বিশেষ প্রতিনিধি : দূর ভবিষ্যতে টেনশন থাকলেও জামায়াতকে আপাতত খরচের খাতায় ভাবছে দলটির প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো। ক্ষমতাসীনরা ছাড়াও বিভিন্ন মহল এ ভাবনায় বেশ তৎপর। কৌশলসহ সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেও জামায়াত শিগগিরই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না বলে ধারণা তাদের। সাম্প্রতিক মিত্র হলেও সময়ে সময়ে ডিস্টার্ব হিসেবে আবির্ভূত হওয়া তাবলিগকেও বিভক্তির মাধ্যমে আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়েছে। অরাজনৈতিক এ প্ল্যাটফর্মটির আর এক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাবলিগের জোশ-জৌলুশ চলে গেছে ইতিহাসের তালিকায়। বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মীয় মোড়কের আরেকটি শক্তিশালী গোষ্ঠী জাকের পার্টির বিভক্তিও এখন সময়ের ব্যাপার। এর প্রাক্্-আয়োজনও চূড়ান্ত।
ইসলামপন্থী দলগুলো নিয়ে সরকারের ব্যতিক্রম কৌশল ফলদায়ক হয়েছে আরো আগেই। নানা চমকে জামায়াত বাদে দক্ষিণমুখী বাকি শক্তিগুলোকে সরকার নিজস্ব বলয় ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে বিশেষ কর্মকৌশলে। দক্ষিণপন্থী কোনো কোনো দল ও নেতা তা উতরানোর চিন্তা করলেও সামর্থ্য-প্রস্তুতি কোনোটাই আপাতত নেই তাদের। এসব দলের মধ্যে বিরোধ স্থায়ী রাখার পাশাপাশি হেফাজতকে শক্তিমান করতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারি ঘরানা, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক, স্বতন্ত্র ধারাসহ সব ইসলামি দলে দৈন্যদশা তৈরির পাশাপাশি সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে সরকার। আওয়ামী লীগে ভর করা দল ও নেতারা টিকে আছেন ভাগেযোগে। স্বাবলম্বী শুধু হেফাজতে ইসলাম। একসময় যেমনটি ছিল জামায়াতের।
গত বছর কয়েক ধরে জামায়াতের বিপরীতে হেফাজতকে বলীয়ান করতে যোগ হচ্ছে নানা প্রাপ্তি। পরিকল্পনামতো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে হেফাজতের সমালোচিত ক্রিয়া-কলাপের খবর। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেফাজতের দর্শন জামায়াতের চেয়েও পশ্চাৎপদ। ভয়ংকর। কয়েক দিন আগেও হেফাজতের আমির মেয়েদের ক্লাস ফাইভের বেশি না পড়ার ফতোয়া দিয়েছেন। বারণ করেছেন নারী-পুরুষ একসঙ্গে পড়াশোনা না করার। বলেছেন, নারী রোগীরা চিকিৎসার জন্য পুরুষ ডাক্তার না দেখাতে। আওয়ামী লীগ থেকে কিছুদিন আগেও বলা হতো বিএনপি, জামায়াত-হেফাজত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর হেফাজতের কান্ডারি মাওলানা শফিকে ডাকা হতো তেঁতুল হুজুর নামে।
আবার এই হেফাজতই বিএনপির মদদে ২০১৩ সালে রাজধানীতে তা-ব চালিয়েছে। সেই হেফাজতকে শুধু জব্দই নয়, আয়ত্তেও নিয়েছে আওয়ামী লীগ। হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শোকরিয়া জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন কওমি জননী খেতাব। তারা পাঠ্যপুস্তকও পাল্টে নিয়েছে সরকারকে দিয়ে। হেফাজতের দাবি মেনে সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকেও কথিত ‘অনৈসলামিক’ রচনাগুলো বাতিল করে দেয়। এমনকি তাদের সমাবেশের সুবিধার্থে পাবলিক পরীক্ষাও স্থগিতের নজির পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। কোনো শব্দ হয়নি আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ প্রগতিশীল মহল থেকে।
বিএনপির ডানপন্থী মিত্রদের অনেকেও এখন আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে রয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো দলগুলো। প্রচ-ভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট অনেক দিন থেকে বিএনপির সঙ্গে নেই। খেলাফত মজলিসের একাংশও ছুটে গেছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থী ১১টি। আর নিবন্ধনের বাইরে তাদের সংখ্যা অগুনতি। হেফাজতে ইসলামসহ এ ধরনের দল শত শত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে থাকা একমাত্র ইসলামি দল বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন।
