সাঈদ-উর-রব : বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সম্মেলন উপলক্ষে। ২৫ মে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই সে সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুন প্রজন্মে প্রবাহের অভিপায়ে যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে যুব কমান্ড গঠনের অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। এ মাসের প্রথমার্ধেই যুব কমান্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হবে বলে তিনি আশা করছেন। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে চলমান আন্দোলনের ব্যাপারেও অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী বিভিন্ন মহলের সাথে মতবিনিময় করছেন। ইতিমধ্যেই তিনি জাতিসংঘের উর্দ্ধতন একাধিক কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সে সময় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের শীর্ষ নেতারা ছিলেন। এসব বিষয় ছাড়াও বাংলাদেশের বিরাজিত পরিস্থিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের হালহকিকত ইত্যিাদি আলোকে দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয় অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর। ৩০ মে ঠিকানা অফিসে নেয়া সাক্ষাৎকারের বিবরণ এখানে প্রশ্নোত্তর আকারে উপস্থাপন করা হলো।
প্রশ্ন : যে উদ্দেশ্যে আমেরিকায় এসেছেন তার কতটা অর্জিত হলো?
উত্তর : মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনের আমন্ত্রণ পেয়েই এসেছি। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছি আমি। এর আগেও কয়েকবার এসেছি মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলন উপলক্ষেই। ১৯৯৩ সালে প্রথম এসেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের জন্যে। এবার এর সাংগঠনিক ভিত্তি অনেকটা সবল এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অঙ্গ সংগঠনগুলোও এবার গঠন করা হচ্ছে। সম্মেলনকে ঘিরে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং সেভাবেই কাজের অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন। এ কমিটি গঠন করা হয়েছে এক বছরের জন্য। কেননা অনেকে ঠিকমত জানতে পারেননি বলে সম্পৃক্ততা কম ছিল। সামনের বছরের ২৫ মে পর্যন্ত বর্তমান কমান্ডের দায়িত্বের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নেটওয়ার্ক গড়বেন তারা। এভাবেই হয়তো সামনের বছরের সম্মেলনে অনেক বেশীসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সমাগম ঘটবে। আগামী বছরের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে একটি কমিশনও গঠন করা হয়েছে ডঃ প্রদীপ রঞ্জন করের নেতৃত্বে।
প্রশ্ন : এক বছর পর যদি বর্তমান কমিটি দাবি করে যে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমাদের মেয়াদ ৩ বছর?
উত্তর : সেটি ধোপে টিকবে না, কারণ অনুমোদন দিয়েছি আমি এক বছরের জন্য। সেখানে লেখা হয়েছে যে ২০০৯ সালের ২৫ মে এ কমিটির মেয়াদ শেষ হবে এবং তার পরে একমাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমান্ড গঠিত হবে। সম্মেলনে উপস্থিত সকল মিডিয়াও সেটি জানেন।
প্রশ্ন : নির্বাচন কমিশনও কি শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়েই গঠনের নিয়ম রয়েছে?
উত্তর : না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লোকজনের সমন্বয়েও সেটি হতে পারে।
প্রশ্নঃ মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা কি?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা নিজ বাসস্থান ত্যাগ করে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। এটি হচ্ছে সাধারণ সংজ্ঞা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে যারা সহযোগিতা করেছেন জীবন বাজি রেখে তাদেরকে স্বীকৃতি প্রদানের কোন কর্মসূচি আপনাদের রয়েছে কি?
উত্তরঃ অবশ্যই। এজন্যে রয়েছে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেন এবং যুদ্ধের সময় নানাভাবে সহায়তাকারীদেরকে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ অভিহিত করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধ ছাত্র কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা মহিলা কমান্ড। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করছে তাদের সমন্বয়ে সন্তান কমান্ড গঠন করা হচ্ছে।
প্রশ্ন : বলা হয়ে থাকে যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ক্রমান্বয়ে মলিন হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী?
