বিশেষ প্রতিনিধি : সরকারের কাছে জামায়াত-শিবির আপাতত জঙ্গি নয়। দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। দলটি সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে। নির্বিঘেœ ক্যাম্পেইনও করছে। কদিন আগেও জামায়াত-শিবিরের দু-চারজন লোক কোথাও বসলে ‘গোপন মিটিং’ নাম দিয়ে গ্রেফতার করে বলা হতো, নাশকতার পরিকল্পনা করছিল তারা। কিছু জেহাদি বইপত্র উদ্ধার, কয়েকটি মোবাইল ফোন সেট একসঙ্গে করে ছবি তুলে প্রচার করা হতো আইএস, মোসাদ, ইসরাইল, মিসর ইত্যাদি কানেকশনের কথা। এখন চিত্র পাল্টে গেছে। রাজশাহী ও বরিশালে প্রার্থী না দিয়ে নীরব থাকার সরকারি নির্দেশনা ও প্যাকেজ মতো এগোচ্ছে জামায়াত। দলটির নেতা-কর্মীরা এ দুই সিটিতে নির্বাচনী তৎপরতা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখে ঘোরাফেরা করছেন বুক ফুলিয়ে। কোথাও পুলিশ তাদের ডিস্টার্ব করছে না।
এসবের নেপথ্য রহস্য বেশ চাঞ্চল্যকর। জামায়াতকে দিয়ে তিন সিটি নির্বাচনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রিহার্সাল দিতে চায় সরকার। জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার এত দিনের গুঞ্জন বাস্তব হতে চলেছে। নির্বাচনের খরচ ছাড়াও জামায়াতকে দেওয়া হয়েছে কমিশনের নিবন্ধন, ৩০ আসন, দিগন্ত টিভি খুলে দেওয়া, একটি দৈনিকের ডিক্লারেশন, ইসলামী ব্যাংক নিয়ে আর টানাহেঁচড়া না করার বিগ অফার। নতুন করে আর কোনো মামলা না দেওয়া এবং পুরোনো মামলা নিষ্ক্রিয় করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এসব অফারের আওতায় সরকারের কঠোর অবস্থান, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ফাঁসিসহ নানা দ-, দল নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি থাকছে না। জামায়াত নেতাদের একাংশ সরকারের এসব টোপ এরই মধ্যে প্রায় গিলে ফেলেছেন। আরেক অংশ দোদুল্যমানতায়। তৃতীয় একটি অংশ এতে ক্ষুব্ধ-ব্যথিত। তাহলে আরো আগে কেন এমন বোঝাপড়ায় গিয়ে শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদ-সহ বাকিদের চরম নিপীড়ন থেকে বাঁচানো হলো না, এমন কঠিন প্রশ্ন তাদের। ৫ জানুয়ারির আগে-পরেও জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা চেয়েছিল সরকার। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদ-ের রায় এবং রায় কার্যকরের আগে-পরেও এ টোপ অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীদের বক্তব্যে সমঝোতার বিষয়টি উড়িয়ে দিলেও জামায়াত এ ব্যাপারে নীরব থেকেছে। হ্যাঁ-না খোলাসা করেনি।
মগবাজারে কেন্দ্রীয়, পল্টনে মহানগর জামায়াত ও শিবিরের কেন্দ্রীয়সহ দেশে দলের প্রায় সব কার্যালয় সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই নেতা-কর্মীদের। নিষিদ্ধ দলের মতোই চলছে জামায়াতে ইসলামী। প্রায় সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধেই মামলা। দলটির নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি বেশ চাতুরীর সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির নিঃশব্দে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে কিছু নেতা-কর্মীর প্রকাশ্য তৎপরতাও লক্ষণীয়। দলের নেতাদের বাসায় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০ দলীয় জোটের মূল দল বিএনপিও জামায়াতের ব্যাপারে সাবধানী হয়ে গেছে। সরকারি টোপ গেলার সুনির্দিষ্ট তথ্যের আলোকে বিএনপি মোটামুটি নিশ্চিত, এবারের যাত্রায় জামায়াতকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। বেশি আমল দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টায়ও না যাওয়ার পক্ষে বিএনপি নেতৃত্ব। আবার ঘোষণা দিয়ে বিদায়ও করতে চাচ্ছে না।
