অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
মাজার, জিয়ারত, দরগা, ওরস ও পীর-বাবা-এই শব্দগুলো বাংলাদেশ তথা এই ভারতীয় উপমহাদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সুদূর অতীত থেকে বর্তমান অবধি একশ্রেণির শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত মানুষের নিকট ভক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পুণ্যের আশায় কোনো কোনো সময় কোথাও কোথাও মাজারের খাদেম বা পীরকে খুশি করার জন্য এমন অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে তার মুরিদরা, যা শরিয়তের কোনো মাপকাঠিতে যে পড়ে না শুধু তা-ই নয়, ইসলামকে (কোরআন-হাদিস) সঠিকভাবে না বোঝার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অতি আবেগপ্রবণ মুরিদরা পীর-খাদেমদের এমনভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধার নজরানা পেশ করেন (পীর-খাদেমদের অশিক্ষা বা অজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার লোভে ও তাদের সঠিক নির্দেশনার অভাবে), যা আল্লাহর সাথে সরাসরি শিরক করার মতো। যেমন কোনো কোনো স্থানে মুরিদদেরকে তাদের পীর নামধারী ভণ্ডদেরকে সেজদা করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে পীর সাহেবদের ভূমিকা খুবই ন্যক্কারজনক, তারা কখনোই বাধা দেন না, বরং মনে হয় এটা তাদের প্রাপ্য!
অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যদি আমার (আল্লাহ) পরে কাউকে সেজদা দেওয়ার জন্য অনুমতি দিতাম, তাহলে সেটা পাওয়ার অধিকারী হতো একমাত্র, শুধুমাত্র মা-বাবা।’ অথচ এমন অনেক লোকও আছেন, যারা নিজের মা-বাবার খোঁজখবর রাখেন না, কিন্তু পীরের জন্য নিজেকে বিলীন করে দিচ্ছেন। অথচ আসল পীর নিজের বাবা-মা অযত্নে, অবহেলায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু মা-বাবাই যে সন্তানের জান্নাত, তা তারা জানেন না।
এসব ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই কমবেশি অভিজ্ঞতা আছে। আমি আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করার জন্য আমার সামান্য চেষ্টা। লম্বা অভিজ্ঞতার ইতিহাস লিখে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। তবে এগুলো বর্ণনার কারণ ও আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু বাস্তবতা শেয়ার করার জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আমাদের প্রত্যেক মুসলমানের উচিত অন্তত শরিয়তের ততটুকু জ্ঞানলাভ করা, যা সামাজিক বাস্তবতার সাথে কোরআন-হাদিস কী নির্দেশ দিয়েছে, তা জানা। ১৯৮৪-৮৬ সালে কলেজের গণ্ডি পার হওয়ার আগ পর্যন্ত আব্বার অজ্ঞাতে (নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে) না বুঝে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তিনবার তিনটি মাজার সফর করেছিলাম। আব্বা জানলে কখনো অনুমতি দিতেন না, কেননা এর সুফল-কুফলের বিষয়ে শরিয়তের শিক্ষা সম্পর্কে আব্বা জ্ঞাত ছিলেন।
- ১৯৮৪ সাল। আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। কার উৎসাহে এখন স্মরণ নেই, মিরসরাই থানার পেছনে দিঘির উত্তর-পশ্চিম কর্নারে একটা মাজার আছে, সেটা জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম। জিয়ারত শেষে ফেরার সময় ঘটে বিপত্তি। আমি জিয়ারত শেষে সিঁড়ি বেয়ে ফিরে আসার সময় একজন অনুসারী আমাকে বলল, ‘এই ছেলে, তুমি কী করছ! মাজারকে পেছনে রেখে তুমি বাইরে যাচ্ছ? মাজারকে পেছনে করে যেতে নেই, অমঙ্গল হবে।’