উত্তর : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, আমরা যত সহজে মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করেছি, তত স্বল্প সময়ে আর কোন জাতি স্বাধীনতা পায়নি। এমনি অবস্থায় স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা লক্ষ করেছি, যারা আমরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছি বঙ্গবন্ধুর ডাকে তাদের অধিকাংশেরই বয়স খুব কম ছিল, ১৫ বছর থেকে ৪৫/৫০ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলাম অনেকে। তারা ছিলেন ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ। কিছুসংখ্যক বাজে লোকও ছিল। আমাদের বয়স খুব কম থাকায় যুদ্ধের ভেতরের ঘটনাবলী আমরা অনুধাবন করতে পারিনি সেভাবে। মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ায় অনেকে ভাবতে পারেননি যে সদ্য-স্বাধীন দেশকে কীভাবে সঠিক ট্র্যাকে পরিচালনা করা যাবে। তা সত্বেও মুজিব বাহিনীতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে একটি ভাবনা ছিল। তারা অনেক বেশী রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। তবে এত তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এটা তারাও ভাবতে পারেননি। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা কী দেখলাম? যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা আনলাম, সেই চিন্তা-চেতনার মানুষগুলোই রয়ে গেছেন অফিস-আদালতে। যে পুলিশ পাকিস্তানীদের সেবা করেছে, একই পুলিশ রয়েছেন থানা-জেলা পুলিশের দায়িতে¦। এ অবস্থায় রাজাকারদের চিহ্নিত করা কষ্টকর হয়ে গেল। স্বাধীনতার পরবর্তি সরকার দুষ্কৃতিকারিদের তালিকা তৈরীর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে সময় ঐসব পুলিশের হাতে ছিল পাক হানাদারদের তৈরী দুষ্কৃতিকারিদের তালিকা-যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নামও ছিল। স্বাধীন দেশের সরকারের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে পাকিস্তানী হায়েনাদের ঐসব অনুগতরা ধরতে শুরু করলো মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও।
প্রশ্ন ঃ পাকিস্তানের ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে একই ধরনের হাজার হাজার পরিবারের জন্ম হলো কীভাবে?
উত্তর ঃ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ২২ পরিবারকে ধরাশায়ী করার পর যে ২২ হাজার পরিবার সৃষ্টি হবে তা তো আমরা ভাবিনি। এর ফলে সারাদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশা বেড়েছ্।ে অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থার কারণে মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশায় দিনাতিপাত করছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছি কিন্তু জীবন যুদ্ধে পরাজিত। একারণে সারাজাতিই জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। স্বাধীন দেশে ২২ হাজার পরিবার দেশটাকে লুটেপুটে খেয়েছে। এখন দেশের মানুষ যুদ্ধ করছেন অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য।
প্রশ্ন ঃ এজন্যে আপনি কাকে দায়ী করবেন? নিজের ভাগ্যকে, রাষ্ট্রনায়কদেরকে, নাকি অন্য কোন পরিস্থিতিকে।
উত্তর ঃ খুব সাহস না করলে ভাগ্যকে, আর সাহসের সাথে যদি বলতে হয় তাহলে বলবো ‘সরকার।’
প্রশ্ন ঃ কোন সরকার?
উত্তরঃ আমি তো বলবো শুরু থেকেই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে নতুন সরকারের আমলে কিছুটা অব্যবস্থাপনা থাকতেই পারে। কিন্তু তা সত্বেও মানুষ কিন্তু সে সরকারকেও দায়ী করতে পিছপা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ কিন্তু সেই প্রথম থেকেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকেই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত। কীভাবে অবহেলিত? জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলাম এবং স্বাধীনতার পরই চট করে আমার অস্ত্রটা নিয়ে নিলেন? এমন অদূরদর্শী কাজ শুরুতে হয়েছে বলেই ৩৭ বছরও আমাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে চিৎকার করতে হচ্ছে। ৩৭ বছর পর আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করছি বিগত ৩৭ বছরে বিচার না করার ব্যর্থতা ঢাকবার জন্যে। তা না হলে তো স্বাধীনতার পরই ওদের বিচার হওয়া উচিত ছিল।
প্রশ্ন ঃ তাহলে ১৫ আগষ্টকে কি আপনি জাস্টিফাই বলে মনে করেন?
