জীবনগল্প মশারি

অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম : মশার ঔষধ মশারি!
ঘরের ভিতর ঘর-মশারি তার নাম।
‘ইয়া আইয়ুহাল মশায়ু, লাতা বেন বেন, আনা গরিবুন, মশারি হাড়ায়ুন।’ পরওয়ারদিগারের কাছে ক্ষমা চেয়ে পূর্বপরিচিত এক ভাইয়ের মজাচ্ছলে আবৃত দুটি পঙ্্ক্তি উদ্ধৃত করে মূল গল্পের অবতারণা করছি :

১৯৮৬ সাল, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার অবসরে চট্টগ্রামের চকবাজারের কাপাসগোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই কি তিন দিনের একটি সাংগঠনিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা-উপজেলার পরীক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করি। তারই অংশ হিসেবে চকরিয়া উপজেলার এক ভাই, সে মাদ্রাসার ছাত্র ছিল, সবাইকে হাসানোর অসাধারণ দক্ষতা ছিল তার, রাতে শোয়ার পর যখন কয়েলের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মশাগুলো মেহমানদারি শুরু করে, তখন ওই ভাই কৌতুক করে বলছিল, এই দোয়া পড়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, দেখবেন উপকার পাবেন। ওই দিন তার মুখে এই লাইন কটা শুনে সবার ঘুম হাসতে হাসতে নির্বাসনে গিয়েছিল।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের হলমেট বন্ধু ফয়সল খালেদ আশরাফীর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা ‘মশারির অতীত জীবন’ গল্পটা পড়ে অনেকের মতো আমারও কিছু মজার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। তারই ফলে মশারির এই সাতকাহন।
সেই সময়ের মশারিগুলো ছিল সুতার বুননে। সবগুলো মশারির প্রিন্টই ছিল চেক চেক। যার কালারে ছিল শুধু ভিন্নতা। সেই ছোটবেলায় অর্থাৎ সত্তর ও আশির দশকে ধনী-গরিবের মান অনুযায়ী মশারি ছিল নিত্যসঙ্গী।
ছোটকালে দেখতাম, সরকারিভাবে ডিডিটি ছিটানো হতো। এতে করে মশার উপদ্রব অনেকটা প্রশমিত হতো। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতামতের ভিত্তিতে ডিডিটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে বর্তমানে ডিডিটি ব্যবহার করা হয় না।

সেই সময়ে গ্রামাঞ্চলে মশার প্রকোপ বেশি থাকলেও বর্তমানে ফসলের খেতে কীটনাশক বেশি ব্যবহার করার কারণে অনেক কমে গেছে। গরমকালে মশার আধিক্য তুলনামূলক বেশি থাকে শীতকালের তুলনায়। তখনকার দিনে মশাবাহিত রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া ছিল উল্লেখযোগ্য। সেই সময় কুইনাইন এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার, যা গোটা বিশ্ববাসীকে মহামারি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।
বর্তমানে মশাও তার ডিজিটাল ভার্সন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ ভিন্ন ভিন্ন নামে আবির্ভূত। সেই সময়ে দিনের প্রচণ্ড খরতাপে অসহনীয় গরম, তার ওপর মশারির কারণে ভেতরে বাতাস না ঢোকার ফলে ঘুমানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। আমরা ভাইবোনেরা পালা করে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। তখন গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ছিল না। অবশ্য মধ্যরাতে প্রকৃতি শীতল হলে বা গায়ের ঘামে বিছানা ভিজে শরীর ঠান্ডা হলে কখন যে ঘুমের ঘোরে পাখাটা পাশে পড়ে যেত, টেরই পেতাম না। মশারির নিচে থাকাটা স্বস্তিদায়ক কিন্তু ঘুমের আগে মশারি টাঙানো নিশ্চয় সবার কাছে মহাবিরক্তিকর এক ঝামেলা!
গ্রামে কখনো শহরের মতো এত মশা দেখিনি। গ্রামেই বেড়ে ওঠা, যার ফলে শহরের মশার অত্যাচার সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব ছিল।

১৯৮৭ সাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশায় আমার বড় ভাইয়ের ক্লাসমেট এলাকার কামরুল ভাইয়ের সাথে, সম্ভবত জসিম উদ্দিন হল, পুকুরের দক্ষিণ পাশে নিচতলায় এক রাত ছিলাম। ডাবলিং করার কারণে এবং ভ্রমণের ক্লান্তিতে ঘুমের ঘোরে টেরই পাইনি কখন যে আমার হাত মশারির সাথে লেগেছিল। সকালে দেখি আমার বাম হাতের এক পাশ গামবিচির মতো ঝালি হয়ে আছে। হাতের এই বারোটা বাজার কারণটা আমি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে না পারলেও কামরুল ভাইয়ের বুঝতে সময় লাগেনি, ভাইটি এখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

২০১২ সাল। আমি আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে দেশে যাই। রাতে যখন তাদের মা খাটের সাথে মশারি টানাতে ছিল, তখন ছেলেমেয়ে অবাক! এটা কী! আমাদেরকে ঢেকে ফেলছ কেন? সে যে কী মজার কাণ্ড।
বর্তমানে সময়ের ব্যবধানে দেশে যে বিভিন্ন ধরনের উন্নত মানের মশারি, স্প্রে ব্যবহার হচ্ছে তা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক। বাংলাদেশেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া নিম্নবৃত্তের বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে না হলেও প্রায় এলাকায় বৈদ্যুতিক পাখার প্রচলনের ফলে সেই যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।
মশারি হারিয়ে যাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এক বড় ভাইয়ের সাথে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তিনি খুবই সহজ-সরল নিরেট ভদ্রলোক। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনারত আছেন। সেই দিনের সেই ভুল বোঝাবুঝির জন্য এখন নিজে নিজে লজ্জাবোধ হয়।

আমি তখন কলেজে পড়ি। আমাদের এলাকার যে স্কুলে আমার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছে, সেই প্রাইমারি স্কুলে বদলি হয়ে এলেন রংপুর অঞ্চলের এক ভদ্রলোক, নাম তার শহর আলী। আমাদের এলাকায় লজিং থাকতেন। তখনো এলাকায় বিজলি বাতি ছিল না এবং হেডমাস্টার স্যারের মশারিও ছিল না বা উনি হয়তো কেনার প্রয়োজন বোধ করতেন না।
উনি বাড়ির কাছারি ঘরে থাকতেন। ওখানে বাতাসের সাথে বোনাস হিসেবে মশাও ফ্রি ছিল। স্যারের মশারি না থাকার কারণে গায়ে পাতলা কাঁথা বা চাদরজাতীয় কিছু দিতেন কিন্তু গরমের কারণে মাথা ঢাকতে পারতেন না। যার ফলে মশারা স্যারকে কদমবুচি করার জন্য পা খুঁজে না পেয়ে মুখের ওপর তাদের পরশ বুলিয়ে দিত। তাই উনি (স্যার) লুঙ্গির এক পাশকে রশি দিয়ে মুষ্টি বেঁধে উপরে কিছুর সাথে ঝুলিয়ে নিচের অংশকে মশারির মতো করে মেলে দিতেন। স্যারের এই কাণ্ড দেখে সবাই মজা করত।

বনাঞ্চলে, পার্কে মশা থাকতেই পারে কিন্তু নিউইয়র্কের বাসাবাড়িতে বিগত ১৪ বছরে কখনো মশারির কথা ভাবতে হয়নি। লোকালয়ে মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আমরাই অনেকাংশে দায়ী। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ মশার বিস্তারে সহায়ক। বাংলাদেশে প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতা, সর্বোপরি জনসচেতনতার অভাবে পরিবেশ কলুষিত হয়। আর জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি বা আইন মানতে বাধ্য একমাত্র প্রশাসনই করতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রশাসনের আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল।
আমরা সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হই ও দায়িত্ব পালন করি, তাহলে মশারিকে বাংলাদেশেও জাদুঘরে পাঠানো সম্ভব বলে মনে করি।
-ব্রুকলিন।