তখন আমি ওকে কিছু না বললেও আমার ভাবনার জায়গায় চিন্তার উদ্রেক হলো, কী ব্যাপার, আল্লাহর ঘর মসজিদ থেকে মাজার বড়? মসজিদ থেকে বের হতে তো কেউ কোনো প্রশ্ন কখনো করে না, আর মাজার তো তাঁর বান্দার কবর মাত্র…।
** মিরসরাই উপজেলার মিঠাছড়া বাজারের পশ্চিমে বিশ্ব দরবার নামে একটি দরগা আছে, যার পরিচিতি এলাকায় তেমন না থাকলেও দূর-দূরান্তের লোকদের কাছে তো বটেই, এমনকি মন্ত্রী-আমলাদেরও আসা-যাওয়া ছিল এবং আছে। আমি যাওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো এর নামও শুনিনি। ওই মাজারের ভক্ত-মুরিদের সংখ্যা আবার সন্দ্বীপ অঞ্চলের লোকজন বেশি।
১৯৮৬ সাল। নিজামপুর কলেজের সন্দ্বীপের এক ক্লাসমেট বন্ধু (মোস্তাক-ই-এলাহী তৌফিক, বর্তমানে ব্যাংকের কর্মকর্তা) আমাকে বলল, ‘চল, তোকে নিয়ে আজ এক লোকের সাথে দেখা করতে যাব।’ আমিও রাজি হয়ে তার সফরসঙ্গী হলাম। যাওয়ার আগে আমার ধারণায় ছিল না, সে দরগায় যাচ্ছে। যা-ই হোক, যাওয়ার পর মনে একটু রাগ হলেও তাকে কিছু বললাম না। অজু করে মসজিদে ঢুকে আসরের নামাজের জামাতের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি। জামাতের আগ মুহূর্তে মেহরাবের পাশ দিয়ে স্পেশাল একটা দরজা খুলে একজন হুজুর মসজিদে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথে ভেতরের মুসল্লিরা এমনভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধার ফল্গুধারা প্রদর্শন করল, যা আল্লাহর ঘর মসজিদের মধ্যে কোনোভাবে শোভনীয় নয়। কেননা, আল্লাহর ঘর মসজিদে রাজা, উজির, প্রজা সবাই সমান, যে আগে আসবে সে সামনের কাতারে বসবে। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ ও সম্মানিত লোকদের মুসল্লিরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সামনে জায়গা করে দেবে, সেটা আদব বা ইসলামের সৌন্দর্য, তাতে দোষের কিছু দেখি না। কারো নিজ থেকে স্পেশাল কিছু প্রত্যাশা করা ইসলাম অনুমোদন করে না।
তার পরের দৃশ্য আরও দৃষ্টিকটু লেগেছে আমার কাছে। নামাজের পরে পীর সাহেব তার মুরিদদেরকে সাক্ষাৎ দেবেন, মসজিদ থেকে পীর সাহেব ওনার স্পেশাল দরজা দিয়ে হুজরাখানায় না গিয়ে মুরিদদেরকে সাক্ষাৎ দেওয়ার জন্য অন্য একটা রুমে যান, যেখানে প্রতিদিন রীতি অনুযায়ী মুরিদরা অপেক্ষায় থাকেন। আমিও বন্ধুকে অনুসরণ করে সাথে গেলাম। আমরা ছাত্র মানুষ, টাকা-পয়সা নেই, সুতরাং হাদিয়া-তোহফা দিতে না পারার কারণে পীর সাহেব আমাদেরকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না বলে আমার মনে হলো। যার কারণে তবারুক হিসেবে আমাদেরকে দিলেন সামান্য মুড়ি-বিস্কুট। আমাদের পাশে বসা ছিলেন দুজন ভদ্রলোক। তারা নতুন ট্রাক কিনেছেন। এখন গাড়ির চাবি নিয়ে এসেছেন হুজুরের দোয়ার জন্য। চাবিসহ ১০০ টাকার নোট হুজুরের হাতে দেওয়ার সাথে সাথে কী যে মহব্বতের দোয়া, তবারুকের ছড়াছড়ি! আমার নবীন মনে প্রশ্ন জাগল, প্রকৃত পীর কখনো এমন স্বার্থপর হতে পারেন না।