উত্তর ঃ সভ্যতার ইতিহাসে সেটি হচ্ছে জঘন্যতম একটি হত্যাকান্ড। যিনি স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতায় আপামর জনগোষ্ঠিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেই মানুষটিকে ১৫ আগষ্ট হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করা হয়েছে। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, বঙ্গবন্ধু আপনি কেন ওদের বিচার করেননি। কিন্তু সে প্রশ্ন করার সুযোগতো এখন নেই। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নিন্দা সারাদেশের মানুষ সবসময় করে যাবেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর হয়তো ক্রটি ছিল, কিন্তু সেই ক্রুটির সুযোগ নিয়ে আরেকটি অপশক্তি তাকে হত্যা করে সারাদেশের মানুষের মধ্যে যে স্বপ্ন ছিল তাকে ধুলিসাত করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কী হলো? আমরা যাদের বিচার হবে বলে প্রত্যাশা করছিলাম, তারাই আস্তে আস্তে এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে আমাদেরকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছিল।
প্রশ্ন ঃ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে কোন অগ্রগতি হয়েছিল কি?
উত্তর ঃ একানব্বইয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের যৌথ নেতৃত্বে সারাদেশে একাত্তরের ঘাতক বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে। সে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু দাবি পেশ করেছিলাম। ১৯ দফা দাবি ছিল আমার। সেটি দেখেই তিনি বললেন যে আমি কীভাবে জানবো কে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ব্যতিত আমি তো কাউকে কোন সুযোগ দিতে পারবো না মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। তখনই ওনার সাথে কথা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরীর। কেননা সত্যিকার অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তালিকা বাংলাদেশে ছিল না। জেনারেল ওসমানী সাহেবের স্বাক্ষর করা সার্টিফিকেট বিতরণ করেছেন ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসাররা। তাই অসংখ্য অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারের হাতেও থাকতে পারে সে সার্টিফিকেট। সে সময় আমি তাকে জানাই যে, সর্বপ্রথম এরশাদ সাহেব একটি তালিকার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় সারাদেশের ইউনিট কমান্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার দাবিদারদের আবেদন সংগ্রহ করা হয়। সে আবেদন যাচাই করা হয়নি। আবেদনকারীদের নাম ৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালের কোন এক সময় বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আমার বৈঠক হয়। সে সময়ে আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। সে সময়ে তাঁর আগ্রহে গঠন করা হয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ব্রিগেডিয়ার আ জ ম আমিনুল হকের নেতৃত্বে। ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। সে সময়ে আরেকটি তালিকা করা হয়েছিল। যারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে নির্বাচন করবে তাদের তালিকা আর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা এক কথা নয়। ফলে সঠিক তালিকা হয়নি। তবে একটি তালিকা রয়েছে যুদ্ধের সময়ের। বিভিন্ন সেক্টরে ট্রেনিং গ্রহণকারীদের সঠিক একটি তালিকা তৈরী করা হয়। সেই তালিকা ১৯৭৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী হস্তান্তর করেছে। সর্বশেষ আমরা মুক্তি বার্তার মাধ্যমে ৮ খন্ডে একটি তালিকা প্রকাশ করেছি। প্রকাশের এক মাসের মধ্যে আপত্তি পেশের মাধ্যমে সে তালিকায় কিছুটা সংশোধনও করা হয়েছে। আমাদের সে তালিকা অনুযায়ী এক লাখ ৫৪ হাজারের মত মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান আমরা উদঘাটন করেছি।
প্রশ্ন ঃ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ নামে একটি সংগঠনের খবরাখবর দেখা যাচ্ছে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায়। এর সাথে আপনাদের কোন সম্পর্ক রয়েছে কি?
