জামায়াতে বিভক্তি সংকটে বিএনপি

নিজস্ব প্রতিনিধি : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে ব্যারিস্টার ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের মাধ্যমে দলটিতে ভাঙনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। দলের তরুণ নেতৃত্ব, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধকালে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও স্বাধীনতার পর জন্মলাভকারী অনেকেই জামায়াত-শিবিরের শীর্ষস্থানীয় পদে এবং কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। ব্রিটেনে থেকেও ব্যারিস্টার রাজ্জাক এদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আসছেন। তার পদত্যাগের ঘোষণা নিতান্তই ব্যক্তিগত নয়। দলের সমমনাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলার পরই তিনি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের অনুগামী হবেন তারা। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিক বিভক্তিতে যাচ্ছে, যা জামায়াতের চেয়েও অনেক বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে বিএনপিকে।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও তার সহযোগীরা ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী দলের নেতাদের বিপক্ষে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান। তারা জামায়াতকে তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশবাসীর কাছে আন্তরিকভাবে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা ও দলের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটানোর পক্ষে। অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র ব্রিগেডিয়ার (অব.) আজমীও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত। কিন্তু জামায়াতের আমির, জেনারেল সেক্রেটারিসহ মুক্তিযুদ্ধকালে এবং পরবর্তীতেও নেতৃত্বে থাকা প্রবীণ নেতারা নাম পরিবর্তন ও জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিপক্ষে। পাক হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সহযোগীর ভূমিকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধা, নিরীহ মানুষ, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, বাস্তুভিটা ত্যাগ করতে বাধ্য করার মতো চরম মানবতাবিরোধী অপরাধকে তারা ভুল, পরিস্থিতির শিকার বলতেও রাজি নন। ব্যারিস্টার রাজ্জাকসহ অভিন্ন মতের অনুসারীরা এ অবস্থায় পৃথক অবস্থান ঘোষণা করেছেন। নতুন নামে তারা নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটাবেন। তারা বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নাও হতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের প্রবীণ নেতাদের নেতৃত্বাধীন জামায়াতই হবে ২০ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে বিএনপির প্রধান সহযোগী। এ অবস্থাটা বিএনপিকে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহসহ সাধারণ মানুষের কাছেও বিএনপিকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করবে।
সরকারের জামায়াত-শিবিরবিরোধী লাগাতার কঠোর অবস্থানে বিপর্যস্ত জামায়াত অনেক দিন থেকেই আত্মরক্ষার পথ খুঁজছে। দলগতভাবেই তাদের পরস্পর বৈরী সিদ্ধান্ত দলটির নেতা-কর্মীদের হতাশ করছে। বিএনপিতে জামায়াত বিরোধিতা তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। জামায়াত নেতৃত্বের একটি অংশ এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিএনপির সাথে গাঁটছড়া ছিন্ন করার পক্ষে। তারা ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। তারা জামায়াত নাম পাল্টে নতুন নামে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটানোর পক্ষে। দলের সিনিয়র নেতারা এর বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা মনে করেন, এতে জামায়াত চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবে। বিগত দিনের নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন ও অসম্মান করা হবে। নেতৃত্বের এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যেও দলের কয়েকজন নেতা একটা আপসরফার চেষ্টা করছেন। জামায়াত নাম অপরিবর্তিত রেখে প্রয়োজনীয় গঠনতান্ত্রিক সংশোধনী আনার পক্ষে তারা। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। বিরাজমান বাস্তবতায় এর বিকল্প নেই এবং ৭১-এর ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখানোর মাধ্যমে তারা দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন পাবেন বলেও মনে করেন। তাদের বিশ্বাস, সেক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে তাদের প্রতিই মানুষ অধিক হারে আগ্রহী হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রধান জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে তারা আস্থাশীল। তারা মনে করেন, বিএনপির অসম্মানজনক আচরণ মেনে নিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার চেয়ে বিএনপিই তাদেরকে কাছে টানতে অনেক বেশি আগ্রহী হবে। এমনকি বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী তাদের দলে যোগ দেবেন। সরকারের রোষানল, অত্যাচার, নির্যাতন থেকে বাঁচার এবং দলের রাজনীতি ও দলকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় বলে তারা মনে করেন।