সাধারণ মুসল্লিরা চাইলেও বিশ্ব ইজতেমায় আর ঐক্যবদ্ধভাবে হওয়ার লক্ষণ নেই। মাওলানা জোবায়ের ও সাদপন্থীদের বিরোধের পেছনে ক্ষমতাসীনরা ছাড়াও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বার্থবাদী মহলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। মুরব্বি-জিম্মাদারসহ তাবলিগের বিভিন্ন পর্যায়কেও বিভক্তিতে জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে ঠান্ডা পরিকল্পনায়। বিরোধ ও সহিংসতায় সবাইকে একাত্ম করতে সফল হয়েছেন নেপথ্য আয়োজকেরা। অর্থনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তানসহ নানা উপাদান যোগ করে বিরোধকে স্থায়ী জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। ২০১৭ সালে এর চূড়ান্ত প্রকাশ পেলেও ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল আরো আগে থেকেই। তাবলিগ জামায়াতের কেন্দ্রশক্তি কাকরাইল মসজিদের কর্তৃত্ব, হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতি, প্রতিবাদে সাদ কান্দালভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় বেশ সূক্ষ্ম কৌশলে।
ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলিগের নেতৃত্বে বিভক্তির অনুকরণে বাংলাদেশেও তা চাঙা করার পেছনে সরকারপক্ষের কৌশল সফল হয়েছে। এ সাফল্যের হকদার কয়েকজন হেফাজত নেতাও। সংগত কারণেই হেফাজত বাদে অন্য দক্ষিণপন্থীদের গুরুত্ব দিয়ে কাছে রাখার দরকার মনে করছে না সরকার। মিত্র হওয়ার পরও রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কাটানোর ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা না পেয়ে মনঃকষ্টে ভুগছেন আটরশির পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সল।
দলটির মধ্যে পীরের দুই ছেলের দ্বন্দ্ব চলছে অনেক দিন থেকে। মোস্তফা ফয়সলের আবদার ছিল প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে যেভাবে এরশাদের জাতীয় পার্টির বিরোধ মিটিয়ে দেন, জাকের পার্টির ক্ষেত্রেও সে ধরনের কিছু করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের তরফ থেকে তেমন সাড়া আসেনি। বরং ভাই পীরজাদা মাহফুজুল হকের সঙ্গে বিরোধ চাঙার পেছনে আওয়ামী লীগের একটি মহলের ইন্ধন আঁচ করেছেন ফয়সল। মুরিদদের বিভ্রান্ত করতে খরচপাতির ঘটনাও রয়েছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জাকের পার্টির নেতা-কর্মী ও বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে কর্মরত কর্মী, খাদেমদের নিয়ে বিভক্তি, পাল্টাপাল্টি প্রশ্নোত্তর, দোষারোপ জমে উঠেছে। মিয়াজান-মেজ ভাইজানের কে আসল উত্তরসূরিÑএ প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠেছে। এ আগুনের মধ্যে ঘি ঢেলে দিয়েছেন পীরের এক নাতি ড. সায়েম আমালী ফয়সাল। তিনি আমির মোস্তফা ফয়সলের ছেলে। জাকের পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানও তিনি।
নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে সায়েম রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। জানিয়েছেন, তার দাদা খাজাবাবা ফরিদপুরী কেবলাজানের তিলে তিলে গড়ে তোলা বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আজ ষড়যন্ত্রের শিকার। সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। স্থানীয় পেটোয়া বাহিনী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক গুন্ডাদের তৎপরতার কথাও লিখেছেন। জাকের পার্টি, এর সহযোগী সংগঠন বিশেষ করে জাকের পার্টি মহিলা ও ছাত্রীফ্রন্টের মা-বোনদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের কথাও বাদ পড়েনি পীরের নাতির স্ট্যাটাসে। ‘আপনাদের কাছে বিচার চাই’ শিরোনামে প্রচারিত তার স্ট্যাটাসটি জাকের পার্টির নিভু নিভু রাজনীতিকে আরো নেভানোর পথেই নিচ্ছে বলে ধারণা মুরিদ ও জাকেরানদের।