উত্তর ঃ বিশেষ একটি উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে তাদেরও রাজনৈতিক দল রয়েছে বাংলাদেশে। বিভিন্ন কারণে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে অসন্তুষ্ট। আর্থিকভাবে মহাসংকটে রয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক সুবিধার টোপ দিয়ে হউক আর অন্য কোনভাবে হউক কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে বিভ্রান্ত করা হতে পারে। অথবা অমুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েও গঠন করা হতে পারে ঐ সংগঠন। এছাড়া রাজাকার আল বদরদের নিয়েও সেটি গঠন করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
প্রশ্ন ঃ মূলধারার বাইরে বর্তমানে কতটি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন রয়েছে?
উত্তর ঃ সারাদেশব্যাপী স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন একটিই রয়েছে। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং এর ইউনিট রয়েছে প্রতিটি জেলা-উপজেলা এবং বিভাগীয় শহরে। এর বাইরে নামসর্বস্ব, প্যাডসর্বস্ব বা দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণের অভিপ্রায়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন থাকলেও থাকতে পারে, তবে সেগুলোর বাস্তবিক কোন কর্মপরিধি বা সাংগঠনিক পরিধি নেই।
প্রশ্ন ঃ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হালহকিকত সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
উত্তর ঃ সে সব প্রতিষ্ঠান দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের কোন কাজেই আসছে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব চলে গেছে অমুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
প্রশ্ন ঃ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বার্থের কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বিগত কয়েক দশকে অনেকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, অনেকের ভাগ্য খুলেছে, কিন্তু সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন ঘটেনি। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
উত্তর ঃ এটা খুবই সত্য। তবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে আপামর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো কিন্তু একেবারেই সম্ভব নয়। ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার সংখ্যা বেশী হলে ৫০ জন হবেন। এই ৫০ জনের মধ্যেও অনেকের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এতদসত্বেও এই মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে কলংকিত করার কারণ কি? এখানেও কী কারো রাজনৈতিক অভিসন্ধী রয়েছে? একটি কথা সংশ্লিষ্ট সকলের মনে রাখা দরকার যে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আয়-ব্যয়ের হিসাব যথাযথভাবে নিরুপিত হয়ে আসছে।
প্রশ্ন ঃ আয়ের উৎস কি?
উত্তর ঃ হাট-বাজারের লভ্যাংশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একাউন্টে যায়। এটা কোন গোপন কারবার নয়, প্রকাশ্যে ঢাকঢোল পিটিয়েই এ টাকা সংগ্রহ করা হয়। এরশাদের আমলে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।
প্রশ্ন ঃ বর্তমান সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
উত্তর ঃ শুরুটা ভালোই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন কেমন যেন মনে হচ্ছে। কারো কারো নাম ধরে বলা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বা পাচার করা হয়েছে। ঐ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্তদের কেউ কেউ এখন জেলে রয়েছে। তাহলে সে টাকা গেল কোথায়? সরকারের পক্ষ থেকে তা জানানো হচ্ছে না কেন? সে টাকা সরকারী তহবিলে জমা হয়ে থাকলে তা সর্বসাধারণকে জানানো উচিত।
প্রশ্ন ঃ কেন জানানো হলো না। নাকি অভিযোগগুলোই সঠিক ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানাবেন কি?
উত্তর ঃ হতে পারে অভিযোগ মিথ্যা ছিল। তবে আন্তর্জাতিকভাবেও এমন কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি যে বিদেশ থেকে সে টাকা ফেরৎ আনা যাবে।
প্রশ্ন ঃ এমনও কী হতে পারে না যে আরেকটি দুর্নীতির সাথে বর্তমান সরকার জড়িয়ে পড়েছে?
উত্তর ঃ সরকার যদি প্রমাণ করতে না পারে তাহলে তো এ অনুমানও মানুষের মনে রয়েই যাবে।
প্রশ্ন ঃ উচ্চ পর্যায়ের একজন রাজনীতিক/ব্যবসায়ীর বাসা থেকে দুই বোতল মদ উদ্ধারের চার্জ গঠন করা হয়েছে। অপরদিকে কারো কারো বাসায় শত শত বোতল মদ রয়েছে-তাদেরকে ধরা হচ্ছে না। এভাবে যদি অভিযান চালানোর পর চার্জ গঠন করা হয় তাহলে সেটির গ্রহণযোগ্যতা কতখানি থাকবে বলে মনে করেন?