জামায়াতের জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রের বর্তমান নেতৃত্বের একটি অংশ এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের বৃহত্তর অংশের নেতারা এই মতের পক্ষে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত আবেদন জামায়াতের আমির বরাবর পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। গত ডিসেম্বরের গোড়ায় দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে মত আসে। দলের নাম পরিবর্তনের কথাও বলা হয়। তাদের এ মতামত নিয়ে পরবর্তীতে মজলিসে শুরার পূর্ণাঙ্গ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানান দলটির আমির। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সিদ্ধান্তের আলোকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জামায়াত সূত্রে জানা যায়, আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ নেতৃত্ব দলের নাম পরিবর্তনের পক্ষে নন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ভূমিকার জন্য প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশের ক্ষেত্রেও কৌশল নেওয়ার পক্ষে। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর চাপের মুখে তাদেরকে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা নিতে বাধ্য করে বলে উল্লেখ করতে চান। যুদ্ধাপরাধের দায় ও সরকারের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য জামায়াতের নেতাদের ভূমিকা চাতুর্যপূর্ণ কি না সরকার তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ২০১৩ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। সেই থেকে দলটির ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চলতে শুরু করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশব্যাপী নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী কার্যকলাপের জন্য জামায়াতের নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত হন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা দিশেহারা অবস্থায় রয়েছেন। বিএনপির সঙ্গে রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হওয়ার মতো শক্তি, মনোবল তাদের নিঃশেষ প্রায়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের আন্দোলন কর্মসূচিতে তাদের সক্রিয় সমর্থনও নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতের আমির, জেনারেল সেক্রেটারিসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার, দ- কার্যকর করার পর জামায়াতের বিএনপির কাছ থেকে ন্যূনতম সহানুভূতি না পাওয়ার ঘটনা জামায়াত-শিবিরের সকল পর্যায়ের নেতাদের হতাশ ও অসন্তুষ্ট করে। তার পরও জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু বিএনপি কর্তৃক জামায়াতকে অবজ্ঞা, অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে বলে দলটির নেতারা অভিযোগ করছেন। জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতাদের বিরূপ মন্তব্য, ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং ফ্রন্ট নেতাদের জামায়াতবিরোধী তীব্র আক্রমণাত্মক বক্তব্য জামায়াত নেতাদের দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। বিশেষ করে, ড. কামালসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের প্রকাশ্যে জামায়াতের কঠোর সমালোচনার পরও বিএনপির নির্লিপ্ততা জামায়াত নেতাদের হতাশ করেছে। জামায়াতকে এড়িয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা এতে বিএনপি ও ২০ দলের কী রাজনৈতিক ফায়দা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
ড. কামাল, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আ স ম রবসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের জামায়াতবিরোধী বক্তব্য বন্ধ করা, বিএনপির নেতাদের এতে আপত্তি জানানোর দাবি জানিয়েছেন জামায়াতের তরুণ সংস্কারবাদী নেতারা। অন্যথায় তারা ২০ দলীয় জোটে না থাকার চাপ দিচ্ছেন। বিএনপির নেতারা মনে করেন, সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতায় এসেই তারা এ ভূমিকা নিচ্ছেন। তাদের নেতৃত্বে জামায়াত রাজনৈতিক-সাংগঠনিকভাবে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলেও তারা মনে করেন। এর পেছনে সরকারি মদদ থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন দলটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা। আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের আগেই জামায়াতের নতুন রূপ দেখা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা নিয়ে জামায়াতের মধ্যে কথা চলছে। এদিকে যেকোনো পরিস্থিতিতে জামায়াত যাতে ২০ দলের বাইরে চলে না যায়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে কারাবন্দী চেয়ারপারসনের কাছ থেকে নির্দেশনা এসেছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা যায়। দলীয়ভাবে তাদের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে উন্নত সম্পর্ক গড়ে তুলতে বলা হয়েছে। কিন্তু জামায়াতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে বিএনপি কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছে না। অনেক বিএনপি নেতা তাতে আগ্রহীও নন।
জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের নাম পরিবর্তনের যে কথা বলছেন তা নিতান্তই সংস্কারপন্থীদের বিভ্রান্ত করার কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে। নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দুই বছর আগেই দেওয়া হয়েছিল। দলের আমির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। এখন সংস্কারবাদীদের চাপের মুখে দলের নাম পরিবর্তনসহ গঠনতান্ত্রিক সংশোধনীর কথা বলছেন। জামায়াত সূত্রে জানা যায়, শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে বিলুপ্ত না করে তার সকল রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখা হবে। ভিন্ন এক আধুনিক নামে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নসহ সর্বস্তরের কর্মীদের তার ছায়াতলে আনা হবে। রাজনৈতিক কর্মকা- চালানো হবে সেই সংগঠনের নামে। জামায়াত থাকবে গোপনে, ধর্মীয়, সমাজসেবামূলক কাজ পরিচালিত হবে। কিন্তু সরকার তীক্ষè দৃষ্টি রাখায় তারা সে সুযোগ পাবে না। সংস্কারপন্থীরা কোনোভাবেই জামায়াত নামই রাখার পক্ষে নয়।