এইচএসসি পরীক্ষার আগে আব্বা-আম্মাকে না জানিয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরীক্ষার পরে শাহজালালের মাজার জিয়ারতে যাব। আমাদের এলাকার সমবয়সী এক কাকা তখন সিলেটে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত ছিল। তিনি বাড়ি এলে ওনার সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আব্বাকে জানালাম। এখন না জানিয়ে যে উপায় নেই। কারণ অনুমতি ছাড়া যাওয়া যেমন যাবে না আবার টাকার ব্যাপার-স্যাপার তো আছেই। আব্বা আমার মনের কথা চিন্তা করে বাধা না দিয়ে শরিয়তের দিক থেকে এর গুরুত্ব কী বুঝিয়ে বললেন। আব্বা জানালেন, জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদিনা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া শরিয়তের বিধানে নেই। তবে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বা কাজে সেখানে গেলে সুযোগ থাকলে জিয়ারতে বাধা নেই। কেননা তুমি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে দোয়া করলে আল্লাহ তা দেখেন ও শোনেন।
একবার কী কাজে চট্টগ্রাম আমানত শাহর মাজারের কাছাকাছি গেলে জোহরের নামাজের সময় হলে ভাবলাম, নামাজটা সেরে ফেলি আর মাজারটাও দেখা হলো। নামাজ শেষে বের হওয়ার সময় সেই পুরোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। একজন এসে বলল, ‘ভাই, আপনি এই কী করছেন, মাজার মসজিদকে পেছনে রেখে বের হচ্ছেন কেন!’
১৯৮৮ বা ১৯৮৯ সাল, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ অনার্সে পড়ার সময় কৌতূহলবশত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি নাজিরহাটের মাইজভান্ডারে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে মনে হলো, সেটা একটা শিরকের হেডকোয়ার্টার!
মাগরিবের সময় মসজিদে গিয়ে দেখলাম, মসজিদে আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ নামাজ পড়ার লোকের আকাল। মসজিদের কাতার খালি, অথচ বাইরে নানা রকম অনৈসলামিক কর্মযজ্ঞে লোকে লোকারণ্য।
সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ড হলো বিভিন্ন গদিনসীন মাইজভান্ডারের উত্তরসূরিরা মসজিদে কখন, কোথায় গেছেন বা আদৌ গেছেন কি না জানি না। মসজিদে কেউ যাননি বা হয়তো তাদের যাওয়া লাগে না। নাউজুবিল্লাহ! হয়তো পীর হিসেবে বেহেশতের টিকিট কনফার্ম করে ফেলেছেন! তাই এখন শুধু মুরিদদের টিকিট বিক্রিতে ব্যস্ত বা মুরিদদেরকে সাথি করার জন্য নিজেদের কোরবান করে দিচ্ছেন। আমি নামাজ শেষে বিভিন্ন দরবার ঘুরে দেখলাম। পীরজাদারা যে যার গদিতে আগের মতোই হেলান দিয়ে বসে শুধু আশীর্বাদ বিক্রি করে হাদিয়া-তবারক সংগ্রহে মশগুল। ওনারা মানুষের ধর্মীয় দুর্বলতাকে পুঁজি করে যা করছেন, তা কোরআন-হাদিসের কোন পৃষ্ঠায় লেখা আছে একমাত্র তারাই বলতে পারবেন। নারী-পুরুষের জঘন্য নাচানাচি, গাঁজার আসর, নাচ-গান, ঢোল-তবলা আরও কত কী, লিখে শেষ হবে না। আমি মাগরিবের ঘণ্টা দুয়েক পর আসি। শুনেছি, রাতের পরিবেশ নাকি আরও ভয়াবহ, জঘন্য।
আমার প্রশ্ন সম্মানিত পাঠক, ওরস, মাজার জসনে-জুলসে ঈদে মিলাদুন্নবীর নামে দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে আনুষ্ঠানিকতা হয়, তা যদি ইসলামে অনুমোদন থাকত, তাহলে মক্কা শরিফ-মদিনা শরিফে হয় না কেন?
আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদেরকে আমি উপহার হিসেবে দিলাম দুটি ঈদ-ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ এই তৃতীয়টা কোথা থেকে এল? মাজার, ওরস ও ঈদে মিলাদুন্নবী যদি ইসলামের কোনো ঐতিহ্য হতো, তাহলে নবী-রাসুলদের বা সাহাবাদের কবরই হওয়ার কথা যুগশ্রেষ্ঠ মাজার এবং সবচেয়ে বড় ওরস হতো সৌদি আরবের মক্কা-মদিনায়।
আমাদের দেশে ওই মাজারপূজারিরা নিজেদের দাবি করে আশেকে রাসুল, অথচ নবীর অবমাননায় তারা থাকে নিশ্চুপ। তখন তাদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না। বর্তমানে ফ্রান্সের বিষয়েও ওদের কোনো তৎপরতা নেই। ইসলামিক শিক্ষার অন্যতম মিডিয়া পিস টিভি বন্ধ করার জন্য ওরা খুবই সরব ছিল কিন্তু আমাদের ইসলামি ঐতিহ্য ও পারিবারিক বন্ধন বিনষ্টকারী জিটিভি ও স্টার জলসা চ্যানেলের ব্যাপারে ওদের কোনো আওয়াজ নেই।
এতে প্রমাণিত হয়, ওরা ধর্ম ও নবী-রাসুলের প্রেমের অভিনয়ের আড়ালে শুধু পেটপূজারি এবং ইসলামবিদ্বেষী দেশ ও গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত।
শাহজালাল, শাহপরান ও শাহ আমানত অত্যন্ত বুজুর্গ ও আল্লাহর ওলি ছিলেন, এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওনাদের কবরকে মাজার বানিয়ে যা হচ্ছে সেটাই সমস্যার কারণ। বারো আউলিয়া, বায়েজিদ বোস্তামির মতো অনেক মাজারে ওনাদের কবরের কোনো অস্তিত্বই নেই বা ছিল না। কোনো কোনোটা আউলিয়াদের আস্তানা ছিল মাত্র। যেখানে বারো আউলিয়ার মাজার নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বারো জনের একজনেরও মাজার নেই। সেখানে নাকি ওই সাধকেরা ইসলাম প্রচারের জন্য আরব দেশ থেকে সমুদ্রপথে এসে প্রথম আস্তানা গেড়েছিলেন মাত্র।
মানুষ মরে যাওয়ার পর তার আমলনামা বন্ধ হয়ে যায়। আমলনামা বন্ধ হওয়ার পর কেউ কারো উপকার বা অপকার কিছুই করতে পারে না। তা-ই যদি করতে পারত, তাহলে যারা মাজারে বসে অপকর্ম করে, গাঞ্জা খায়, জুতা-স্যান্ডেল চুরি করে, তাদের ক্ষতি হয় না কেন?
তবে যারা আল্লাহর প্রিয় ওলি, তাদের অসম্মানে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হতে পারেন, মৃতের সম্মানে তার মাগফিরাতের জন্য সবার দোয়া করা উচিত, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু মৃত পীরের কিছুই করার কোনো ক্ষমতা থাকে না। অথচ কিছু মানুষ মাজারে মানত করে, মাজারে গিয়ে ছেলেমেয়ে চায়, যা সরাসরি শিরক। চাইতে হবে শুধু একমাত্র আল্লাহর নিকট।
মৃত্যুর পর সবার একটাই আরজিÑশুধু ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি! আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলাম (কোরআন-হাদিস) জানার ও বোঝার তৌফিক দিন, আমিন।
Ñব্রুকলিন