উত্তর ঃ সব সরকারের মধ্যেই কিছু কিছু লোক থাকে যাদের অদূরদর্শিতার কারণে সরকারের ভালো মানুষগুলোকেও অপবাদ সইতে হয়, সরকারের ইমেজও ক্ষুন্ন হয়। তবে দুই বোতল মদের জন্যে কাউকে গ্রেফতার করা বা চার্জ গঠনকে সর্বসাধারণ যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করেন না।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশের বড় দুটি দলের শীর্ষ নেত্রী এবং সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারের ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? চার্জ গঠনের আগেই তাঁদেরকে জেলে নেয়ার ঘটনাকে কি আপনি যথার্থ মনে করেন?
উত্তর ঃ এটা জাস্টিফাইড কিনা তা বলার আগে, ইতিপূর্বে যাদেরকে ধরা হয়েছে বিভিন্ন অভিযোগে, তার প্রায় সকলেই কিন্তু এই দু’দলেরই নেতা। জামায়াতে ইসলামীর নেতাকে তো এই সেদিন ধরলো। যে দুর্নীতিবাজদের ধরার কথা বলে সরকার সুনাম কুড়িয়েছেন, এখন সেই চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের দুই নেত্রী যদি বাইরে থাকেন তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ওনারা যে কোন আন্দোলনের ডাক দিতে পারেন। এজন্যে তাদেরকে বাইরে রাখা হয়নি বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন ঃ তাহলে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন যে এই দুই নেত্রীকে বর্তমান সরকার ভয় পাচ্ছে? উত্তর ঃ ভয় পাচ্ছে এভাবে যে, ওনারা যদি বাইরে থেকে আন্দোলন রচনা করেন, তাহলে যাদেরকে ধরা হয়েছে তাদের বিচার করা সম্ভব হবে না। যেমন ধরুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। শিক্ষকদেরকে ছাড়তে হয়েছে। এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো আন্দোলন এই দুই নেত্রী ছাড়া গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন ঃ স্বাধীনতার পরের ৩৭ বছরে যারা কোনদিনই নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি, জাতীয় সংসদে যেতে পারেননি-মন্ত্রিত্ব গ্রহণ দূরের কথা-এমন শ্রেণীর কিছু লোক হচ্ছে বর্তমান সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ-এর কারণ কী?
উত্তর : এর দুটি কারণ হতে পারে। ইতিপূর্বে যারা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সরকারের কাছে, এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে-এটাও একটা কারণ হতে পারে। যারা কখনোই ক্ষমতায় যেতে পারেননি তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তেমন একটা থাকার কথা নয়। এজন্যেই হয়তো অভিযোগ নেই এমন লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন, কথাবার্তাও বলছেন।
প্রশ্ন : কিন্তু এই শ্রেণীর লোকজনের সাথে তো জনগণের কোন সম্পর্ক নেই।
উত্তর : সরকার খুঁজছে জনগণের সাথে যাদের সম্পর্ক রয়েছে তাদেরকে সামনে নিয়ে আসার জন্য-এটাও হতে পারে।
প্রশ্ন : জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কী?
উত্তর : একাত্তরে তাদের যে পরিচয় ছিল তার উর্দ্ধে ওরা এখনও উঠতে পারেনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তারা পাক হায়েনাদের পক্ষে কাজ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি ভূমিকায় ছিল, মুক্তিকামী লাখ লাখ মানুষকে হত্যার ইন্ধন জুগিয়েছে, পাক বাহিনীকে নারী ধর্ষণে, আমাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠনে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগে সহায়তা করেছে। ওরা আগে যা করেছে এখনও তাই করছে। মাঝেমধ্যে পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে কিছু ভিন্ন কথা বললেও প্রকৃত অর্থে তারা একাত্তরের অবস্থানেই রয়েছে।
জামায়াতীরা এখনও ৭১’র অবস্থানেই রয়েছে
ঠিকানাকে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী