের সমাবেশের পর সেই সুযোগ নেই। আগামী দিনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকার যে চাপের মুখে পড়বে, সে চাপ সামাল দেওয়ার ক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই। অলি বলেন, বিএনপি ঘোষিত ১০ দফা জোট শরিকদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেই তৈরি করা হয়েছে। এর প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন আছে। আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের যেকোনো কর্মসূচিতে যুগপৎভাবে অংশ নেবে এলডিপি।
এ ছাড়া জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ-অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী হতে যাচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর সোমবার দুপুরে রাজধানীর তোপখানা রোডের শিশু কল্যাণ পরিষদ ভবনে ‘বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন’ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের সংবাদ সম্মেলনে ১৪ দফা পেশ করা হয়। দফাগুলো পাঠ করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তবে বিএনপি ঘোষিত ১০ দফা কর্মসূচির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নয় গণতন্ত্র মঞ্চ। এ জন্য বিএনপির ১০ দফার পাশাপাশি নিজেদের ১৪ দফা দিয়েছে তারা।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে আগেই আলোচনা শুরু করেছি। আলোচনায় আমাদের ১৪ দফা তাদের কাছে দিয়েছি। বিএনপি এর আগে তাদের ১০ দফা আমাদের দিয়েছে। উভয়ের যে অবস্থান, সেখান থেকে একটি ন্যূনতম ঐক্যের জায়গা আমরা তৈরি করতে আগ্রহী। সাকি বলেন, সেই ন্যূনতম কর্মসূচি বা দাবিনামার ভিত্তিতে আমরা একটি যুগপৎ আন্দোলন তৈরি করতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা অতি দ্রুত বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে একটি লিঁয়াজো কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই কাজ কিছুটা এগিয়েছে।