জামায়াতকে নিয়ে সরকারের নতুন খেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী বিচারের মুখোমুখি হলেও গত চার বছর যাবৎ বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। এই সময়ে মামলাটি ছয়বার হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। এটা জামায়াতকে নিয়ে সরকারের নতুন খেলা বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
হাইকোর্টের নির্দেশে জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিষিদ্ধ। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তারপরও জামায়াত কঠোর সতর্কতার সঙ্গে দলীয় কর্মকা- সীমিতভাবে পরিচালনা করে আসছে। ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে তাদের অফিস তালাবদ্ধ। নেতা-কর্মীরা গোপন বৈঠক করলেও অভিযান পরিচালিত হয়, গ্রেফতার করা হয়। জামায়াতের নেতাদের অভিযোগ, সরকারের লাগাতার নির্যাতনের পাশাপাশি বিএনপির কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। জুলাইয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা দেখাতে চান যে চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও জামায়াত রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। শুধু তা-ই নয়, বড় দুই দলকেই তারা দেখাতে চান যে সরকার গঠন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তাদের প্রয়োজন রয়েছে। এই লক্ষ্য সামনে রেখে বিএনপি, আওয়ামী লীগ উভয়ের সঙ্গেই দর-কষাকষি শুরু করেছে। তফসিল ঘোষণার পর তারা কঠিন দর-কষাকষিতে যাবে।
জামায়াতের কয়েকজন নেতা জানেন, তারা স্পষ্ট বুঝতেও পারছেন, বড় দুই দলের কেউই তাদের আস্থায় নেয়নি, তারা তাদের ব্যবহার করছে মাত্র। নির্বাচনে তাদের কঠোর অবস্থান নেওয়ার উদ্দেশ্যই তা-ই। সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন ৩০ জুলাই। সিলেট সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে তারা দলীয় প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২৮ জুন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ২০ দলের মহাসচিব ও সেক্রেটারি জেনারেলদের সভায় জামায়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সিলেটে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তারা সরে আসবেন না। সিলেটে স্থানীয় নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে তারা দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে তার পক্ষে পুরোদমে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জুবায়েরকে সিলেটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে তাকে ২০ দলীয় জোটগত সমর্থন দেওয়ার জোর দাবি করা হয়। বিএনপি বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি সমঝোতায় আসতে আগ্রহী হলেও জামায়াত এ ব্যাপারে কোনো রকম সমঝোতায় আসতে রাজি নয়। তারা বলছে, দলের স্বার্থ পরিহার করে তারা গাজীপুর, খুলনাসহ সব সিটি করপোরেশন ও অধিকাংশ পৌরসভায় মেয়র পদে দলীয় যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বিএনপিকে ছাড় দিয়েছে। বিনিময়ে তারা কিছু পায়নি। উল্টো সরকারের রোষানলে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জানা যায়, বৃহত্তর স্বার্থচিন্তায় বিএনপি সিলেটে জামায়াতের মেয়র প্রার্থীকে শর্ত সাপেক্ষে মেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছে। শর্ত হচ্ছে, তাদের প্রার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন না করে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু জামায়াত তাতে রাজি নয়। বিএনপির মনোনীত আরিফুল হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জামায়াত জুবায়েরকে সামনে নিয়ে নির্বাচন করবে। এ অবস্থা সরকারি দলকে বড় রকমের সুবিধা করে দিচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির এই দ্বন্দ্ব রাজশাহী ও বরিশালের নির্বাচনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, জামায়াতের এই কঠোর অবস্থান নেওয়ার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া থেকেই তাদের এই কঠোরতা। আগামীতে ২০ দলীয় জোটগত সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিলেটে জামায়াতের অনমনীয়তা এক অশনিসংকেত। কাক্সিক্ষত আসনে ছাড় না পেলে তারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই জোট থেকে নির্বাচন না-ও করতে পারে। বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন বর্জন করতে হলেও জামায়াত তা না-ও করতে পারে। সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতের ভিত্তিতে নির্বাচনে গিয়ে জামায়াত সরকারকে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার সুযোগ করে দেবে। এ ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী দেশের নির্দেশনা রয়েছে বলে জানা যায়। বিএনপি বর্জন করলেও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের আরো কয়েকটি দলকে নির্বাচনে নামানোর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। এর কিছু আলামতও বিএনপির নেতাদের কাছে স্পষ্ট। বিএনপির নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রাখলেও সরকার জামায়াতের নেতা-কর্মীদের কিছুটা ছাড় দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে দীর্ঘ ৮ মাস কারাগারে থাকলেও ১০ জুলাই জামায়াতের আমির মকবুল আহমদ জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলে বিএনপির নেতারা মনে করছেন।