জামায়াতের মৃত্যুদ-িত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের পরিবার থেকে বিএনপিকে জানানো হয়েছে, জামায়াতের এ প্রক্রিয়ার ঘোরতর আপত্তি ও ক্ষুব্ধ তারা। মরহুম গোলাম আযম ও যাবজ্জীবন দ-িত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরিবারের বার্তাও এমনই। বাস্তবতার এ সন্ধিক্ষণে জামায়াতকে নিয়ে বেশি চর্চার চেয়ে বি. চৌধুরী, ড. কামাল, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের জোটে আয়ত্ত করাকে জরুরি ভাবছে বিএনপি। কারাগার থেকে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশাও সে রকমই। দলের নেতা-কর্মীদের মানসিক প্রস্তুতিও তেমনই। বিএনপির নেতা-কর্মীদের কারো কারো মূল্যায়ন, জামায়াতের এ ডিগবাজিতে বিএনপির ওপর থেকে একটি বোঝা নামবে। সেই সঙ্গে বিএনপিই হয়ে উঠবে জামায়াতের মাঠপর্যায়ের ত্যাগী-ক্ষতিগ্রস্ত নেতাদের স্থায়ী অবস্থান।
জামায়াতের পথচলাটা এমনই। এমন নাম-বদনাম, ব্যবহার-অপব্যবহারে অভ্যস্তও হয়ে গেছে দলটি। বাংলাদেশে সংসদীয় রাজনীতিতে জামায়াতের অভিষেক আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলমিশেই। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে বিরোধী দলগুলো যখন এককাট্টা, তখন বলা হয়েছিল, এরশাদের অধীনে যে নির্বাচনে যাবে, সে হবে জাতীয় বেইমান। ওই রকম সময়ে বিএনপিকে মাঠে ফেলে রেখে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচন করে জামায়াতে ইসলামী। বোঝাপড়ার বিরোধী দল হয় আওয়ামী লীগ। জামায়াত পায় ১০ আসন। একপর্যায়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছায়। ঝোপ বুঝে আওয়ামী লীগের আগেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে রাজপথে এসে বিএনপির পাশে জায়গা করে নেয় জামায়াত।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে মিউচুয়াল আন্ডারস্টান্ডিং। বিনিময়ে সংরক্ষিত নারী আসনে দুটি আসন। বছর তিনেকের মধ্যেই বিএনপির সঙ্গে গোলমাল। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিতালি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলমিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও, হরতালে ব্যাপক শক্তি ক্ষয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পাশে বসে বড় বড় সংবাদ সম্মেলন। অন্য রকম ভাবসাব নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানদের। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারাও জামায়াত নেতা গোলাম আযমকে সম্মান দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হয় বিএনপি সরকার। ৯৬-তে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ সরকারের মারের তোড়ে আবার বিএনপির আশপাশে জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে আবার গাঁটছড়া। ক্ষমতার স্বাদ।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বিশেষ কৌশলে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায়। শুরু হয় জামায়াত নেতাদের বিচার। জামায়াত মানেই যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক, আইএস, জঙ্গি ইত্যাদি। রাস্তায় নামা দূরে থাক, পার্টি অফিসও তালা দেওয়া। নেতাদের বেশ কজন দুনিয়াছাড়া। কিছু দেশছাড়া। ঘরছাড়া অনেকে। ছ্যাঁচা মারের মধ্যেও জামায়াত জোটগতভাবে রয়েছে বিএনপির সঙ্গে। মফস্বল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের কিছু কিছু আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। কিছু কিছু জায়গায় টিকে আছেন ভাগেযোগে। এর মাঝেই সিলেট সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জামায়াত। এর সুবাদে জামায়াত-শিবির জঙ্গিও হচ্ছে না গোপন মিটিংও করছে না, পুলিশও পাচ্ছে না পেট্রল বোমা বা জিহাদি বই।
বিএনপি সূত্র বলছে, সীমাহীন নির্যাতনের মধ্যেও জামায়াত যে ধৈর্য ও নৈতিকতার প্রমাণ দিয়েছে, এখন তা থেকে বিচ্যুত হয়ে দলটি আত্মহননের পথে নেমেছে। আদর্শ ও নৈতিকতার প্রশ্নে এটি জামায়াতের জন্য আত্মবিনাশী। বিএনপির জন্য সাময়িক অস্বস্তিকর এবং আওয়ামী লীগের জন্য সুপার গেম হলেও আবার নিশ্চিত জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে হিটলিস্টে পড়বে জামায়াত।