জিয়াউর রহমান অম্লান একটি নাম

আহবাব চৌধুরী খোকন :

৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জিয়াউর রহমানের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল সেনাসদস্যের গুলিতে প্রাণ হারান। শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের একজন জাতীয়তাবাদী নেতা, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তা হয়েও তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশই নেননি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই সাহসী ঘোষণা শুনে সেদিন দেশের ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত হয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীনতাত্তোর সরকার তাঁকে বীর উত্তম পদকে ভূষিত করেছিল।

শহীদ জিয়ার জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, সত্যিকার অর্থে তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে যেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা। তাই তিনি ১৯ দফা সংবলিত একটি রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে রাজনীতিতে মেধাবী ও পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী জাতিকে অবহেলিত রেখে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি নারী জাতিকে কর্মক্ষম এবং সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

তিনি মেডিকেল কলেজসমূহে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে আইন প্রবর্তন করেন। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে জাতীয় উন্নয়নে প্রথমবারের মতো নারীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশে সর্বপ্রথম কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক কৃষিকাজে নিয়োজিত। কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাই কৃষিকে অবহেলিত রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি কৃষিকে বাংলাদেশের প্রাণ অভিহিত করে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) প্রতিষ্ঠা করেন। গবেষণাধর্মী এই ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ফলে বিভিন্ন ফসলের হাইব্রিড বীজ ও উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি প্রশিক্ষণ সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। দেশে কৃষিবিপ্লব শুরু হয় মূলত তখন থেকেই। তাই শহীদ জিয়ার শাসনামলে নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে চাল বিদেশে রফতানি শুরু হয়েছিল। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি ও পতিত না থাকে, সে জন্য তিনি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করে গ্রামে গ্রামে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, যাতে শীত মৌসুমেও মানুষ কৃষিখেত করতে পারে।

প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণে সাক্ষরতা অভিযান চালু করার পাশাপাশি স্কুল-কলেজে কর্মমুখী শিক্ষা কারিকুলাম চালু করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জিয়া দেশের উন্নয়নে যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছিলেন, তা পরবর্তী সরকারগুলো অব্যাহত রাখলে দেশ কার্যত এখন অনেক দূর এগিয়ে যেত। দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে লিখতে ও পড়তে পারে, সে জন্য তিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি চালু করেছিলেন। শিশু-কিশোরদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার পাশাপাশি বয়স্ক ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছিলেন। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া এক বছরে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় দেশের চার কোটি নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষরতা প্রদানে বিশেষ প্রকল্প (এমইপি) গ্রহণ করেছিলেন। দেশব্যাপী চালু করেছিলেন গণশিক্ষা কার্যক্রম। গ্রামে গ্রামে হেঁটে রাতের অন্ধকারে নিজে হারিকেন জ্বালিয়ে এই প্রকল্প উদ্বোধন করেছিলেন।

গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু করে মাত্র দেড় বছরে ৪০ লাখ বয়স্ক মানুষকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি পরীক্ষায় নকল দূরীকরণে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শিক্ষার প্রসারে গ্রন্থাগারকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে ‘থানা পাবলিক লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম স্থাপন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে শিক্ষা ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে ‘হিজবুল বাহার’ নামক একটি জাহাজে করে কৃতী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৮০ সালে দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করেন। তাঁর শাসনামলে মূলত দেশে মাদ্রাসাশিক্ষার বিকাশ শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে দেশে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় দেশের প্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮০ সালে জাতীয় সংসদে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় শুধু মাদ্রাসাশিক্ষার উন্নয়নে ১.২১ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করেন। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহীদ জিয়া দেশের প্রতিটি জেলায় একটি সরকারি গার্লস ও বয়েজ কলেজ এবং একটি সরকারি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগের জন্য পিএসসির মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন। উল্লেখ্য, আগে শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমলা নিয়োগ দেওয়া হতো। এর ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চপদস্থ চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো।

তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যে কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করেছিলেন, সেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় কৃষি খাত। তিনি শুধু কৃষি খাতের উন্নয়নে কাজ করেননি, দেশে শিল্পবিপ্লব সাধনে সুচিন্তিত ও বাস্তবভিত্তিক অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কল-কারখানায় ডাবল শিফট চালু ও পূর্বের সরকারের শাসনামলে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি কল্যাণমুখী ও সময়োপযোগী নানা কর্মসূচি চালু করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী একটি অবস্থান সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্যান্সারের মতো বেড়ে ওঠা দুর্নীতি নির্মূলে তিনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের নিকট কতটা গ্রহণযোগ্য ছিলেন, তা আজও বোঝা যায় তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে। তিনি রাজনীতিকে প্রাসাদের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাই জনগণ মনেপ্রাণে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে গ্রহণ করেছিল। জনহিতকর কর্মসূচি ও কার্যক্রমের কারণে শহীদ জিয়া চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকীতে আমি এই দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক, নিউইয়র্ক