জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণে আমাদের করণীয়

মুহম্মদ শামসুল হক :

১১ এপ্রিল মঙ্গলবার সন্ধ্যাগমে রোজাদার মুসলমানদের জীবন থেকে পবিত্র মাহে রমজানের মাগফিরাতের অধ্যায়ের ইতি এবং একই তারিখ সন্ধ্যা থেকে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ের শুভসূচনা হচ্ছে। সাওম পালনকারীদের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার রহমত লাভের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সর্ববিধ অপরাধের জন্য অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা। অবশ্য চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে এবং আশরাফুল মাখলুকাতের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে হরহামেশা নানা ধরনের পাপাচারে লিপ্ত রয়েছি। এ অবস্থায় পরকালীন আজাব-গজব এবং জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর অপরিসীম রহমত ও মাগফিরাতই আমাদের একমাত্র পাথেয়। অনবদ্য কারণে রোজাদারদের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে মাগফিরাতের অধ্যায়ের বাদবাকি দিবা-রজনী যথাসম্ভব আল্লাহর স্মরণে কাটানো এবং নিজেদের সাগর পরিমাণ পাপরাশির জন্য অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও অশ্রুবিগলিত নয়নে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।

জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ : পবিত্র কোরআনের সুরা মুলকসহ বিভিন্ন আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে, বসবাসের জন্য জাহান্নাম অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান। তাই সাওম পালনকারীদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বপ্রতিপালকের অপরিসীম করুণা লাভের মাধ্যমে আখিরাতের আজাব-গজব এবং জাহান্নামের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের কবল থেকে মুক্তি।

এ জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ও তওবা-আস্তাগফারসহ যাবতীয় অপরাধের জন্য মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর রহমত কামনা করা। তবে ক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় র‌্যাশনালিটি বা হিতাহিতজ্ঞান বা মনুষ্যত্ববোধের অপমৃত্যু এবং অ্যানিমেলিটি বা পশুত্ব শক্তির উন্মেষ ঘটলে সমাজ-রাষ্ট্র এবং বিশ্বে নৈরাজ্য বা চরম অস্থিরতা তথা মাৎস্যন্যায় দশার সৃষ্টি হয়।

আর পবিত্র কোরআনের সুরা আন-আমে বলা হয়েছে, ধর্মের সান্নিধ্যবঞ্চিত মানুষ দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না, এমনকি চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও অধম। মূলত অপরাধপ্রবণতা মানুষের মনুষ্যত্বের দর্পণের ওপর ময়লার আবরণ ফেলে এবং সময়ের অগ্রযাত্রায় থমথমে বার্নিশ করা কালো ময়লার প্রলেপ মানুষের মনুষ্যত্ববোধের দর্পণকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলে। ফলে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পরিচিত মানুষ পশুর চেয়ে অধম এবং নরকের কীটে পরিণত হয়। পবিত্র কোরআনের চতুর্দশ অধ্যায়ের সুরা নহলের ১০৭, ১০৮ ও ১০৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা পার্থিব জীবনকে পরকালের তুলনায় অতিশয় ভালোবেসেছে; আর এ কারণে হবে যে আল্লাহ তায়ালা এরূপ কাফেরদের হেদায়েত করেন না।
এরা ওই সকল লোক, আল্লাহ যাদের অন্তকরণ, কর্ণ ও চোখে মোহর (আবরণ) লাগিয়ে দিয়েছেন, আর এরা (স্বীয় পরিণাম সম্পর্কে) একেবারেই গাফেল বা উদাসীন। এটি অনিবার্য যে পরলোকে এরাই সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনাচরণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অনায়াসেই আমরা নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারি। অথচ আদি পিতা আদম এবং তাঁর বংশদের জাগতিক অবস্থান পবিত্র কোরআনের অষ্টম অধ্যায়ের সুরা আল-আরাফের ২২, ২৩, ২৪ ও ২৫ নং আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, অনন্তর তাদের উভয়কে (আদম ও হাওয়া) ধোঁকা দিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিচে নিয়ে এল; তৎপর যেই মাত্র উভয়ে বৃক্ষটির ফল আস্বাদন করলেন (তৎক্ষণাৎ) তাদের আবৃতাঙ্গ পরস্পরের সম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং উভয়েই বেহেশতের পত্রপল্লব নিজেদের দেহে সংযুক্ত করে (গোপনাঙ্গ লুকোতে) লাগলেন।

এবং তাদের রব তাদের আহ্বান করে বললেন, আমি কি তোমাদের উভয়কে এই বৃক্ষের ফল (ভক্ষণ করতে) নিষেধ করিনি; এবং আমি কি এও বলিনি যে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। উভয় বললেন, হে আমাদের রব (প্রতিপালক), আমরা নিজেদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছি; আর যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে অবশ্যই (আমাদের) অতিশয় ক্ষতি হবে। আল্লাহ বললেন, তোমরা নিচে যাও এমন অবস্থায় যে পরস্পর কিছুসংখ্যক অপর কিছুসংখ্যক দুশমনের মধ্যে কাল কাটাবে এবং তোমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকা বা বসবাসের স্থান ও লাভবান হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। (আল্লাহ) আরও বললেন, সেখানেই তোমরা জীবনযাপন করবে এবং সেখানেই মরবে এবং তথা থেকে বের করা হবে। অতএব, জগতে আমাদের আগমন, মৃত্যু, পরকালীন হিসাব-নিকাশ, কার্যানুরূপ ফল ও পাপানুরূপ শাস্তি ইত্যাদি পূর্বনির্ধারিত এবং অবধারিত। লাখো প্রচেষ্টায়ও আদম সন্তান-সন্ততিদের জীবনে এর বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটবে না। পবিত্র কোরআনের ৭ম ও ৮ম অধ্যায়ের সুরা আন-আমের ১০২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ইনিই আল্লাহÑতোমাদের রব, তিনি ভিন্ন কেউই ইবাদতের যোগ্য নন; তিনিই সকল বস্তুর স্রষ্টা।

অতএব তাঁরই ইবাদত করো। বস্তুত তিনিই সকল বিষয়ের কার্যনির্বাহক বা সম্পাদক। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাদি আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না, মনোরাজ্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটে না। জাগতিক মোহাবিষ্ট ও ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিম ক্ষণস্থায়ী পার্থিব সুখ আহরণের নামে ইচ্ছাকৃতভাবেই পরকালীন পাথেয় সংগ্রহকে সজ্ঞানে উপেক্ষা করছে এবং পাপের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ অবস্থায় জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অধ্যায়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য রোজাদারদের বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণ করতে হবে।

গিবত বা পরচর্চা সর্বাংশে পরিহার করতে হবে। অপরের ক্ষতিসাধনের মনোবৃত্তি কিংবা অন্য মুসলমানের প্রতি অন্তরে অহেতুক বিদ্বেষ পোষণ বর্জন করতেই হবে। ফিতনা বা ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবং ঝগড়া-বিবাদে ইন্ধন জোগানোর স্বভাব পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠাতে হবে। সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে উদ্যত হলে তাকে সহজভাবে বলতে হবে, আমি রোজাদার। ভুরিভোজন বা রসনাপূজার ব্যয়বাহুল্য পরিহার করতে হবে এবং যথাসাধ্য ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থে অপর রোজাদার ও ক্ষুধার্তদের আপ্যায়নে সক্রিয় হতে হবে। গরিব-দুঃখীর দুর্দশা লাঘবে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আমিন!

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
৪ এপ্রিল ২০২৩।